E-Paper

সোনমের ফাঁসি চাইলেন দাদা

১১ জুন। বিয়ের বয়স ঠিক যে দিন এক মাসে পা দিল, সে দিন রাজাই আর পৃথিবীতে নেই। অহোরাত্র চলতে থাকা টিভিতে ব্রেকিং নিউজ় আছড়ে পড়ছে, প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ভাড়াটে খুনি দিয়ে রাজাকে চিরতরে সরিয়ে দিয়েছেন রঘুবংশী বাড়ির নতুন বৌমা সোনম।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৫ ০৭:৪০
নিহত রাজা রঘুবংশীর মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন অভিযুক্ত সোনমের দাদা গোবিন্দ রঘুবংশী। বুধবার ইন্দোরে।

নিহত রাজা রঘুবংশীর মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন অভিযুক্ত সোনমের দাদা গোবিন্দ রঘুবংশী। বুধবার ইন্দোরে। ছবি: পিটিআই।

ঠিক এক মাস আগের এই তারিখটা। ১১ মে।

ইন্দোরের কুশওয়াহা নগরে আলো আর আতশবাজির রোশনাই গায়ে মেখে সাদা ঘোড়ায় চেপে বিয়ে করতে এসেছিলেন রাজা! ছোট মেয়ে ‘বিট্টি’কে রাজকন্যার মতোই আদরে বড় করেছিলেন দেবী সিংহ রঘুবংশী। পরম মমতায় রাজা রঘুবংশীর হাতে মেয়ে সোনমকে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। একই শহরে, শাহকার নগরের তিনতলা অট্টালিকা তখন গমগম করছিল আনন্দধ্বনিতে। বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে বলে কথা। রাজার বিয়ে রাজকীয় ভাবেই দিয়েছিলেন বাবা-মা অশোক ও উমা রঘুবংশী।

১১ জুন। বিয়ের বয়স ঠিক যে দিন এক মাসে পা দিল, সে দিন রাজাই আর পৃথিবীতে নেই। অহোরাত্র চলতে থাকা টিভিতে ব্রেকিং নিউজ় আছড়ে পড়ছে, প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ভাড়াটে খুনি দিয়ে রাজাকে চিরতরে সরিয়ে দিয়েছেন রঘুবংশী বাড়ির নতুন বৌমা সোনম। পুলিশের কাছে দোষ কবুলও করেছেন তিনি!

বোনের স্বীকারোক্তির পরে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সামনে আর মুখ তুলতে পারছিলেন না গোবিন্দ রঘুবংশী। রাজার মা উমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলেন। উমা বুকে জড়িয়ে ধরেন গোবিন্দকে। শুধু জানতে চান, “কেন এমন করল বিট্টি? ওকে তুমি কেন কয়েকটা থাপ্পড় মারলে না? ” গোবিন্দ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “তাই মারতাম। সুযোগ পেলাম না। আজ থেকে ওর সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই। এখন থেকে আমিই আপনাদের হারিয়ে যাওয়া রাজা।” বাইরে বেরিয়ে গোবিন্দ বলেন, “আমিও সোনমের ফাঁসি চাই। আমি নিজে রাজার তরফের আইনজীবীর সঙ্গে থাকব। সোনম আমায় ও রাজ কুশওয়াহাকে বাড়িতে একসঙ্গে রাখী পরিয়েছিল। কিন্তু ভিতরে তাদের এমন সম্পর্ক! ভাবতে পারছি না।” রাজার মা সোনমের পরিবারকে কোনও দোষারোপ না করলেও রাজার দাদা বিপিন রঘুবংশী এখনও দাবি করছেন, সোনম তাঁর মা সঙ্গীতাকে রাজের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু মা সেই খবর চেপে যান পরিবারের কাছে। তাই সোনমের মাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবিতুলেছেন বিপিন।

সোনমকে নিয়ে গত রাতেই শিলংয়ে পৌঁছয় পুলিশ। আজ সকালে শিলংয়ে পৌঁছনো বাকি চার অভিযুক্তের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হয় সোনমকে। দেখানো হয় সোহরায় রাজার হত্যার পরে ঘটনাস্থলের ১০ কিলোমিটার দূরে অভিযুক্তদের সঙ্গে সিসি ক্যামেরায় বন্দি হওয়া তাঁর ফুটেজও। পুলিশ সূত্রের দাবি, এর পরেই ভেঙে পড়েন সোনম। বিকেলে জেলা ও দায়রা আদালতে তোলা হলে সোনম, রাজ ও তিন হত্যাকারী— আকাশ রাজপুত, বিশাল সিংহ চৌহান ও আনন্দ কুড়মিকে ৮ দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে পাঠানো হয়। ঘটনার পুনর্নিমাণের জন্য এর পরে সকলকে সোহরায় নিয়ে যাওয়া হবে। প্রসঙ্গত, মেঘালয়ে ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সোনম গর্ভবতী নন।

‘নিখোঁজ’ সোনমকে কী ভাবে প্রথম সন্দেহের আবর্তে আনল পুলিশ? সূত্রের খবর, রঘুবংশী দম্পতি নিখোঁজ হওয়ার পরে একটি হোমস্টে থেকে তাঁদের অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে সোনমের মঙ্গলসূত্র ও পায়ের আঙুলে পরার আংটি পায় পুলিশ। সাধারণত হিন্দি বলয়ে বিবাহিতা মহিলারা মঙ্গলসূত্র ও পায়ের আঙুলের আংটি বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে পরেন। সে সব খুলে রেখেই সোনম বেরিয়েছিলেন দেখে সন্দেহ হয় পুলিশের। সূত্রের মতে, সম্ভবত মঙ্গলসূত্র ও স্বামীর নাম করে পরা আংটি শরীরে রেখে তাঁকে খুন করতে চাননি সোনম। তা ছাড়া খুনের পরেই সোনম চলে যান রাজের কাছে। সুতরাং ওই মঙ্গলসূত্র তাঁর কাছে অর্থহীন।

পুলিশি সূত্র জানচ্ছে, প্রথমে রাজাকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দুর্ঘটনার তত্ত্ব সাজানোর কথা ভেবেছিলেন সোনম ও রাজ। কিন্তু রাজা নিয়মিত শারীরচর্চা করতেন। তাই পরে সোনম ও রাজ ভাবেন,একা সোনমের পক্ষে বা তাঁর সঙ্গে আর এক জন থাকলেও রাজাকে কাবুকরা সহজ হবে না। তখন ২০ লক্ষ টাকার লোভ দেখিয়ে রাজ তার ছোটবেলার তিন বন্ধু আকাশ, বিশাল ও আনন্দকে পাঠায়। মধুচন্দ্রিমার ফটোশুটের নাম করে নির্জন ও দু’বছর ধরে বন্ধ থাকা ওয়েই সাওডাং জলপ্রপাতের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় রাজাকে। কিন্তু তখনও তাঁকে খাদে ঠেলে ফেলা যে সম্ভব হবে না, বুঝে গিয়েছিলেন সোনমরা। তাই ‘প্ল্যান বি’ বেছে নেওয়া হয়। সোনমের নির্দেশে ধারালো অস্ত্রের কোপ মারা হয়রাজার মাথায়।

পুলিশ জানায়, আকাশ, বিশাল, আনন্দরা আগেই সব কবুল করেছে। তিন বন্ধুকে ৫০ হাজার টাকা, একটি কিপ্যাড ফোন ও একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন দিয়েছিল রাজ। কিপ্যাড ফোনে রাজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল বিশাল। আর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে লোকেশন ডিটেলস পাঠাচ্ছিলেন সোনম। ঘটনার পরে সেই মোবাইল দু’টি ফেলে দেয় খুনিরা। ইন্দোর পুলিশ জানতে পেরেছে, রাজাকে মারার পরে সোনম ২৫ থেকে ২৭ মে ইন্দোরের দেওয়াস নাকা এলাকার একটি ভাড়ার ঘরে রাজের সঙ্গে ছিলেন। এর পরে রাজ সোনমকে বারাণসী পাঠায়। ৮ জুন সোনম বারাণসীর আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস (আইএসবিটি) থেকে গোরক্ষপুরগামী বাসে ওঠেন। সম্ভবত গোরক্ষপুর থেকে নেপালে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু রাজের গ্রেফতার হওয়ার খবর পেতেই নন্দগঞ্জের কাছে একটি ধাবার সামনে তিনি বাস থেকে নেমে যান।

মেঘালয় পুলিশ জেনেছে, সোনম তাঁদের ভ্রমণের সময়েই রাজের এক বন্ধুর চারটি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছিলেন। সম্ভবত সেই টাকাই খুনিদের দেওয়ার কথা ছিল। ওই বন্ধুকেও পুলিশ খুঁজছে। মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড়ের এসপি বিবেক সিয়েম জানিয়েছেন, পোক্ত মামলা তৈরি করে শীঘ্রই চার্জশিট দেবে পুলিশ। আজ মেঘালয় সরকারের তরফে উদ্ধারকাজে নিযুক্ত স্থানীয় মানুষ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ও পুলিশকর্মীদের সংবর্ধনা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। পর্যটনমন্ত্রী পল লিংডো মেঘালয় ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের ৩৬ জন সদস্যকে ৫.৪ লক্ষ টাকা ও উদ্ধারকাজে নিযুক্ত পুলিশ, দমকল ও সরকারি কর্মীদের মাথা-পিছু ১৫ হাজার করে টাকা দিয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডের পরে রাজার পরিবার ক্রমাগত মেঘালয় সরকার ও পুলিশের নিন্দা করেছিল। আজ রাজার দুইদাদা বিপিন ও শচীন মেঘালয়বাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। বিপিনঅনুরোধ করেন, “রাজ্যের কোনও আইনজীবী যেন সোনমের হয়ে মামলা না লড়েন।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Meghalaya Murder Case meghalaya

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy