E-Paper

মস্তিষ্কের ‘ব্ল্যাক বক্সে’ অটিজ়ম রহস্যের সন্ধান, দাওয়াই কবে মিলবে?

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পিডব্লিউএস সম্পর্কে জানতে রোগীদের ব্রেন বা মস্তিষ্কের ‘মানচিত্র’ ও তার কার্যপ্রণালী বোঝা জরুরি। ল্যাবে তাঁরা ইঁদুরের দেহে পরীক্ষা করেছেন।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৩ ০৬:৫১
(বাঁ দিক থেকে ডান দিক) প্রবহণ চক্রবর্তী, অ্যামিলি বোরি এবং ইয়ান দ্রোমার্দ।

(বাঁ দিক থেকে ডান দিক) প্রবহণ চক্রবর্তী, অ্যামিলি বোরি এবং ইয়ান দ্রোমার্দ।

পৃথিবীতে এসে যদি মায়ের কোলটাও অচেনা ঠেকে শিশুর! সব চেয়ে কাছের স্পর্শও যদি দুর্বোধ্য লাগে!

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে শেখা এবং সেই মতো আচরণ করা তার অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু অনেক সময়ে জিনের কারসাজিতে জন্মের পর থেকেই এক অসম লড়াইয়ে নামতে হয় মানুষকে। যেমন, ‘অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’। কোন পরিস্থিতিতে কী ব্যবহার করতে হবে, তা ঠাহর করতে পারে না মস্তিষ্ক, স্বাভাবিক সামাজিক সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়। ‘অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’-এর মধ্যে পড়ে ‘প্রেডার উইলি সিন্ড্রোম’ (পিডব্লিউএস)। এই বিরল জিনের অসুখে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে স্তন্যপানও করতে পারে না। আবার বড় হয়ে ঠিক উল্টো, অস্বাভাবিক হারে খেতে থাকে। এ ছাড়া সামাজিক মেলামেশায় আতঙ্ক, আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ভয় ও অস্বাভাবিক আচরণ, রাগ ও বিরক্তি প্রকাশ। বিরল অসুখ, তা-ই এর সম্পর্কে অনেকটাই অজানা। ফ্রান্সের মঁপেলিয়ারে ‘ইনস্টিটিউট অব ফাংশনাল জিনোমিকস’-র পিডব্লিউএস সংক্রান্ত একটি গবেষণায় সন্ধান করা হয়েছে, মস্তিষ্কের কোন খামখেয়ালিতে মানুষের আচরণে এমন অস্বাভাবিকত্ব দেখা দেয়। এই গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন তিন বিজ্ঞানী— প্রবহণ চক্রবর্তী, ইয়ান দ্রোমার্দ এবং অ্যামিলি বোরি। তাঁদের মেন্টরের ভূমিকায় রয়েছেন বিজ্ঞানী ফ্রেডি জ়্যন্তো।

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পিডব্লিউএস সম্পর্কে জানতে রোগীদের ব্রেন বা মস্তিষ্কের ‘মানচিত্র’ ও তার কার্যপ্রণালী বোঝা জরুরি। ল্যাবে তাঁরা ইঁদুরের দেহে পরীক্ষা করেছেন। পিডব্লিউএস রোগীর শরীরে ‘মেজেল২’ জিনটি থাকে না। গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের দেহ থেকে এই জিনটিকে মুছে দেন। একে বলা হয় ‘নকআউট’। এ বারে এই জিন-পরিবর্তিত ইঁদুর ও তার সুস্থ-স্বাভাবিক ইঁদুর সঙ্গীদের একটি ভয়ের পরিস্থিতিতে ফেলা হয়। কিছু অচেনা ইঁদুর ছাড়া হয় তাদের খাঁচায়। যারা জিনগত ভাবে সুস্থ, একটা সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে নতুন ইঁদুরগুলোর সঙ্গে মিশতে শুরু করে। অসুস্থ ইঁদুরগুলো কিন্তু তা পারে না।

প্রবহণ জানান, সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন ও ব্যবহারের জন্য মস্তিষ্কে দু’টি অণু তৈরি হওয়া জরুরি। অক্সিটোসিন এবং ভ্যাসোপ্রোসিন। মস্তিষ্কের সঠিক স্থান থেকে সঠিক পরিমাণে তৈরি হয়ে এদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছনোও জরুরি। গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা দেখেন, সুস্থ ইঁদুরগুলির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের সুপ্রাঅপটিক নিউক্লিয়াস থেকে পেপটাইড দু’টি তৈরি হয়। এবং তার পর এরা মস্তিষ্কের মাঝামাঝি অংশে ল্যাটারাল সেপটাম-এ পৌঁছয়। ‘নকআউট’ করা ইঁদুরগুলিতে এই প্রক্রিয়াটি হতে দেখা যায়নি। গবেষকেরা বলছেন, এর জন্যই এদের মধ্যে সামাজিক সংযোগ স্থাপনের অভাব, আচমকা রাগ, বিরক্তি, অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা সুস্থ ইঁদুরগুলির শরীরে এই প্রক্রিয়াটি হ্রাস করে দেখেছেন, তারাও অসুস্থ ‘নকআউট’ ইঁদুরগুলোর মতোই আচরণ করছে। আবার উল্টোটাও করা হয়েছে। অসুস্থ ইঁদুরদের শরীরে সুপ্রাঅপটিক নিউক্লিয়াস থেকে ল্যাটেরাল সেপটাম পর্যন্ত অক্সিটোসিনের যাতায়াত শুরু করাতেই দেখা গিয়েছে তারা তুলনায় সুস্থ আচরণ করেছে।

বিজ্ঞানীদের পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, ল্যাটেরাল সেপটামে কী হয়? কোন কোষ রয়েছে ওখানে? প্রবহণরা দেখেন, মস্তিষ্কের ওই জায়গায় সোমাটোস্ট্যাটিন নিউরোন (এক ধরনের স্নায়ুকোষ) রয়েছে। অক্সিটোসিন ল্যাটেরাল সেপটামে গিয়ে এদের সঙ্গেই ‘সাক্ষাৎ’ করে। ল্যাটেরাল সেপটামের এই সোমাটোস্ট্যাটিন কোষগুলি মস্তিষ্কে ভীতি, আতঙ্ক তৈরি করে, যা নিয়ন্ত্রণ করে অক্সিটোসিন। পিডব্লিউএস রোগীদের মস্তিষ্কে যেহেতু অক্সিটোসিন ল্যাটেরাল সেপটামে পৌঁছয় না, তাই সোমাটোস্ট্যাটিন অতিরিক্ত মাত্রায় সক্রিয় হয়ে থাকে।

প্রবহণ, অ্যামিলি ও ইয়ান দেখেন, সোমাটোস্ট্যাটিনকে যদি কোনও রাসায়নিকের সাহায্যে (ফার্মাকোলজি) বা আলো-জিনের সংমিশ্রণে একটি বিশেষ পদ্ধতির (অপটোজেনেটিকস) সাহায্যে নিষ্ক্রিয় করা যায়, তা হলে ভয়, অস্বাভাবিক আচরণ অনেক কমে যায়। সামাজিক মেলামেশা করতে শুরু করে ইঁদুর-রোগীরা। তবে এই সবটাই অ্যানিমাল ট্রায়ালের ফল। মানবদেহে পরীক্ষা করা বাকি।

পিডব্লিউএস বা অটিজ়মের এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তার ওষুধের সন্ধানে এক ধাপ এগিয়ে দিল এই গবেষণা। প্রবহণ বলেন, ‘‘অটিজ়ম বহু রোগের স্পেকট্রাম। এতে মস্তিষ্কে কী কী ঘটে, তার অনেকটাই আমরা জানি না। একটা একটা করে ধাঁধার উত্তর খোঁজা হচ্ছে। এই গবেষণায় অক্সিটোসিন ও সোমাটোস্ট্যাটিনের ভূমিকা আমরা জানতে পারলাম। এর পর মানুষের দেহে পরীক্ষা করতে হবে। তার পর ওষুধ তৈরি। একটা বাড়ি তৈরির জন্য এখন ইটের উপর ইট গাঁথা হচ্ছে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Autism Science

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy