Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সরানো দরকার বুঝেও দোলাচল

সুষমা-বসুন্ধরাকে বহন করে চলা, নাকি ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলা— উচিত কাজ কোনটা, সেই রাজনৈতিক অঙ্ক কষতে গিয়েই আপাতত দিশাহারা বিজেপি! আর এই দোলাচলের মধ্যে আজ দিল্লি ঘুরে গেলেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

সুষমা-বসুন্ধরাকে বহন করে চলা, নাকি ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলা— উচিত কাজ কোনটা, সেই রাজনৈতিক অঙ্ক কষতে গিয়েই আপাতত দিশাহারা বিজেপি!

আর এই দোলাচলের মধ্যে আজ দিল্লি ঘুরে গেলেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী। তবে নীতি আয়োগের বৈঠক সেরেই বিদায় নিলেন। দেখা করলেন না প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপি সভাপতি কারও সঙ্গেই। যা আবার নতুন জল্পনার জন্ম দিয়েছে বিজেপির অন্দরে।

দলের একটা বড় অংশ মনে করেন, সুষমা স্বরাজ ও বসুন্ধরা রাজে দু’জনেই দুর্নীতিগ্রস্ত। অতএব তাঁদের এক মুহূর্ত গদিতে রাখা উচিত নয়। কারণ, যত দিন যাবে ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে দল এবং নরেন্দ্র মোদী সরকারের ভাবমূর্তি। কিন্তু এখনই তাঁদের সরিয়ে দেওয়াটা আখেরে ভাল হবে না খারাপ, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। দলীয় নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, এর কারণ অভিজ্ঞতার অভাব। সংগঠনের হাল এখন যাঁদের হাতে, জাতীয় রাজনীতিতে তাঁরা তুলনামূলক ভাবে নবাগত। ফলে সঙ্কটের মুখে খানিকটা দোলাচলে পড়ে গিয়েছেন তাঁরা।

দোলাচল কেন? বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে প্রথম প্রশ্ন হল, ললিত-বিতর্কের প্রভাব মোদী সরকারের উপরে কতটা পড়বে? এটা মোটের উপর স্পষ্ট যে, সুষমা ও বসুন্ধরার ইস্তফার দাবি নিয়ে সংসদের বাদল অধিবেশনে সরব হবে বিরোধীরা। তারা হয়তো অধিবেশন চলতে দেবে না। ফলে জমি অধ্যাদেশ-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশের প্রক্রিয়া ধাক্কা খাবে। কিন্তু দুই নেত্রীকে বিদায় করলেই কি পরিস্থিতি শান্ত হবে? অনেকের মতে, বিরোধীরা তখন আরও গলা চড়িয়ে সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করবে। এই ক’দিন আগে সরকারের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে বিজেপির প্রচারের মূল সুর ছিল, এনডিএ সরকার ইউপিএ সরকারের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। কিন্তু সুষমা-বসুন্ধরাকে সরালে এটা মেনে নেওয়া হবে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।

বিজেপি সূত্র বলছে, বিশ্ব যোগ দিবসের উপর থেকে প্রচারের আলো যাতে সরে না যায়, সে জন্য গোড়ায় সুষমা-বসুন্ধরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি মোদী। কিন্তু অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পরে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত এক প্রকার পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি পিছিয়ে আসেন। তখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মনে হয়েছিল, বিরোধীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করার চেয়ে হিম্মত দেখিয়ে, আইনের যুক্তি দেখিয়ে পাল্টা প্রচার করাই শ্রেয়। কিন্তু তার পর সপ্তাহ ঘুরতে না-ঘুরতেই বসুন্ধরা-পুত্র দুষ্মন্তের সঙ্গে ললিত মোদীর আর্থিক লেনদেনের নতুন তথ্য সামনে এসেছে। পর্দার আড়ালে আরও কিছু আছে কি না, বুঝে উঠতে পারছেন না বিজেপি নেতারা। তাঁদের আশঙ্কা, আজ এক কথা বলে কালই না ফের সেটা গিলতে হয়। অনেকের মতে, মোদীর নীরবতার কারণ সেটাই।

কিন্তু নীরব থাকলে যে সমস্যা মিটবে না, সেটা বিজেপি নেতৃত্ব বিলক্ষণ বুঝছেন। এটাও বুঝছেন যে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের তলার

মাটিই সবচেয়ে বেশি টলমলে। তবে বসুন্ধরাকে সরালে তিনি কতটা ফোঁস করতে পারেন, সেটাও ভাবনা। কারণ, বসুন্ধরা ইতিমধ্যেই রাজ্য নেতৃত্বকে হুমকি দিয়ে রেখেছেন, তাঁকে সরানো হলে তিনি ১১০ জন বিধায়ক নিয়ে দল ছাড়বেন। রাজস্থানে বিধায়ক সংখ্যা ২০০। ফলে বসুন্ধরার পিছনে যদি সত্যিই ১১০ জন বিধায়ক থাকেন, তা হলে তাঁর সরকার গড়তেও সমস্যা হবে না। যদিও দলের একটা বড় অংশের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসুন্ধরা পাল্টা সরকার গড়ে ফেলবেন, এতটা খারাপ অবস্থা প্রধানমন্ত্রীর এখনও হয়নি। রাজ্য বিজেপির বসুন্ধরা-বিরোধী এক নেতার কথায় ‘‘রাজস্থানে নরেন্দ্র মোদীই একমাত্র ফ্যাক্টর। বসুন্ধরা ভয় দেখাচ্ছেন। ওই ভয়ের কাছে নতিস্বীকার করলে দলের ক্ষতি।’’

কিন্তু ঘটনা হল, ভয় জয় করার শক্তি এখনও দেখিয়ে উঠতে পারেননি বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই কারণে প্রকাশ্যে এখনও সুষমা-বসুন্ধরার পাশেই দাঁড়াচ্ছেন দলীয় মুখপাত্ররা। সম্বিত পাত্র ও শ্রীকান্ত শর্মা আজ বলেন, ‘‘দল রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষেই আছে। তিনি যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থান শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। প্রথম যুক্তি, তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ললিত মোদীর অভিবাসনের জন্য কোনও আবেদনপত্র পাঠাননি। ললিতের

স্ত্রী মিনাল বসুন্ধরার পুরনো বন্ধু। ২০১১ সালে মিনালের জন্য তিনি একটি বিবৃতিতে সই করেছিলেন। কিন্তু ললিত মোদীকে নিয়ে নানা আইনি বিতর্ক শুরু হয়ে যাওয়ার পরে ২০১৩ সালে একটি ই-মেল পাঠিয়ে গোটা প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।’’

সম্প্রতি নিতিন গডকড়ী যখন জয়পুরে গিয়েছিলেন, তখন বসুন্ধরা তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনে যে সব যুক্তি দিয়েছেন তা নিয়ে মোদী এবং অমিত শাহের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বসুন্ধরা দলকে বলেছেন, ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী সে দেশের আদালতে একমাত্র হলফনামাই গ্রাহ্য হয়। কিন্তু বসুন্ধরা কোনও হলফনামা দেননি, শুধু সাদা কাগজে সই করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের ক্ষেত্রে সাক্ষী হিসেবে সেই ব্যক্তিকে সশরীরে ব্রিটিশ অভিবাসন দফতরের সামনে উপস্থিত থাকতে হয়। বসুন্ধরা তা করেননি। তৃতীয়ত, সাক্ষী হলে বিবৃতির সমস্ত পাতায় বসুন্ধরার সই থাকার কথা। কিন্তু তিনি কেবল শেষ পাতায় সই করেছিলেন। ফলে সেই বিবৃতি ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়।

কিন্তু আইনি যুক্তির বাইরে গোটা ঘটনা ঘিরে নৈতিকতার প্রশ্ন যে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, সেটা জেটলি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর। প্রকাশ্যে এ পর্যন্ত যা-ই বলে থাকুন, দলের অন্দরে দুই নেত্রীর দুর্নীতি নিয়ে সব চেয়ে সরব জেটলিই। তাঁর মতে, সুষমা-বসুন্ধরা ইস্তফা না-দিলে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি আরও কালিমালিপ্ত হবে। বিশেষ করে তদন্তে যখন পাওয়া গিয়েছে যে, দুষ্মন্তের হোটেলের ৩২৮০টি শেয়ার রয়েছে বসুন্ধরার হাতে। এই সংস্থাকে দু’দফায় প্রায় ১০ কোটি ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি ১১ কোটি টাকার শেয়ারও কিনেছিলেন ললিত। এই আর্থিক প্রশ্ন জুড়ে যাওয়ার পরে আর মানবিকতার তত্ত্ব খাড়া করা কঠিন।

সঙ্ঘ পরিবারও সুষমা-বসুন্ধরাকে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু তারাও প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বিজেপি সভাপতিকে বলেছেন, প্রকাশ্যে মতামত জানিয়ে সংসদ অধিবেশনের আগে সরকারকে বিব্রত করতে চান না তাঁরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উচিত নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্যই যথাসময়ে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া। সেই সময়টা কখন আসবে, সেটাই প্রশ্ন। মোদীর ঘনিষ্ঠ মহল দাবি করছে, অন্যের দুর্নীতির জন্য নিজের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হতে দেবেন না প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিজের সময়সূচি মেনে চলছেন। যাতে এটা মনে না হয় যে, তিনি চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেন। ছোটোখাটো শল্য চিকিৎসা না করে মোদী হয়তো সরকার ও দলে বড় ধরনের রদবদলের পথে যেতে পারেন। আগামিকাল রেডিওতে ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে হাজির হবেন মোদী। বিজেপির একাংশ মনে করছে, সেখানে কোনও বার্তা দিতে পারেন তিনি।

পাশাপাশি, ইস্তফা প্রাপ্তিতেই বিরোধীরা সন্তুষ্ট হবে, নাকি রক্তের স্বাদ পেয়ে তারা আরও আগ্রাসী হবে, সেটা বোঝারও চেষ্টা চলছে। কংগ্রেস সুষ্ঠু ভাবে সংসদ চালাতে দেবে কি না, তা বোঝার জন্য সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু। মাঠে-ময়দানে প্রচারের কৌশল নিয়েও ভাবনা চলছে।

কিন্তু সব মিলিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের দোলাচল এখনও কাটেনি। আজ বসুন্ধরাকে দিল্লি আসতে বলা উচিত হবে কি না, তা নিয়েও দোলাচলে ছিলেন তাঁরা। একটা মত ছিল নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করুন বসুন্ধরা। তাঁর যা বলার আছে বলুন। অন্য অংশের বক্তব্য ছিল, বসুন্ধরার দিল্লি আসারই দরকার নেই। গত কাল রাতে জেটলিকে ফোন করে বসুন্ধরা জানতে চেয়েছিলেন তাঁর কী করা উচিত। জেটলি তাঁকে বলেন, সফর বাতিল করা উচিত নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ, দেখা করলে রটনা হবে যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ইস্তফা দিতে বলছেন। এবং সে জন্যই তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। আর একেবারেই না এলে মনে হবে, ভয়ে তিনি দিল্লি এলেন না। সুতরাং বসুন্ধরা দিল্লি এলেন এবং ‘সাহস’ দেখালেন। কিন্তু সাহসী হতে পারছেন না বিজেপি নেতৃত্ব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE