মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মমতা ঠাকুর
রেল ভবনের দোতলায় ২৫৬ নম্বর ঘরে তখন ফাইলে ডুবে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন ব্যক্তিগত সচিব সঞ্জীব কুমার।
‘‘স্যার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতর থেকে ফোন এসেছিল। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। রেল ভবনে তাঁকে আসার জন্য সময় দিয়েছি।’’— সচিবের কথা শুনে সচকিত হয়ে পড়লেন ‘সাধাসিধে’ রেলমন্ত্রী। পরনে সুতির ফুল শার্ট। বেল্টহীন ঢোলা ট্রাউজার। জামার অর্ধেকটা আগোছালো ভাবে বাইরে বেরিয়ে। উসকো-খুসকো চুল। প্রভু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘‘আর কত দিন হেড ক্লার্ক হয়ে থাকবেন? মমতা একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তাঁর। তা ছাড়া তিনি প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। আর তিনি কি না আসবেন রেল ভবনে রেলমন্ত্রীর ঘরে!’’ তৎক্ষণাৎ রেলমন্ত্রীর ফরমান, ‘‘ওঁকে আমার বাড়িতে আসতে বলুন। মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানান।’’
কাঁচুমাচু হয়ে সঞ্জীব কুমার ফিরে গেলেন রেলমন্ত্রীর ঘরের উল্টো দিকে সচিবের ছোট কামরায়। তৃণমূল নেত্রীর যে ‘দফতর’ থেকে ফোন এসেছিল সেখানে জানানো হল, ‘মমতাজি’কে রেলমন্ত্রী তাঁর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নিজের স্ত্রী উমাকেও সে দিন মধ্যাহ্নভোজে থাকতে বলে দিলেন প্রভু। উমাদেবী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত। এর আগে এক বার মমতা যখন প্রভুর বাসভবনে গিয়েছিলেন, তখনই উমার সঙ্গে তাঁর ভাব হয়ে যায়। সে সময়ে শ্রীমতী প্রভুর আপ্যায়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন মমতা।
অবশেষে এল সেই মধ্যাহ্নভোজের দিন। প্রভু তাঁর ১২ নম্বর আকবর রোডের বাড়িতে প্রতীক্ষায়। পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার আর ডি মীনার দফতরে ফোন করে রেলমন্ত্রীর সচিব জানতে চাইলেন, ‘‘ম্যাডাম আসছেন তো?’’ আকাশ থেকে পড়লেন রেসিডেন্ট কমিশনার। বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী? তিনি তো দিল্লিতেই নেই! তিনি আসবেন কী করে?’’
শুনে হতবাক রেল মন্ত্রক। তৎক্ষণাৎ খবর দেওয়া হল রেলমন্ত্রীকে। ব্যস্ত পাইক-পেয়াদারা। খোঁজ খোঁজ। একটু পরে কাঁচুমাচু মুখে সচিব সঞ্জীব কুমার মাথা নিচু করে এসে প্রভুকে জানালেন, মিসটেক! মিসটেক! ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, মমতা ঠাকুর। উনি তৃণমূলেরই এক সাংসদ। অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রী নন!’’
রেলমন্ত্রী এ বার দ্বিগুণ রুষ্ট। বললেন, ‘‘এত বড় ভুল করলেন কী করে!’’ সঞ্জীব বললেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন তপন রায় বলে তাঁর এক ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। আর এই তৃণমূল সাংসদেরও ব্যক্তিগত সচিবের নাম তপন রায়। তাই এই তপন রায় ফোন করায় আমি ভেবেছিলাম মুখ্যমন্ত্রীই আসছেন।’’
প্রভুর দফতর থেকে মমতা ঠাকুরকে পত্রপাঠ জানানো হল, মধ্যাহ্নভোজ বাতিল। একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তিনি মাননীয় সাংসদ। তাই তাঁকেও সময় দেওয়া হবে। তবে বাসভবনে নয়, রেল ভবনে, মন্ত্রীর ঘরে।
এ ঘটনা কিছু দিন আগের। তবে এই সাক্ষাতের কিছু দিনের মধ্যেই সঞ্জীব কুমার বিদায় নেন রেল মন্ত্রক থেকে। আমলাদের নির্ধারিত প্রশিক্ষণে চলে যান তিনি। রেল মন্ত্রক সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, ওই ঘটনার জেরেই যে সচিবকে বদলি করা হয়েছে— এমন বলাটা অতি সরলীকরণ হবে। তবে এ কথাও ঠিক, প্রভু আর সচিব হিসেবে সঞ্জীবকে চাইছিলেন না। এর পরে আশিস মোরে নামে রেলমন্ত্রীর যে সচিব এসেছিলেন, তিনিও সামান্য ক’দিন কাজ করে প্রভুর সুপারিশেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চলে গিয়েছেন। সেখানে তিনি দুই মন্ত্রকের মধ্যে সমম্বয়ের কাজ করছেন। সচিব পদে এখনও কারও নাম চূড়ান্ত হয়নি।
তৃণমূল সূত্র অবশ্য বলছে, সামান্য ঘটনা। এমন ভুল হতেই পারে। বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘আমার নাম আর মুখ্যমন্ত্রীর নাম এবং আমাদের ব্যক্তিগত সচিবদের নাম এক হয়ে যাওয়ায় এই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সে দিনের মধ্যাহ্নভোজ বাতিল হলেও, পরে আমি রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি।’’ সাংসদ মমতা জানান, হরি ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওই অনুষ্ঠানে গোটা দেশ থেকে ভক্তরা আসেন। তাঁদের যাতায়াতে যাতে অসুবিধা না হয়, সে বিষয়টিও রেলমন্ত্রীকে দেখতে বলেছেন।
তবে সাংসদ যা-ই বলুন, এই ভ্রান্তিবিলাস নিয়ে এখনও হাসাহাসি চলছে রেল মন্ত্রকের আর্দালি মহলে। কেউ কেউ যাকে বলছেন— ‘দুই মমতার গল্প’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy