যে সব ‘দাগি’ স্কুল শিক্ষক ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, রাজ্য প্রশাসন ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের সেই নয়নের মণি বা ‘ব্লু আয়েড বয়’-দের ফের চাকরিতে ঢোকানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে সুপ্রিম কোর্ট তোপ দাগল। রাজ্য সরকার ও এসএসসি-কে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করে আজ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ বলেছে, রাজ্য প্রশাসন ‘বারংবার’ নিজেদের ‘দাগি’ প্রার্থীদের নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘চোরাপাচার’ করে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। একে ‘লজ্জাজনক’ ও ‘ট্রুলি শকিং’ বা আশ্চর্যজনক আখ্যা দিয়ে আজ বিচারপতি সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘‘এ নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভাল।’’ দাগিদের নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সুযোগ করে দিতে এসএসসি ও রাজ্য প্রশাসন কলকাতা হাই কোর্টে গিয়েছিল। তা শুনে বিচারপতি সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘‘এ নিয়ে হাই কোর্টে গিয়েছিলেন? এতে রাজ্য প্রশাসনের সততা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।’’
সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬-র এসএসসি-র নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছিল বলে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াই খারিজ করে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারীর চাকরি বাতিল করে দিয়েছিল। যাঁরা দাগি নন, তাঁদের ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত চাকরি করা ও বয়সের ছাড়-সহ নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্কুল সার্ভিস কমিশন নতুন নিয়োগের জন্য যে বিধি তৈরি করেছে, তাতে বলা হয়েছে, যোগ্যতার ক্ষেত্রে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তরে ৫০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। ২০১৬ সালের নিয়োগের সময় এই যোগ্যতার মাপকাঠি ৪৫ শতাংশ ছিল। ফলে অনেক নির্দোষ চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকা নতুন নিয়োগে অংশ নিতে পারবেন না। এ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল।
বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, কেন একাংশ নির্দোষ চাকরিহারাদের বাদ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে? এসএসসি-র আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা দ্বিবেদী বলেন, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব টিচার্স এডুকেশন-এর এখন যোগ্যতামান হল স্নাতক, স্নাতকোত্তরে ৫০% পেতে হবে। বিচারপতি কুমার বলেন, এ কথা আগে বলা হয়নি কেন? নির্দোষ চাকরিহারা শিক্ষকদের জন্য সুপ্রিম কোর্ট সুরাহার বন্দোবস্ত করেছিল। কারণ, গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল হয়েছে। তাঁরা দায়ী নন। তাই বয়সের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন কেন নতুন মাপকাঠি ঠিক করা হচ্ছে? বিচারপতি কুমার বলেন, ‘‘এঁদের বাদ দেওয়া হচ্ছে, যাতে আপনারা নিজেদের লোকদের, নিজেদের নয়নের মণিদের ঢোকাতে পারেন।’’
সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, যে সব নির্দোষ চাকরিহারা শিক্ষককে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। সেখানে ৫০ শতাংশ নম্বরের নতুন মাপকাঠি প্রযোজ্য হবে না। তাঁদের আবেদন করার জন্য সময়সীমা দশ দিন বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রয়োজন মতো পিছিয়ে দেওয়া হবে। রাজ্যের শিক্ষা দফতর সূত্রের বক্তব্য, সকলেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আবেদন করে ফর্ম জমা দিতে পেরেছেন। সকলকেই পরীক্ষার ‘প্রভিশনাল’ অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হচ্ছে। দফতর সূত্রে আরও বলা হয়েছে, যদি কেউ বাদ পড়ে থাকে, তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে তাঁদের দশ দিন সময় দেওয়া হবে। পরীক্ষা পিছনো হবে কি না, সে বিষয়ে দফতরের যুক্তি, পরীক্ষা ৭ ও ১৪ সেপ্টেম্বরের থেকে পিছতে হলে পুজোর ছুটি চলে আসবে। ছুটির পরে পরীক্ষা হলে নিয়োগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা (৩১ ডিসেম্বর) রাখায় সমস্যা হতে পারে।
যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকদের হয়ে আজ আইনজীবী শ্রীধর পোটারাজু আর্জি জানান, তাঁরা কাজের চাপে ব্যস্ত। কারণ স্কুলগুলিতে কর্মীর অভাব। দুর্গাপুজোর সময় প্রায় এক মাস ছুটি থাকে। তার পরে পরীক্ষা হলে ভাল। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য কিছু বলেনি। ৩১ অক্টোবর পরবর্তী শুনানি।
শ্রীধর অভিযোগ তোলেন, রাজ্য প্রশাসন দাগিদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ফেরত আনার চেষ্টা করছে। এ জন্য রাজ্য প্রথমে কলকাতা হাই কোর্টের এক বিচারপতির বেঞ্চে, পরে ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছিল। বিচারপতি সঞ্জয় কুমার তা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘‘রাজ্য প্রশাসন বার বার, বার বার এই চেষ্টা করছে। এ তো লজ্জাজনক।’’ রাজ্যের আইনজীবী কুণাল মিমানি বলেন, হাই কোর্টের পর্ব শেষ। বিচারপতি কুমার বলেন, ‘‘কিন্তু এতে রাজ্যের মনোবাঞ্ছা খোলসা হয়ে গিয়েছে।’’ হাই কোর্ট এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিল, তা-ও যথোচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেন বিচারপতি কুমার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)