সার্ক ভেসে গিয়েছে পাকিস্তানের সীমান্ত সন্ত্রাসের জেরে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে সমৃদ্ধ, নিরাপদ, স্থিতিশীল রাখা এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্যের পথে চলার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল চতুর্দেশীয় অক্ষ কোয়াড। এ বার কি সেই কোয়াডেরও ভবিষ্যৎ কিছুটা টলোমলো? কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, কোয়াডের সাফল্যের সঙ্গে আপাতত জড়িয়ে গিয়েছে ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যৎ।
চলতি বছর শেষ হতে তিন মাসও বাকি নেই। অথচ এই বছরেই কথা রয়েছে নয়াদিল্লিতে কোয়াডের শীর্ষ বৈঠক হওয়ার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সাউথ ব্লকে বিষয়টি নিয়ে কোনও নড়চড়া নেই। বাণিজ্য এবং শুল্ক নিয়ে মতবিরোধ গভীর হয়েছে কোয়াডের তিন সদস্য রাষ্ট্র আমেরিকা, ভারত এবং জাপানের মধ্যে। ফলে কোয়াড বৈঠক এখনও পর্যন্ত অনিশ্চিত বলেই মনে করা হচ্ছে।
বস্তুত ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর রবিবারই এক সাক্ষাৎকারে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির প্রশ্নে ভারত নিজের অবস্থানকে লঘু করবে না। বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে ভারত যে আন্তরিক, তা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলেছেন, ‘‘আমেরিকাকেও ভারতের কিছু লক্ষ্মণরেখা (রেড লাইন) মানতে হবে।’’ অর্থাৎ কৃষি এবং দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার আমেরিকার সামনে যে হাট করে খুলে দেবে না ভারত, জয়শঙ্করের কথায় সেই ইঙ্গিতই মিলেছে। সেই সঙ্গে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির প্রশ্নেও যথেষ্ট কড়া ভাবে তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকার এই দ্বিতীয় দফার শুল্ক চাপানোকে ভারত অত্যন্ত অন্যায্য বলেই মনে করে। জয়শঙ্করের কথায়, ‘‘যে দ্বিতীয় শুল্ক রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য আমাদের উপর বসানো হয়েছে , আমরা প্রকাশ্যেই তার সমালোচনা করেছি। অন্য অনেক রাষ্ট্রই এ ভাবে তেল কিনছে।’’ বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে দিল্লি এবং ওয়াশিংটন যে এখনও কার্যকরী ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি, সে কথাও গোপন রাখেননি তিনি।
ভারতীয় পণ্যের উপর আমেরিকা ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর আগে পর্যন্ত স্থির ছিল নভেম্বরে নয়াদিল্লিতে কোয়াড বসবে। যোগ দিতে আসবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের কোনও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হতে গেলে দীর্ঘ দিনের প্রস্তুতি লাগে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সবই থমকে রয়েছে। ফলে নভেম্বরে কোয়াড বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।’’ অন্য এক কর্তার মতে, ‘‘ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি কবে বাস্তবায়িত হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ফলে নভেম্বরে ট্রাম্পের দিল্লি আসার সম্ভাবনা কম। একমাত্র যদি নাটকীয় ভাবে চুক্তির ক্ষেত্রে কোনও সাফল্য আসে, তা হলে খেলা ঘুরতে পারে। কিন্তু সে কথা এখনও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।’’
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রীরা গত মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে যোগ গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলাদা করে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করেছিলেন। কিন্তু কোয়াডের ছাতার তলায় কোনও বৈঠক করতে এই চার রাষ্ট্রের বিদেশমন্ত্রীকে দেখা যায়নি। সূত্রের বক্তব্য, শীর্ষতম পর্যায়ের বৈঠক হলে হাতে-কলমে কিছু ফলাফলের প্রয়োজন থাকে। যৌথ বিবৃতিতে যা স্পষ্ট করা হয়। কিন্তু এখন যা কূটনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে কোয়াড থেকে কিছু হাতে-কলমে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন তো শুধু মাত্র বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে মনান্তর নিয়েই নয়। রাশিয়া থেকে তেল কেনার ব্যাপারে ভারতের উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাওয়া, ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফের নিষেধাজ্ঞা জারি করা, এইচওয়ান বি ভিসার ফি বাড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়গুলিও সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে কূটনৈতিক মহলের অভিমত।
আগামী মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের মূল নজর থাকবে বিহারের বিধানসভা ভোটের দিকে। অন্য দিকে জাপানের শাসক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ব্যস্ত রয়েছে শিগেরু ইশিবার পদত্যাগের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ে। নতুন নেতা নির্বাচিত হয়ে গেলে জাপান সরকারের মূল লক্ষ্য থাকবে নতুন সরকার তৈরির পর বিভিন্ন ঘরোয়া রাজনৈতিক বিষয়ে। অন্য দিকে কোয়াডের বৈরী রাষ্ট্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারতে আসার কথা ডিসেম্বরের গোড়ায়। সেটাও ভারতে ওই একই সময়ে কোয়াড অনুষ্ঠিত করার পক্ষে জটিলতা বাড়াবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)