E-Paper

কথা রাখেননি নীতীশ, মরেনি রফিগঞ্জের ‘ভূত’

রফিগঞ্জ স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে ৩০০ ফুটের একটা সেতু। নীচের ধাওয়া নদী এখন প্রায় শুকনো। দূরে দূরে এক খাবলা গর্তে একটু করে জল। সেতুর গায়ে লাগানো পায়ে-চলার লোহার পাতে ছেলে-ছোকরাদের দঙ্গল। একটু দূরে আব্দুলপুর।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:১১
রফিগঞ্জের ধাওয়া সেতু। তেইশ বছর আগে রাজধানী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়েছিল যেখানে। পাশে চলছে নতুন লাইন পাতার কাজ।

রফিগঞ্জের ধাওয়া সেতু। তেইশ বছর আগে রাজধানী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়েছিল যেখানে। পাশে চলছে নতুন লাইন পাতার কাজ। — নিজস্ব চিত্র।

ডাকবাংলোর ও’পারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে নামিয়ে দিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে চপার। জেডিইউ প্রার্থী প্রমোদ কুমার সিংহের সমর্থনে সভা চলছে তাঁর। স্টেশনের রাস্তা ছেড়ে নদীর তট ধরে নেমে গেলে সামনে রেলের ব্রিজ। রেলের চাকা সেতুর উপরে গড়ালেই বিকট আওয়াজ দূর থেকে পাওয়া যায়। আর তারই মাঝে মাঝে পড়ন্ত বিকেলেই ভেসে আসে শেয়ালের ডাক!

এই সেই রফিগঞ্জ! ওই সেই ধাওয়া নদীর সেতু! হাওড়া-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস ২৩ বছর আগের এক বৃষ্টিমুখর রাতে যে সেতু ভেঙে ধাওয়ার জলে পড়েছিল। সরকারি হিসেবে ১৩০টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল, নিখোঁজ ছিলেন অনেকে। বেসরকারি মতে, মৃতের সংখ্যা ছিল অন্তত ২০০। হাওড়া থেকে আসা সে ট্রেনে বাঙালি যাত্রীর সংখ্যা ছিল বিস্তর। ঘটনার সময়ে রেলমন্ত্রীর নাম? নীতীশ কুমার! দশম বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য যিনি একটু দূরে বক্তৃতা করছেন। সে সময়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর নাম? রাবড়ী দেবী। ছেলে তেজস্বী যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য যিনি এখন সপরিবার জান লড়িয়ে দিচ্ছেন।

রফিগঞ্জ স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে ৩০০ ফুটের একটা সেতু। নীচের ধাওয়া নদী এখন প্রায় শুকনো। দূরে দূরে এক খাবলা গর্তে একটু করে জল। সেতুর গায়ে লাগানো পায়ে-চলার লোহার পাতে ছেলে-ছোকরাদের দঙ্গল। একটু দূরে আব্দুলপুর। সেই অভিশপ্ত রাতে টর্চ, হ্যারিকেন হাতে যে গাঁয়ের লোকজন এগিয়ে এসেছিলেন প্রথম উদ্ধারের কাজে। এত বছর পরে কলকাতা থেকে কেউ এসে জং ধরা সেতুতে অতীতের পাতা ঘাঁটতে চাইছে শুনে ছোকরার দলই খবর পাঠাল আব্দুলপুরে। নীরজ কুমার এসে বললেন, ‘‘পাপ নিয়ে বেঁচে আছি বাবু! এতগুলো মানুষ ওই ভাবে বেঘারে মারা গিয়েছিল। নীতীশবাবু এসে বলেছিলেন, দোষী কাউকে ছাড়া হবে না। আমাদের বলা হয়েছিল, ফিস প্লেট খোলা ছিল। কিন্তু কারও শাস্তি তো হয়নি। পুলটা ( সেতু) ভেঙে গেল, রেলেরও তো গাফিলতি ছিল।’’ সে রাতে বৃষ্টির মধ্যে জলে পড়ে যাওয়া কামরা থেকে উদ্ধারের অভিযান কী দুঃসাধ্য ছিল, এখনও মনে আছে তাঁর। ‘‘মৃতদেহ উদ্ধারের অভিযান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আশেপাশে আমরা কাটা হাত-পা পেয়েছি। অভিশাপ আছে আমাদের এখানে। সন্ধের পরে এখানে কেউ আসে না।’’ সঙ্গে সংযোজন, ‘‘পুলটা যে সব আংটা দিয়ে আটকানো, দেখুন ওগুলো পুরনোই। এত বড় দুর্ঘটনার পরেও কারও হেলদোল হয়নি।’’

এখন অবশ্য নড়ে বসেছে সরকার। নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘অমৃত ভারত স্টেশন’ প্রকল্পের আওতায় রফিগঞ্জ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে ধাওয়া নদীর সেতুর উপরে পুরনো লাইনের পাশে নতুন লাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। নীরজের সঙ্গে আসা চন্দন কুমার বলছিলেন, ‘‘এখানে মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়। কয়েক বছর অন্তর সেপ্টেম্বরে দুর্ঘটনার দিন (রাজধানী-কাণ্ড ঘটেছিল যে দিন) স্থানীয় মানুষ এই সেতুর উপরে পুজো করেন। শাপ কাটাতে।’’ এখন তো নতুন লাইনের কাজ হচ্ছে? চন্দনের প্রশ্ন, ‘‘প্রতি বার ভোট এলে বলা হত, সেতুর কাজ হবে। মোদীজি’র সরকার এই সবে এটা শুরু করেছে। কিন্তু নীতীশবাবু কথা রাখলেন কই?’’

মনে পড়ছিল, ৪৫ কিলোমিটার দূরে এ পি কলোনিতে শুনে আসা সুনীল কুমার রাইয়ের কথা। গয়া শহরের ওই কলোনি ২২ বছর আগের এক নভেম্বরের সকালে ঘুম ভেঙে জেনেছিল ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্র দুবের খুন হয়ে যাওয়ার খবর। তদন্তের ভার পেয়ে সিবিআই যে ঘটনাকে লুটপাট, রাহাজানি আটকাতে গিয়ে খুন বলে রিপোর্ট দিয়েছিল। এত বছর পরে সে ঘটনার সুতো খুঁজতে যাওয়ায় শিক্ষক সুনীল বলেছিলেন, ‘‘দুর্নীতি আটকাতে এক জন সৎ অফিসার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিলেন। ঠিকাদার-মাফিয়ারা তাঁকে সরিয়ে দিল। সিবিআই বলল সাড়ে চার হাজার টাকা ছিনতাই আটকাতে গিয়ে নাকি মারা গিয়েছেন সত্যেন্দ্র! প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন, দোষীদের সাজা হবে। এ দেশে কেউ কথা রাখে না!’’ তাঁর আরও প্রশ্ন, ‘‘মোদীজি এখন যে বারবার বলছেন জঙ্গলরাজ আর ফিরতে দেবেন না, তা হলে ওই ঘটনার ফাইলটা আবার খোলাচ্ছেন না কেন? নীতীশবাবুও কিছু করেননি।’’

বিহার, উত্তরপ্রদেশে সড়ক যোগাযোগের ছবি বদলে দিয়েছে বাজপেয়ীর স্বপ্নের যে সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্প, তারই অধিকর্তা ছিলেন কানপুর আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আসা সত্যেন্দ্র। দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বদলি হয়েছিলেন। ভেজাল উপকরণ দিয়ে সড়ক তৈরি করায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা ফের তৈরি করিয়েছিলেন ঠিকাদারকে দিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি দিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে আর্জি জানিয়েছিলেন পরিচয় গোপন রাখার। সেই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অন্যান্য দফতরে পৌঁছয়, তার পরে ভোররাতে গয়া স্টেশনে নেমে রিকশা চেপে বাড়ি ফেরার পথে গুলিতে প্রাণ হারান সত্যেন্দ্র। সে রাতের রিকশাচালক প্রদীপ কুমার সিবিআই জেরার মুখোমুখি হওয়ার পরেই নিখোঁজ হয়ে যান! অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় মামলায় আরও দুই সাক্ষীর। শেষ পর্যন্ত খুন, রাহাজানির দায়ে ২০১০ সালে তিন জন দুষ্কৃতীর জেল হয়। সত্যেন্দ্রের ভাই ধনঞ্জয় দুবে এখন বিভিন্ন সংগঠনের ডাকে আলোচনায় গিয়ে বলেন, এক জন ‘হুইসল ব্লোয়ারে’র পরিচয় প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ‘লিক’ হল এবং সাধারণ ছিনতাই বলে মামলা গুটিয়ে দেওয়া হল! এত লড়েও বিচার মেলেনি, অনেক আশ্বাস দিয়েও কথা রাখেনি কেউ।

পুরনো ‘অভিশাপ’ বয়ে নিয়ে নিরীহ মানুষ যখন ভোটের পর ভোট পার করেন, কী বলেন নেতারা? রফিগঞ্জের প্রাক্তন বিধায়ক, জেডিইউ-এর অশোক কুমার সিংহের মতে, ‘‘পুরনো কথা তুলে কী লাভ! নীতীশজি’র সঙ্গে মিলেই তো মোদীজি কাজ করছেন।’’ আরজেডি নেতা রামচন্দ্র পুরবে-রও প্রশ্ন, ‘‘এত দিন পরে কবর খুঁড়ছেন কেন! খেয়েদেয়ে কাজ নেই?’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bihar Assembly Election 2025 Bihar

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy