সামনে চারটে রাজ্যের নির্বাচন, পেছনে গুজরাত নির্বাচনে গ্রামে ধাক্কা খাওয়ার দগদগে ঘা, তাই এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট জনমুখী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মাননীয় অর্থমন্ত্রীও বলে দিয়েছেন এ বারের বাজেটে থাকবে গ্রামের প্রতি বিশেষ নজর। ভাল কথা, কিন্তু নজরটা দীর্ঘমেয়াদি হওয়া প্রয়োজন। ২০১১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার প্রবণতাটা বেড়েই চলেছে। মানুষ কেন গ্রামে থাকতে চাইছে না তার একটা কারণ কৃষির বেহাল অবস্থা নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। তাই কৃষিকে উন্নত করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকে কী করে আরও মজবুত করা যায়, দিশা চাই তারও। গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষির সঙ্গে অন্যান্য কাজের সু্যোগ কী করে বাড়ানো যায়, সে দিকে নজর দিতে হবে বইকি।
জানি, এই ধরনের কথাবার্তা নতুন কিছু নয়, এবং সরকারি স্তরেও চলছে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা। তাই একটু অন্য একটা দিকে আলোচনাটা নিয়ে যেতে চাই। কিছু দিন আগে গবেষণার কাজে জয়নগরের কাছে নিমপীঠ গিয়েছিলাম। ওখানকার স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের পরিচালনাধীন ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’-এর (আইসিএআর) কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রটির কাজকর্ম বুঝতে। তাঁদের কাজকর্ম, উৎসাহ উল্লেখ করার মতো। বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা ওই অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোটাকে বেশ মজবুত করতে সক্ষম হয়েছেন, এবং দাবি করেন যে তাঁদের অঞ্চল থেকে মানুষের কাজের খোঁজে বাইরে যাবার প্রবণতা কমে গেছে। নতুন প্রজন্ম কৃষি এবং কৃষিনির্ভর বাণিজ্যে যোগ দিতে উৎসাহী হয়েছে। এটা অবশ্য আমি কোনও নতুন কথা বলছি না, ওই কেন্দ্রের এ সব কাজকর্ম রাজ্য, কেন্দ্রীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
বিজ্ঞানী প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা সরকারি দায়বদ্ধতার বাইরে গিয়ে বেশ একটু ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনা করে এগিয়েছেন আর তার ফল পেয়েছেন। আমার মনে হয়, ওঁদের কাজ থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে, আমাদের ক্রমপরিবর্তনশীল গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতিতে কী ধরনের গবেষণা করা উচিত তা নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার ব্যাপক প্রচার হলে আমাদের সবার লাভ। গত দু’বছরের বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ বেড়েছে অনেকটাই, কিন্তু কৃষিবিজ্ঞান গবেষণার থেকে জোরটা মনে হয় বেশি বিমা আর কৃষিদ্রব্যের বাজার তৈরির দিকে। আমাদের দেশে কিন্তু ৬৪২টা কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র আছে, তাই পরিকাঠামো মজুতই আছে। আর এই ধরনের গবেষণার জন্য সব সময়ে যে খুব পয়সার দরকার তা-ও নয়। একটু নতুন চিন্তাভাবনাই অনেক কার্যকরী হতে পারে।
আরও পড়ুন: শেয়ার বাজার: কিছু প্রশ্ন, প্রত্যাশা, কিছু পরামর্শ
এই প্রসঙ্গে একটা প্রস্তাব দিই। ভারত সরকারের কৃষির জন্য যেমন আছে আইসিএআর, শিল্প সংক্রান্ত গবেষণার জন্য আছে ‘কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর)। সারা ভারতে এদের অধীনস্থ সংস্থাও তিরিশের বেশি। এগুলির মধ্যে অনেক সংস্থাই বিভিন্ন সময়ে ভারতের শিল্পের উন্নতিতে মূল্যবান অবদান রেখেছে। বিশ্বায়নের পর থেকে অবশ্য এদের মধ্যে অনেকগুলি সংস্থার কাজের ক্ষেত্রটা অনেকটা সঙ্কুচিত হয়েছে। এ বারের বাজেটে একটা বরং রূপরেখা থাকুক, কী ভাবে কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রগুলিকে আঞ্চলিক সিএসআইআর সংস্থাগুলির সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা যায়। যেহেতু এই সংস্থাগুলোর শিল্প সংক্রান্ত গবেষণার অভিজ্ঞতা আছে, আর কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রগুলি দেশের প্রত্যন্ত মানুষগুলির সুবিধে-অসুবিধে, চাহিদার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, এরা একসঙ্গে কাজ করলে গ্রাম বা ছোট শহরে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে উৎসাহী মানুষদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই লেখাটার ব্যাপারে দিল্লিতে আমার বন্ধু সিএসআইআর-এর বিজ্ঞানী আধ্যাপক সুজিত ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁর কাছ থেকে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম— ভারতে ‘টিস্যু কালচার’ পদ্ধতিটির মূল গবেষণা হয়েছিল একটি সিএসআইআর সংস্থাতে। আমরা সবাই জানি, এই পদ্ধতিটি শুধু সবুজ বিপ্লব নয়, তার পরবর্তী সময়েও ভারতের কৃষির অগ্রগতিতে কী অসামান্য অবদান রেখেছে।
তবে মনে রাখতে হবে, গলদটা বোধ হয় গোড়ায়। মূলত দু’টি কারণে এ কথা বলছি, এক) ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থাগুলি একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে, এর উদাহরণ বেশি দেখেছি বা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আর দুই) গত বছরেও এই কলামে বোধহয় লিখেছিলাম, গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থ কমতে কমতে আমাদের জিডিপি-র মাত্র ০.৬৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সব উন্নত দেশ, বা আমাদের দোসর ব্রিক্স দেশগুলি ওদের জিডিপি-র অন্তত ২% গত প্রায় এক দশক ধরে ব্যয় করে চলেছে। আমাদের দেশে এই স্বল্প ব্যয়ের মধ্যে সরকারের অবদান ৬০%, যার প্রায় সত্তর শতাংশ যায় প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা আর পরমাণু শক্তি বিভাগের খাতে। তার মানে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বরাদ্দ গবেষণার খাতে সরকারি খরচ নগণ্য (আশা করব, এটা তুলে ধরাটা দেশদ্রোহিতা নয়!)।
এই প্রসঙ্গে পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে কিছু কথা বলে লেখাটা শেষ করব, বিশেষত আমরা সবাই যখন ‘স্বচ্ছ ভারত’ নিয়ে এত চিন্তিত। কিছু দিন আগে একটা আরটিআই করে জানা গেছে, ভারতের পরিবেশ মন্ত্রকের মোট বাজেটের মাত্র ০.৩ শতাংশ গবেষণা খাতে খরচ করা হয়! এই অপ্রতুল খরচের মধ্যে (গত চার বছরে পরিবেশ খাতে বাজেট বরাদ্দ নিম্নমুখী) আবার এটাও প্রশ্ন যে খরচটা ঠিকঠাক জায়গায় হচ্ছে কি না। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শ্রীকান্ত নাদাদুর কিছু দিন আগে মন্তব্য করেছেন যে ভারতের পরিবেশ খাতে গবেষণার বেশির ভাগটাই হয় বেসিক সায়েন্সে।
পরিবেশ দূষণের প্রভাব মানুষের স্বাস্থ্যের উপর কী ভাবে পড়ছে, বিভিন্ন রোগের উপরেই বা দূষণের প্রভাব কী? এই ধরনের গবেষণা আমাদের দেশে বিশেষ হয় না। নিজের গবেষণার জন্য খোঁজ করতে গিয়ে দেখেছি, দিল্লির মতো বড় শহরের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন অঞ্চলের পানীয় জলের গুণমান, আর স্বাস্থ্যের উপর তার প্রভাব, এ নিয়ে বিশেষ কাজ হয়নি। যদি দিল্লিতেই এই অবস্থা হয়, দেশের বিভিন্ন ছোট শহর বা গ্রামের অবস্থা সহজেই অনুমেয় (আর্সেনিক বা ফ্লোরাইড অধ্যুষিত জায়গাগুলি ব্যতিক্রম)। এই অবস্থাটার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন ছোট-বড় শহর বার বার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছে দূষণের কারণে। হু-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৬ লক্ষেরও বেশি মানুষ ভারতবর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন দূষণজনিত কারণে। অসুস্থ হয়েছেন এবং সেই কারণে রোজগার হারিয়েছেন বা কর্মক্ষমতা কমে গিয়েছে, এ রকম মানুষের সংখ্যা যোগ করলে অর্থনীতির ক্ষতি বড় কম হবে না। সরকার যদি এই সব কথা মাথায় রেখে পরিবশ দূষণের উপর গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ায়, আর কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি নেয়, দেশের স্বচ্ছতার দীর্ঘমেয়াদি লাভ।
আজকাল টিভি, খবরের কাগজ খুললেই ঝাড়ু হাতে মন্ত্রী আমলাদের ছবি দেখতে পাই— স্বচ্ছ ভারত অভিযান চলছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু ‘জুতো আবিষ্কার’-এ একশো বছর আগেই দেখিয়ে গেছেন, শুধু ‘ঝাড়ু’ দিয়ে ‘স্বচ্ছ’ হওয়া যায় না, দরকার মৌলিক চিন্তার।
(লেখক জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সায়েন্স পলিসির বিভাগীয় প্রধান)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy