Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

হস্টেলবাসী ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই দিন গুজরান

বড়দিনের মরশুমে এখন আর হাওয়ায় টাটকা কেক তৈরির গন্ধ ভেসে আসে না। বর্ষবরণের লগ্নে নাচগানের মদির আমেজে উষ্ণ হয়ে ওঠে না শীতার্ত এই জনপদ। রাঁচি থেকে ঘণ্টা কয়েকের দুরত্বে, পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা মনোরম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহল্লা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ এখন আর অতীতের ছায়াও নয়!

হস্টেল খুলেই টিকে রয়েছে এই ধরনের বাংলো। ম্যাকলাস্কিগঞ্জে।—নিজস্ব চিত্র।

হস্টেল খুলেই টিকে রয়েছে এই ধরনের বাংলো। ম্যাকলাস্কিগঞ্জে।—নিজস্ব চিত্র।

আর্যভট্ট খান
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

বড়দিনের মরশুমে এখন আর হাওয়ায় টাটকা কেক তৈরির গন্ধ ভেসে আসে না। বর্ষবরণের লগ্নে নাচগানের মদির আমেজে উষ্ণ হয়ে ওঠে না শীতার্ত এই জনপদ। রাঁচি থেকে ঘণ্টা কয়েকের দুরত্বে, পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা মনোরম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহল্লা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ এখন আর অতীতের ছায়াও নয়!

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারগুলির হাতে-গোনা এখন টিকে আছে। কলকাতা বা রাঁচির ‘বাঙালিবাবু’রাও ইদানীং খুব একটা বেড়াতে আসেন না এখানে। নানা কারণে হোটেল বা অতিথিশালার বেশিরভাগই ঝাঁপ বন্ধ করেছে। সন্ধের পর খাঁ-খাঁ জনপদটির খণ্ডহরে যেন জেগে থাকে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’! তবে বদলে যাওয়া ম্যাকলাস্কিগঞ্জের জীবনে অক্সিজেন এখন এক ঝাঁক স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে।

পল্লির জনপদ ছেড়ে দূর বিদেশে বা দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই, কলকাতায় পাড়ি দিয়েছেন সাবেক বাসিন্দা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ‘সাহেব’-এর দল। সেই পরিত্যক্ত চোখ জুড়োনো বাংলোর কয়েকটি নতুন করে সাজিয়েই গড়ে উঠেছে ছেলেমেয়েদের হস্টেল।

ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী-জুজু তো আছেই। নব্বইয়ের দশকে মাওবাদী-উপদ্রবের সময় থেকেই ম্যাকলাস্কিগঞ্জের দুর্দশার শুরু। বুদ্ধদেব গুহ, অপর্ণা সেনদের মতো বাঙালিরা এক সময়ে এ তল্লাটে বাড়ি করেছিলেন। তাঁদের বেশিরভাগই এখন সম্পত্তি বেচে পাততাড়ি গুটিয়েছেন, কিংবা আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন। গত বছর দশেকে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে কয়েকটি দুষ্কৃতী হামলার ঘটনাও ঘটেছে। টালিগঞ্জের একটি শ্যুটিংপার্টির উপরেও লুঠের ঘটনা ঘটেছিল।

এই পটভূমিতে মৃতপ্রায় জনপদটির আশা-ভরসা এখন দু’টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। ডন বস্কো অ্যাকাডেমি ও জ্যানেট অ্যাকাডেমি। ১২০০ ছাত্রছাত্রীর জন্য ৫০টির মতো হস্টেল গড়ে উঠেছে। স্কুলপড়ুয়াদের জন্য হস্টেল গড়েই কার্যত দিন গুজরান করছেন এখনও টিকে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।

‘‘স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগই রাঁচি-জামশেদপুর-বোকারো-ধানবাদ-পটনা-আসানসোল থেকে পড়তে আসে। বাড়ি থেকে কী করে যাতায়াত করবে ওরা? তাই এত হস্টেল গজিয়ে উঠেছে’’— বলছিলেন হস্টেল মালিক সন্দীপ কুমার। সন্দীপের মা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এই জনপদেই ওঁর জন্ম। বাবা উত্তর ভারতের মানুষ। মা-বাবা এই তল্লাট ছেড়ে দিল্লি চলে গেলেও দু’দশক আগে সন্দীপ এখানেই আবার ফিরে এসেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আশপাশে কোনও বড় শিল্প বা চাকরির সুযোগ নেই। হস্টেলগুলো আছে বলেই এখানকার পুরনো লোকেদের এখনও রুটিরুজি জুটছে।’’

ডিসেম্বরের কনকনে বিকেলে উঠোনের মরা রোদে বসেছিলেন আর এক হস্টেল মালিক নোয়েল গর্ডন। হস্টেলের সঙ্গে তাঁর অতিথিশালাও রয়েছে। বললেন, ‘‘অতিথিশালায় সব সময়ে লোক থাকে না। কিন্তু হস্টেলগুলোয় থাকার জন্য পড়ুয়াদের অভাব নেই।’’ গর্ডনের কথায়, ‘‘আমাদের ছেলেমেয়েরা তো কেউ কাছে থাকে না। হস্টেলের ছেলেমেয়েগুলোকে দেখলে নিজের বাচ্চাদের ছোটবেলা মনে পড়ে যায়।’’

বড়দিনের ছুটি কাটিয়ে নতুন বছরের শুরুতেই ফিরবে পড়ুয়ার দল। তখনই আর এক প্রস্ত ‘বড়দিন’ হবে এখানে। হবে কেক কাটা। গর্ডন-সন্দীপেরা জানেন, পুরনো দিনগুলো আর ফিরবে না। কিন্তু স্কুলের কিশোর-কিশোরীরা ফিরে এলে খানিকটা উষ্ণতার ছোঁয়াচ লাগবে শীতঘুমে ঢাকা এই পল্লিতে। সন্দীপের কথায়, ‘‘ওরা ফিরে এলেই আমাদের আসল বড়দিন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

maclaxiganj aryabhatta khan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE