‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ হাতে লেখক।
বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরনোর সুযোগ মেলেনি কোনও দিন। কিন্তু দেশের হেন নামী বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে তিনি বক্তব্য রাখেননি বা তাঁর জীবন আর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়নি। এ বার আরও এক বড় সাহিত্যসম্মান পেতে চলেছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। এ বছরের জয়পুর সাহিত্য উৎসবে তিনি অন্যতম বক্তা।
বিশ্বখ্যাত এই আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে অতীতে অংশ নিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, তসলিমা নাসরিনের মতো বাঙালি সাহিত্যিকরা। এ বছর পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানে বক্তাদের তালিকায় নানান দেশের নোবেল, বুকার, পুলিত্জার জয়ী লেখকদের পাশে রয়েছে হামিদ কারজাই, মহম্মদ ইউনুস, বীর সাংভি, জাকির হুসেন, অনুরাগ কাশ্যপের মতো নামও। রয়েছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারীও। বাংলা দলিত সাহিত্যের এই মুখ এক দিন বলবেন বাবাসাহেব অম্বেডকরের উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে। আর এক দিন মনোরঞ্জন ব্যাপারীর জীবন, সাহিত্য, দলিতসমাজ এবং সার্বিক সমাজভাবনা তাঁর মুখ থেকেই শুনবেন দেশবিদেশের শ্রোতারা। এই অনুষ্ঠানটি হবে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক।
বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখা একেবারেই অনন্য এক অভিজ্ঞতা। তার প্রধান কারণ, বাংলা সাহিত্যসমাজের যে চেনা বৃত্ত, মনোরঞ্জন তার একেবারে বাইরের লোক। তিনি মুটে-মজুরি করেছেন, ছাগল চরিয়েছেন, দীর্ঘ সময় যাদবপুর অঞ্চলে রিক্সা চালিয়েছেন, চায়ের দোকানে টেবিল বয়ের কাজ করেছেন, মেথরের কাজ করেছেন, ছত্তিসগঢ়ের জঙ্গলে দিনের পর দিন কাঠ কেটে সাইকেলে চাপিয়ে গ্রামে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছেন, চাকরি করেছেন নাইট গার্ডের। এবং আজও, বুড়ো বয়সে, অশক্ত শরীরেও দু’বেলা দেড়শো-দেড়শো তিনশো জনের রান্না করেন প্রতি দিন। পেট চালাতে, সংসার চালাতে।
অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে বক্তা মনোরঞ্জন।
এমন মানুষরা রয়েছেন আমাদের চার পাশ জুড়েই। অগুনতি। কিন্তু এমন মানুষেরা তো লেখেন না। লেখেন না, কারণ এঁরা কেউই প্রায় লিখতে শেখেন না। কোনও রকমে অক্ষর জ্ঞান হলেও, তা ভুলে যান দ্রুতই। জীবনযুদ্ধের অসম লড়াইতে এঁরা বাঁধা পড়ে থাকেন আমৃত্যু। রোজ হাড় ভাঙা পরিশ্রম, নয়তো না খেয়ে মৃত্যু। রোজ অমানুষিক পরিশ্রম, এবং সেই জন্য মৃত্যু। এই এঁদের জীবন। তার সঙ্গে তো তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের অবজ্ঞা, তুইতোকারি, ছোটলোক জ্ঞান আছেই। আমাদেরই এই সমাজ সেই কোন কাল থেকে এই দলিত মানুষদের জীবন এ ভাবেই বেঁধে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: জয়শঙ্করকে নয়া দায়িত্বে আনার চিন্তা
মনোরঞ্জনের সৌভাগ্য, যৌবন তাঁকে জেল খাটিয়েছিল। আর সেই জেলখানাই হয়ে গেল হাতেখড়ির স্কুল। ওখানেই এক শিক্ষিত কয়েদি তাঁকে মাটিতে দাগ দিয়ে অক্ষর পরিচয় করান। মোড় ঘুরে যায় জীবনের। জেল থেকে বেরিয়ে জন্ম হয় পাঠক মনোরঞ্জনের। এবং তার পর লেখক মনোরঞ্জনের।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে সেমিনারে।
আটের দশকের গোড়ায় রিক্সাচালক মনোরঞ্জনের (তখন মদন দত্ত) সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় সওয়ারি মহাশ্বেতা দেবীর। তাঁর উত্সাহেই লেখা শুরু। এই যে লিখতে শুরু করলেন, বাংলার সিরিয়াস পাঠক সমাজে জায়গা পেয়ে গেলেন দ্রুত। গল্প, উপন্যাস তাঁকে বানাতে হয়নি। কারণটা নিজেই বলেছেন মনোরঞ্জন। নিজের জীবনের এক একটা অংশই তো তাঁর এক একটা গল্প হয়ে উঠেছে। উঠে এসেছে উপন্যাসের একের পর এক চরিত্র। কিন্তু পাঠক সমাদরে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল তাঁর আত্মজীবনী ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ প্রকাশের পর।
আরও পড়ুন: হাতে-গরম চিকিৎসক: চিত্রশিল্পী হঠাৎ করেই যেন নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায়!
এ বই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা মোড় হয়ে থাকবে অবশ্যই। বাংলা বইয়ের লেখক এবং পাঠক— দু’ক্ষেত্রেই তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দেরই রাজত্ব। সেখানে মনোরঞ্জনের মতো দলিত মানুষদের জীবনের কথাও আসে বটে। কিন্তু তা দেখা উচ্চবর্ণীয় পরিবেশে গড়ে ওঠা চোখ দিয়েই। কিন্তু ওঁরা নিজেরা কলম ধরলে কী হয়, তা মনোরঞ্জনের মতো নগ্ন লেখা না পড়লে জানা যেত না। কোথাও কিছু লুকোছাপা নেই। ওই ‘অশিক্ষিত’, নিরক্ষর, ‘নিচুতলা’র মানুষরা আমাদের সমাজ, তাঁদের জীবন নিয়ে ভাবলে— তার প্রকাশভঙ্গি, ভাষা কিম্বা দর্শন আমাদের সাহিত্যের চেনা গণ্ডির একদম বাইরে হয়। সেই কারণেই ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ চমকে দেয়। ঘেঁটে দেয়। তার পর ঘোর কাটলে মনে হয়, সত্যিই তো, এই মানুষরা তো আমাদের সঙ্গেই থাকেন। তবুও থাকেন অনেকটা দূরে।
এ হেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী এ বছর জয়পুর সাহিত্য উৎসবের মঞ্চে উঠছেন। ২৫-২৯ জানুয়ারি হবে এই উৎসব। ২৫ তারিখ নিজের দলিত জীবন, নিজের লেখক জীবন নিয়ে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে সাহিত্য অনুবাদক এবং সমালোচক অরুণাভ সিনহার। এই আদানপ্রদানে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সঙ্গে থাকবেন আদিবাসী লেখক হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখরও। ইনি ঝাড়খণ্ড সরকারের একজন মেডিক্যাল অফিসারও বটে।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রীদের সঙ্গে।
রাঁধুনির চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে জয়পুর যাচ্ছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। দক্ষিণ কলকাতার মুকুন্দপুরে হেলেন কেলার বধির বিদ্যালয়ে সপ্তাহে ছ’দিন দু’বেলা রান্নার কাজ করেন তিনি। শ-দেড়েক করে পাত পড়ে দু’বেলাই। এটাই তাঁর চাকরি। আবাসিক এই স্কুলটি রাজ্য সরকারের জনশিক্ষা দফতরের অধীনে। সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে স্কুলে যান। রান্না সেরে বেরোতে বেরোতে বেলা ১১টা-সাড়ে ১১টা। রবিবার অনেক সময় দুপুরও গড়িয়ে যায়। সন্ধেতে আবার সেই একই রকম সময়ের ডিউটি। এই রান্নাবান্নার কাজে তাঁকে সাহায্য করার মতো একজনই হেল্পার আছেন।
এই ডিউটি সামলে লেখেন কখন? হেসে ফেললেন মনোরঞ্জন। বড় কষ্টের সে হাসি। “বুঝতেই পারছেন কী ভাবে লিখি। আগে, কম বয়সে অনেক পরিশ্রমের পরও লিখে যেতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। হাঁটুর দোষ অনেক দিন ধরে। একটা হাঁটু অপারেশন হয়েছে। আরও একটা হবে। শরীরে আরও নানান রকমের সমস্যা। এই পরিশ্রম সইতে পারছি না। কিন্তু পেটের জন্য করে যেতে হচ্ছে”— বললেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর জিজ্ঞাসা, “বাংলা সাহিত্যে, বাংলার দলিত সাহিত্যে যদি সামান্য অবদানও আমার থেকে থাকে, তবে সামান্য একটু সাহায্য কি আমার প্রাপ্য নয়?” বেশি কিছু নয়, অসুস্থ শরীরে একটু হালকা ধরনের কাজ পেলেই তিনি খুশি। লিখতে চান মনোরঞ্জন। লিখে যেতে চান। আর লেখার জন্য সরকারের কাছে এইটুকুই তাঁর প্রত্যাশা।
তবে এর মধ্যেই মনোরঞ্জনের জন্য আরও একটা সুখবর। তাঁর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ হতে চলেছে এ মাসেই। আগামী ১২ জানুয়ারি এই অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ পাবে দিল্লির আন্তর্জাতিক বইমেলায়। প্রকাশক ‘সাম্য-সেজ’। অনুবাদ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক শিপ্রা মুখোপাধ্যায়। শিপ্রার কথায়, “বইটা পড়ার পর নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এর অনুবাদ করব। বিশ্ব জোড়া ইংরেজি বইয়ের যে বিশাল পাঠককুল রয়েছেন, এই বই থেকে তাঁদের বঞ্চিত রাখা ঠিক হবে না।”
লেখকের বাঁদিকে অনুবাদক শিপ্রা মুখোপাধ্যায় এবং ডানদিকে অন্যতম প্রকাশক মন্দিরা সেন।
সাহিত্যগুণ না বিষয়বস্তু, কোনটা বেশি টেনেছে ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’-এর পাঠক থেকে অনুবাদক হয়ে ওঠা শিপ্রাকে? “সাহিত্যগুণ তো এ বই-এর বড় সম্পদ বটেই। কিন্তু আমি অনেকটা বেশি আগ্রহী হয়েছিলাম ইতিহাসের জায়গা থেকে। এত দিন কলকাতা শহরে আছি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। কিন্তু এই শহরে আমার পাশের মানুষদেরই বড় অংশের ইতিহাস, বর্তমান আমার অজানা। এ ইতিহাস পড়ানো হয় না কোথাও”— বললেন শিপ্রা। সত্যিই তো! এক শহরে বাস করেও তো ‘আমাদের’ আর ‘ওঁদের’ মধ্যে উঠে আছে সুস্পষ্ট প্রাচীর, যা তৈরি হয়ে আছে অবজ্ঞা আর বঞ্চনা দিয়ে, যুগ যুগ ধরে। মনোরঞ্জনরা যত লিখবেন, ততই সামনে আসবে ‘আমাদের’ এই লজ্জার ইতিহাস।
ছবি: মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ফেসবুক পেজের সৌজন্যে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy