প্রধানমন্ত্রীকে খুনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগেই তো নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সোমা-সহ পাঁচ জনকে ২০১৮-র ৬ জুন গ্রেফতার করেছিল মহারাষ্ট্র পুলিশ।
নাগপুরের অমরাবতী রোডে ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে গাড়ি থেকে নামতেই এগিয়ে এলেন আগন্তুক। তিনতলার ফ্ল্যাটে যাচ্ছেন না কি!
বোঝা গেল, বাড়ির দিকে গোয়েন্দাদের কড়া নজর।
যে ফ্ল্যাটের দিকে ইশারা, তার বৈঠকখানা আর পাঁচটা বাঙালি পরিবারের মতোই। দেওয়ালে জলরঙে আঁকা ছবি। তাকে পারিবারিক ছবির অ্যালবাম। এক কোনায় গানবাজনার সরঞ্জাম। খাওয়ার টেবিলে আমের আচার।
রয়েছে সবই। শুধু বাড়ির গৃহকর্ত্রী নেই। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সোমা সেন গত এক বছর পুণের জেলে বন্দি। পড়ার টেবিলে স্তূপ করে রাখা বইপত্র। সামনে নীল শাড়িতে সোমার হাসি মুখের ছবি। সেখানে বসে নিজের কাজকর্ম করেন সোমার স্বামী তুষারকান্তি ভট্টাচার্য— গোয়েন্দাদের নজরে থাকা এই ফ্ল্যাটের একমাত্র বাসিন্দা।
এই ফ্ল্যাটেই তা হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুনের পরিকল্পনা হয়েছিল?
প্রশ্নটা শুনে চমকান না তুষারকান্তি। প্রধানমন্ত্রীকে খুনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগেই তো নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সোমা-সহ পাঁচ জনকে ২০১৮-র ৬ জুন গ্রেফতার করেছিল মহারাষ্ট্র পুলিশ। মোদী জমানায় দলিতদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ভীমা কোরেগাঁওয়ে পেশোয়াদের বিরুদ্ধে দলিতদের যুদ্ধ জয়ের ২০০ বছর পূর্তি উদ্যাপন হয়েছিল। পুলিশের অভিযোগ, সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত ওই পাঁচ জন ওই অনুষ্ঠান ঘিরে হিংসায় যুক্ত ছিলেন। তাঁদের পিছনে মদত ছিল মাওবাদীদের।
নাগপুরের ফ্ল্যাটে সোমার স্বামী তুষারকান্তি ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র
‘শহুরে নকশাল’-এর তকমা লেগে যাওয়া সোমা ও অন্যরা তার পর থেকেই পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে বন্দি। গ্রেফতার হওয়ার কয়েক দিন পরেই অবসর নেওয়ার কথা ছিল সোমার। বাতের ব্যথার জন্য হাঁটু মুড়ে বসতে পারেন না। গ্লকোমার জন্য রাতে দেখতে অসুবিধা হয়। বাষট্টি বছরের শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে তুষারকান্তিরও। তা নিয়েই ব্যাঙ্কে, বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়োদৌড়ি করতে হয়। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ করে দেওয়া হয়েছে। অশক্ত শরীর ও টাকার টানাটানির জন্য স্ত্রীকে দেখতে নিয়মিত পুণে যেতেও পারেন না। বলেন, ‘‘ওর ইচ্ছে ছিল, অবসরের পরে আবার গানের চর্চা শুরু করবে। এখন জেলে দেখতে গেলে ১৫ মিনিট কথা বলার সময় দেয়। কাচের ও-পার থেকে, ফোনে। পিছনে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে। বাংলায় কথা বললে ধমক লাগায়। ঘর-সংসার নিয়ে কথা বলতেই ১৫ মিনিট কেটে যায়।’’
তুষারকান্তি এক সময় সিপিআই (মাওবাদী)-এর সদস্য ছিলেন। তবে তাঁর দাবি, সোমার সঙ্গে এ সবের যোগাযোগ ছিল না। মুম্বইয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সোমা। নাগপুরে ২৮ বছরের অধ্যাপনার সঙ্গে সেই কাজও চালিয়ে গিয়েছেন। ষাট বছরের অধ্যাপিকার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে খুনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্তম্ভিত।
তুষার-সোমার একমাত্র মেয়ে কোয়েল মুম্বইয়ে তথ্যচিত্র তৈরিতে যুক্ত। ফোনে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের চার্জশিট পেশের পর মায়েদের জামিনের আবেদনের শুনানি চলছিল। চলতি সপ্তাহেই বিচারক বদলি হয়েছেন। তাই নতুন করে সওয়াল-জবাব হবে। কত দিন এই যন্ত্রণা চলবে, জানি না।’’
সোমা কিন্তু মনের জোর হারাননি। কোয়েলের কথায়, ‘‘জেলে এত দিন মাটিতেই কম্বল পেতে শুতে-বসতে হত মাকে। অনেক লড়াইয়ের পর একটা চেয়ার দিয়েছে। ১৫ দিন অন্তর দেখতে যাই। জেলে বসেই মা নিজের প্রথম বই লেখা শুরু করেছে। ছোট গল্পের সংকলন।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy