E-Paper

শুভাংশুর যাত্রা শুধুই প্রতীকী নয়

কেন এ কথা বলছি? আশির দশকে মহাকাশ অভিযান এবং গবেষণা ছিল অনেকটাই চারাগাছের মতো। সদ্য সে ডালপালা মেলতে শিখেছিল। মহাকাশে যাওয়া, সেখানে কত দিন কাটানো যায় ইত্যাদি ছিল সে সময়ের মূল লক্ষ্য। তার পর থেকে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে।

ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্ল।

ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্ল। —ফাইল চিত্র।

সোমক রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২৫ ০৬:৪২
Share
Save

চার দশক পরে ফের মহাকাশে পাড়ি দিতে চলেছেন আর এক ভারতীয় নভশ্চর। এই সময়ের ব্যবধানে বদলে গিয়েছে মহাকাশযাত্রার ইতিবৃত্তও। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার সয়ুজ টি-১১ মহাকাশযানে চেপে রাকেশ শর্মার যাত্রা ছিল জাতির গৌরবের প্রতীক। ভারতও যে মহাকাশে যেতে পারে, তার প্রতীকী পদক্ষেপ। ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লের যাত্রা কিন্তু শুধু ‘প্রতীকী’ পদক্ষেপে থেমে থাকবে না। বরং মহাকাশ-যুগের সূচনায় ভারতের অবদানকে আরও দৃঢ় করবে।

কেন এ কথা বলছি? আশির দশকে মহাকাশ অভিযান এবং গবেষণা ছিল অনেকটাই চারাগাছের মতো। সদ্য সে ডালপালা মেলতে শিখেছিল। মহাকাশে যাওয়া, সেখানে কত দিন কাটানো যায় ইত্যাদি ছিল সে সময়ের মূল লক্ষ্য। তার পর থেকে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। এখন মহাকাশে গিয়ে মাসের পর মাস থাকছেন মহাকাশচারীরা, নানা ধরনের গবেষণা করছেন, ভিন্ গ্রহেও রোবট পাঠাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ভারতও মহাকাশ অভিযানে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে উঠে এসেছে। আগামী দিনে আরও বড় পা ফেলতে চাইছি আমরা। ২০২৭ সালে গগনযান (ভারতের মহাকাশচারীদের নিজস্ব মহাকাশ অভিযান) এবং ২০৩৫ সালে মহাকাশে ভারতীয় অন্তরীক্ষ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা আছে। তারপরে চাঁদেও ভারতীয়দের পা ফেলার ভাবনা আছে।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শুভাংশু কিন্তু শুধু সফরসঙ্গী হিসেবে মহাকাশে যাচ্ছেন না। তিনিই মহাকাশযান চালাবেন। রাকেশ শর্মা সেই সুযোগ পাননি। এই প্রসঙ্গেই বলে রাখি, শুভাংশুর সঙ্গে বাকি যে মহাকাশচারীরা যাচ্ছেন, তাঁরা যথাক্রমে আমেরিকা, পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির বাসিন্দা। নেতৃত্ব দেবেন আমেরিকান নভশ্চর। তার পরেই দলে দ্বিতীয় নম্বরে আমাদের বায়ুসেনা অফিসার।

গত চার দশকে মহাকাশ অভিযানের দায়িত্ব বদলে গিয়েছে। শুধু অভিযান নয়, মহাকাশ নির্ভর অর্থনীতির দিকে হাঁটছে বিশ্ব। ইতিমধ্যেই মহাকাশ সংক্রান্ত অর্থনীতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই আগে যেমন ইসরো, নাসার মতো সরকারি সংস্থাই মহাকাশ অভি‌যানে যেত এখন সেখানে বেসরকারি সংস্থাও এসে গিয়েছে। ভারতেও মহাকাশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা আসছে। আগামী দিনে পৃথিবীতে লিথিয়াম, টাইটানিয়াম, জ়িরকোনিয়াম, বেরিলিয়ামের মতো খনিজের উৎপাদন বন্ধ হলে চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহাণু থেকে সেই খনিজ উত্তোলন করার পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মহাকাশ কেন্দ্র স্থাপন, চাঁদের মাটিতে কেন্দ্র স্থাপন, মহাকাশচারীদের দীর্ঘদিন থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি করার পরিকল্পনা করতে হবে। যাকে বলা হয় ‘রোড ম্যাপ’। এই কাজে আরও বেসরকারি সংস্থারা ক্রমশ এগিয়ে আসবে। অর্থনীতির একটি বড় ক্ষেত্র হবে মহাকাশ।

এই ‘রোড ম্যাপ’ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি গবেষণা। যে কাজে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থা এবং গবেষণাগার নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। শুভাংশুরা মহাকাশে যে কয়েকটি গবেষণা করবেন তার দু’-তিনটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। প্রথমত, শুভাংশু মহাকাশে মুগ এবং মেথির বীজ নিয়ে যাবেন। সেখানে সেই বীজের অঙ্কুরোদ্গম ঘটাবেন। দেখবেন, পৃথিবীর মাটিতে অঙ্কুরোদ্গম ঘটালে বীজের ভিতরে যে খাদ্যগুণ থাকে তার থেকে কম-বেশি হচ্ছে কি না, নাকি কোনও বীজ বিষিয়ে যাচ্ছে। এই গবেষণার উপরে নির্ভর করে আগামী দিনে মহাকাশচারীদের খাদ্য কী হবে, তা স্থির করা যেতে পারে। এই কাজ কিন্তু করবে একটি ভারতীয় সংস্থা।

দ্বিতীয়ত, মহাকাশে দীর্ঘদিন থাকলে অভিকর্ষ বলের অভাবে মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি সুনীতা উইলিয়ামস ফিরে আসার পরে দুর্বল মাংসপেশির জন্য দাঁড়াতেই পারছিলেন না। এই মাংসপেশির ক্ষতি নিয়েও মহাকাশে পরীক্ষা চালাবেন শুভাংশুরা। পৃথিবীতে হাড় এবং মাংসপেশির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নানা গবেষণা হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ওজনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। তাই ওজনের প্রভাব ছাড়া বয়সের সঙ্গে কী ভাবে হাড় এবং মাংসপেশির ক্ষয় শুরু হয় তা আলাদা করে বোঝা যায় না। মহাকাশে বিনা অভিকর্ষে (যেখানে ওজনের প্রভাব থাকে না) হাড় এবং মাংসপেশির গঠন কী ভাবে ক্ষয় হচ্ছে তা বোঝা সম্ভব। হাড় এবং মাংসপেশির ক্ষয় সংক্রান্ত গবেষণায় এটিও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। তৃতীয়ত, মহাকাশে সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে যাচ্ছে এই চার সদস্যের দল। এই শৈবাল দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে, বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমাতে পারে। আবার এই শৈবালকে খাদ্যতেও রূপান্তরিত করা যায়। তাই মহাকাশে এই শৈবাল বেঁচে থাকছে কি না, বংশবৃদ্ধি করছে কি না, ইত্যাদি গবেষণা তাৎপর্যপূর্ণ। চতুর্থত, মহাকাশে ৪জি-৫জি নেটওয়ার্ক, শূন্য অভিকর্ষে কী গড়নের ল্যাপটপ সব থেকে উপযোগী, সে সবও দেখবে এই দল। ভবিষ্যতে মহাকাশে কাজ করতে গিয়ে যেমন এ সব গবেষণার ফলাফল কাজে লাগবে, তেমনই সেই ফলাফল থেকে দীর্ঘ বিমানযাত্রার ক্ষেত্রেও কাজ করতে গিয়ে কেমন বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি আরও উপযোগী হবে তা-ও বোঝা সম্ভব হবে।

এ সবের পরেও আরও একটি বিষয় থেকে যাচ্ছে। গোড়াতেই বলেছি, চারটি আলাদা দেশের প্রতিনিধি এই অভিযাত্রী দলে আছেন। তার মধ্যে পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির মহাকাশ চর্চা তেমন জোরালো নয়। কিন্তু তারাও এই অভিযানে সামিল হয়েছেন। কারণ, এই মহাকাশ অভিযান এবং চর্চার সূত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে কূটনৈতিক সম্পর্কও আগামী দিনে নিয়ন্ত্রিত হবে। অতীতেও যুযুধান বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি সংক্রান্ত সমন্বয় আমরা দেখেছি। যাকে ‘বিজ্ঞান-কূটনীতি’ বলেও অভিহিত করা হয়। মহাকাশ চর্চা যে পর্যায়ে এগোচ্ছে তাতে আগামী দিনে কোনও একটি দেশের পক্ষে পুরো অভিযান করা সম্ভব হবে না। বহু দেশ মিলে একত্রে কাজ করা শিখতে হবে। এই অভিযান সেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিশাও দেখাবে।

সব শেষে বলি, মহাকাশ অভিযান এবং চর্চার এক ঊষালগ্নে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এই সময়ে দাঁড়িয়ে শুভাংশুর যাত্রা শুধু প্রতীকী গৌরব নয়, বরং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরও বড় এবং দৃঢ় পদক্ষেপ।

(লেখক অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Shubhanshu Shukla ISRO Space X

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।