ফতেপুর রোড ধরে আল ফালাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে বাঁ দিকে হলুদ রঙের দোতলা বাড়ির দিকে সকলেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন। ধৌজ গ্রামের এই বাড়ি থেকেই ৩৫৮ কিলোগ্রাম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে? দিল্লির লাল কেল্লার কাছে বিস্ফোরণের সঙ্গে এই বাড়িরই যোগসূত্র রয়েছে?
হলুদ দোতলায় বারান্দা ধরে সার দেওয়া ঘরের দরজায় নম্বর লেখা। মোট ২৮টি ঘর। সাধারণত ভিন্ রাজ্য থেকে ফরিদাবাদে কাজ করতে আসা রাজমিস্ত্রিরাই ধৌজ কসবার এই বাড়িতে ঘর ভাড়া নেন। ১৫ নম্বর ঘরটা দু’মাসের জন্য ভাড়া নিয়েছিল আল ফালাহ্ স্কুল অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ও হাসপাতালের চিকিৎসক মুজ়াম্মিল শাকিল গনাই।
আফসোস করছেন বাড়ির মালিক বৃদ্ধ হাজি মাদ্রাসি। “গত ১৩ সেপ্টেম্বর উনি এসে বললেন, একটা ঘর চাই। দিয়ে দিলাম। দু’মাসের অগ্রিম ভাড়া ২৪০০ টাকা মিটিয়ে দিলেন। তার পর মালপত্র রেখে তালা দিয়ে চলে গেলেন। বললেন, হাসপাতালে হস্টেল মিললেই ঘর ছেড়ে দেবেন। ভিন্ রাজ্যের ভাড়াটে এলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য যাই। এ ক্ষেত্রে আর যাইনি। শুধু কাগজে নামধাম লিখে দিতে বলেছিলাম।” সেই কাগজের ফটোকপি তুলে দেখান হাজি। তাতে শুধু লেখা ডাক্তার, আল ফালাহ্। ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর, দু’মাসের বাড়ি ভাড়া মেটানোর কথা।
ফরিদাবাদের ধৌজ কসবায় হাজি মাদ্রাসির বাড়ি থেকে আল-ফালাহ্ হাঁটা পথ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হরিয়ানার সঙ্গে রাজস্থান, কাশ্মীরের মতো বিভিন্ন রাজ্যের পড়ুয়ারা ডাক্তারি পড়েন। পাঁচ বছরে শুধু পড়ার খরচ এক কোটি টাকা। নামীদামি ডাক্তাররা পড়ান। গরিব মানুষের সস্তায় চিকিৎসা হয়। সেই হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব জিনিসপত্র রাখার জন্য ঘর ভাড়া নিয়েছেন বলে হাজি মাদ্রাসি আর সন্দেহ করেননি।
দিন পনেরো পরে হাজিমাদ্রাসির ঘুম ছুটে যায়। প্রথমে দুই কাশ্মীরি হাজির বাড়িতে এসে মুজ়াম্মিলের ঘরে তালা ভেঙে ঢোকে। কিছু জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়। তার পরে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের বাহিনী বাড়িতে চড়াও হয়।
মুজ়াম্মিলের ভাড়া নেওয়া ঘর থেকে উদ্ধার হয় ৩৫৮ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ক্রিনকভ রাইফেল, তিনটি ম্যাগাজ়িন, ৮৩টি কার্তুজ, পিস্তল, বোমার টাইমার, ব্যাটারি, রিমোট কন্ট্রোল, পাঁচ কেজি ভারী ধাতব পদার্থ, ওয়াকি-টকি। ১২টা স্যুটকেস ও একটি বড় বালতিতে ভর্তি করে বিস্ফোরক রাখা ছিল। তারপরে মুজ়াম্মিলকে জেরা করে পাওয়া তথ্য থেকে ধৌজের দেহার কলোনি থেকে আরও ২,৫৬৩ কেজি বিস্ফোরক, চিনা পিস্তল, বেরেটা পিস্তল, একে-৫৬, ক্রিকনভ রাইফেল উদ্ধার হয়।
মুজ়াম্মিল শাকিল এক দিনে এত বিস্ফোরক জমা করেছিল? প্রতিবেশীদের বক্তব্য, রাতের দিকে একটি গাড়ি বাড়ির সামনে থামত। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া হত।
মুজ়াম্মিল, শাহিন সাহিদ এবং লাল কেল্লার সামনে গাড়ি নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো ‘সুইসাইড বম্বার’ উমর নবী, তিন জনেই ফরিদাবাদের ধৌজে আল ফালাহ্ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। পড়াতেনও। আল ফালাহ্ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের তৈরি এই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের এই তিন ডাক্তারেরই জইশ-ই-মহম্মদ, আনসার গাজ়ওয়াতুল-হিন্দের সঙ্গে যোগসূত্র মিলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এনআইএ, হরিয়ানা পুলিশ, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অফিসাররা তদন্ত-জিজ্ঞাসাবাদে ব্যস্ত। মুসলিম প্রধান ধৌজ কসবায় ঢোকা, বেরনোর সব রাস্তায় পুলিশ প্রতিটি গাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে।
উমর নবী আল ফালাহ্ ক্যাম্পাসের মধ্যেই হস্টেলে থাকতেন। হস্টেলের সমস্ত ঘরে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পাশেই একটি মসজিদে মুজ়াম্মিল, উমররা নমাজ পড়তে যেতেন। সেই মসজিদের ইমামকেও পুলিশ আটক করেছে। ধৌজের বাসিন্দা মহম্মদ নাসিম বলেন, “আল-ফালাহ্-তে কাশ্মীরের অনেক পড়ুয়া রয়েছে। তেমনই কাশ্মীর থেকে আসা ডাক্তাররাও ছিলেন। হরিয়ানার ডাক্তাররা হয় গুরুগ্রাম বা ফরিদাবাদ শহর থেকে যাতায়াত করেন। ভিন রাজ্যের ডাক্তাররা হাসপাতাল ক্যাম্পাসেই থাকেন। হাজি মাদ্রাসির বাড়িতে একমাত্র ডাক্তার মুজ়াম্মিলই ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন।”
আল ফালাহ্-তে এমবিবিএস পড়ুয়ারা একটি বিষয়ে অবাক। তা হল, মুজ়াম্মিল, শাহিন ও উমর তিন জনেই একই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এবং দিল্লিতে বড় মাপের নাশকতার চেষ্টা করছিল বলে পুলিশ দাবি করলেও হাসপাতালে কখনও তাদের একসঙ্গে দেখা যেত না। মুজ়াম্মিল জুনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তার হিসেবে জরুরি বিভাগে কাজ করতেন। শাহিন ফার্মাকোলজি পড়াতেন।
আর ‘সুইসাইড বম্বার’ উমর? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পড়ুয়াদের বক্তব্য, দিন দশেক আগেও সে ক্লাস নিয়েছে। হাসপাতাল ক্যাম্পাসেই হস্টেলে থাকত। মেধাবী ও পেশাদার হিসেবে পরিচিতটি বিশেষ কারও সঙ্গে মেলামেশা করত না।
গোটা ঘটনায় পড়ুয়াদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁদের মনে প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কালি লাগলে সেখান থেকে এমবিবিএস পাশ করে বেরনোর পরে চাকরিবাকরি পেতে অসুবিধা হবে না তো? স্থানীয়দের চিন্তা, এর পরে হাসপাতালে যে সস্তায় ভাল চিকিৎসা পাওয়া যেত, তা মিলবে তো? স্থানীয় বাসিন্দা নাসিম খান বলেন, “রোজ একশো-দেড়শো জন ডাক্তারের গাড়ি ঢুকতে দেখি। মঙ্গলবার থেকে মেরেকেটে জনা কুড়ি ডাক্তার ভিতরে গিয়েছেন।” আজ আল ফালাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভূপিন্দর কৌরআনন্দ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, সংস্থার সঙ্গে ধৃত দুই ডাক্তারের পেশাদারি সম্পর্ক ছাড়া আর কোনও যোগাযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর বা ল্যাবরেটরি বোমা বানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়নি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)