দক্ষিণে রেলপথ। উত্তরে জাতীয় সড়ক। মাঝে ওড়িশার এক প্রত্যন্ত বাজারকে কেন্দ্র করে গ্রাম।
গত বছর ‘অখ্যাত’ সেই গ্রামকে চিনিয়েছিল এক রেল দুর্ঘটনা। অদূরে বাহানাগা হাই স্কুল রাতারাতি হয়ে উঠেছিল অস্থায়ী মর্গ। পরে গ্রামবাসীর দাবি মতো অ্যাসবেস্টসের ছাউনির সেই স্কুলবাড়ি ভেঙে ‘মডেল স্কুল’ গড়ছে ওড়িশা সরকার। রেল দুর্ঘটনার বছর পেরোনোর ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে সেই স্কুলেই হল ভোটের ‘মডেল বুথ’।
গত বছর ২ জুন সন্ধ্যায় ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় বাহানাগা বাজার স্টেশনের রেলগেটের কাছেই আপ করমণ্ডল ও ডাউন যশবন্তপুর এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়ে। মারা যান ২৯৩ জন। মর্গে জায়গা কম, তাই বাহানাগা হাই স্কুলের ক্লাসঘরেই দেহগুলি স্তূপ করে রাখা হয়। পর গ্রামবাসীরা দাবি তোলেন, ওই স্কুল ভেঙে দিতে হবে। সেই মতো পুরনো স্কুল ভবন ভেঙে বিজেডি সরকার ফাইভ-টি প্রকল্পে আড়াই কোটি টাকায় স্কুলের নতুন দোতলা ভবন করেছে। রেলমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বরাদ্দ ২ কোটি টাকায় বাহানাগা বাজার গ্রাম ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও হাল ফিরেছে।
আজ, ২ জুন বাহানাগা রেল দুর্ঘটনার বছর পূর্ণ হল। তার আগের দিন, শনিবার ভোট দিল বাহানাগা। ওড়িশায় এ বার একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট হচ্ছে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি এবং বিজু জনতা দল (বিজেডি)। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব বাহানাগায় রোড-শো করতে এসে স্থানীয়দের ‘রিয়েল হিরো’ বলেছিলেন। জনসভায় এসে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক সরকারের ফাইভ-টি সচিব ভিকে পান্ডিয়ানেরও বার্তা ছিল, “আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী প্রচারে বলছেন, বাহানাগা বাজার ওড়িশাকে গোটা দুনিয়ায় একটা নতুন পরিচয় দিয়েছে। এখানকার যুব সমাজ মনুষ্যত্ব কী জিনিস, সেটা গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে।”
ভদ্রক লোকসভার মধ্যে পড়ে বাহানাগা বাজার। বিধানসভা সোরো। ওই দুই আসনের জন্যই বাহানাগা হাই স্কুলের ‘আদর্শ ভোটগ্রহণ কেন্দ্র’ করেছিল নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনেও এখানে কোনও গোলমাল হয়নি। বালেশ্বরের জেলাশাসক তথা রিটার্নিং অফিসার আশিস ঠাকরে বলেন, “দুর্ঘটনার পরে যে স্কুলভবনে দেহ রাখা হয়েছিল, সেটা ভেঙে মডেল স্কুল করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নতুন দোতলা ভবন হয়েছে। সেখানেই ‘মডেল পোলিং স্টেশন’ করেছি।”
তবে অনেক দাবিই এখনও পূরণ হয়নি। বাহানাগা বাজারের ব্যবসায়ী আদিত্য নায়েক বলেন, “স্কুলভবন, হাসপাতাল, পথঘাটের কাজ কিছুটা হয়েছে গত এক বছরে। তবে স্টেশনে রাস্তা, পথবাতি, রেলগেটে উড়ালপুল-সহ অনেক কাজ বাকি।” বাহানাগা হাই স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক পদ্মলোচন মালিকও বলছেন, “আমাদের স্কুল কিন্তু এখনও মডেলের পর্যায়ে পৌঁছয়নি। দোতলা ভবনে আমাদের ৮টি ক্লাসঘর হয়েছে। আরও ৪টি ক্লাসঘর ও অফিসঘর প্রয়োজন। তবে নির্বাচন কমিশন আমাদের স্কুলটি ভোটের মডেল ভোটগ্রহণ কেন্দ্র করায় খুব ভাল লাগছে।”
সোরো বিধানসভার নির্দল (বিক্ষুব্ধ বিজেপি) প্রার্থী রাকেশ মালিক বলছিলেন, “বাহানাগা রেল দুর্ঘটনা নিয়ে কোনও দলই রাজনীতি করতে চায়নি। কারণ কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট সচেষ্ট ছিল।’’ তবে দুর্ঘটনার সময় বাহানাগায় না এসে সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়া বিজেডি বিধায়ক দলবদলে এখন বিজেপি প্রার্থী হওয়ায় তা প্রচারে এসেছে।
বাহানাগাবাসী চান, কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারের সমন্বয়ে উন্নয়ন হোক। বাহানাগা হাই স্কুলে ভোট দিতে আসা ওড়িশি নৃত্য শিক্ষিকা অন্নপূর্ণা লেঙ্কা বলছিলেন, “আমার বাড়ি দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই। ওই দিন আমরা সাধ্যমতো মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।’’ তিনি আশা রাখেন, আগামী দিনে উন্নয়নের পথে আরও অনেকটা এগোবে বাহানাগা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)