রাশিয়া থেকে তেল এবং জ্বালানি আমদানি করায় ভারতের উপর নেমে এসেছে আমেরিকার খাঁড়া। অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে কারণে ভারত যদি রাশিয়া থেকে খনিজ তেল আমদানি কমাতে বাধ্য হয়, সে ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির জ্বালানি আমদানির খরচ বৃদ্ধি পাবে অনেকটাই। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, তেমনটা হলে ভারতের জ্বালানি আমদানি বাবদ খরচ বাড়বে বছরে ৯০০ থেকে ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। তার প্রভাব পড়বে পেট্রল, ডিজেলের দামে।
তেল ব্যবহার এবং আমদানি, দুইয়ের নিরিখে ভারত পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এই তেল আমদানির অনেকটাই হয় রাশিয়া থেকে। ২০২২ সালে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে রাশিয়ার উপরে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলি বিধিনিষেধ চাপিয়েছিল। সে সময় রাশিয়া তেলের দাম অনেকটাই কমিয়ে দেয়। তার পরেই রাশিয়া থেকে অনেক কম দামে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে তেল কিনতে শুরু করে ভারত।
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের আগে তাদের থেকে ভারত মোট আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেলের ০.২ শতাংশ কিনত। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে তারা রাশিয়া থেকে কেনে মোট আমদানিকৃত তেলের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। এর ফলে ভারতের তেল আমদানির খরচ কমার পাশাপাশি দেশে তেলের দামও নিয়ন্ত্রিত। তা ছাড়া রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত খনিজ তেল কম দামে আমদানি করে ভারতের তেল সংস্থাগুলি তা দিয়ে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য তৈরি করা শুরু করে। সেই দ্রব্য বিভিন্ন দেশে রফতানি করে লাভের মুখও দেখেছে দেশ। যে সব দেশ রাশিয়ার উপরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল, তাদেরও সেই দ্রব্য বিক্রি করেছে ভারতের তেল সংস্থাগুলি।
তার পরেই ভারতের উপরে শুল্কখাঁড়া ঝুলিয়েছেন ট্রাম্প। গত বুধবার ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। পাশাপাশি, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল এবং অস্ত্র কেনার জন্য ভারতকে ‘জরিমানা’ও দিতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। জরিমানার অঙ্ক সম্পর্কে অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। আগামী কয়েক দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিও রাশিয়া থেকে আমদানি করা খনিজ তেল থেকে তৈরি পণ্য নিষিদ্ধ করতে চলেছে নিজেদের দেশে। রিয়েল টাইম ডেটা প্রদানকারী সংস্থা কেপিলারের প্রধান গবেষক সুমিত রিটোলিয়া এই বিষয়টিকে ‘উভয় সঙ্কট’ বলে উল্লেখ করেছেন।
২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে পারে। তার পরে বিপাকে পড়বে ভারতের পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি। অন্য দিকে, আমেরিকা শুল্ক চাপালে বিপাকে পড়বে ভারতের জাহাজ, বিমা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। সুমিত বলছেন, এর ফলে সমস্যায় পড়বে ভারত। তেলের দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। গত অর্থবর্ষে ভারত অপরিশোধিত খনিজ তেল আমদানিতে খরচ করেছে ১৩,৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা। সেই অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ডিজ়েল এবং পেট্রল তৈরি হয়েছে।
গত বছর রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে প্রচুর লাভ করেছে পরিশোধন সংস্থা রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ় লিমিটেড এবং নায়ারা এনার্জি। নায়ারার সঙ্গে যোগ রয়েছে রাশিয়ার তেল সংস্থার। এই সংস্থার উপর গত মাসে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তার পর থেকে রিলায়্যান্স পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য রফতানিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত প্রতি দিন ১,৮৫,০০০ ব্যারেল পরিশোধিত তেল তারা রফতানি করেছে। সুমিত জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা জারির পরে রিলায়্যান্সের সামনে এখন দু’টি পথ। এক, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ এবং দুই, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশ ছাড়া অন্য দেশে তেল রফতানি করেছে। সূত্রের খবর, রিলায়্যান্সের পরিশোধনাগারের যা পরিকাঠামো রয়েছে, তাতে রাশিয়া ছাড়া অন্য দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল এনে একটি শোধনাগারে প্রক্রিয়াকরণের পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে রফতানি করতে পারে। পাশাপাশি, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল এনে অন্য একটি শোধনাগারে প্রক্রিয়াকরণের পরে অন্য বাজারে তা রফতানি করতে পারে। তবে আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশে সেই তেল রফতানি করতে গেলে পণ্য পরিবহণের সময় এবং খরচ দুইই বাড়বে।
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করা ভারতের পক্ষে খুব সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তথ্য প্রদানকারী সংস্থা কেপিলার বলছে, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি না করলে ভারতকে ব্যারেল প্রতি ৫ ডলার ছাড় হারাতে হবে। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪০০ টাকা। প্রতিদিন গড়ে ১৮ লক্ষ ব্যারেল তেল আমদানি করে ভারত। এর ফলে ভারতীয় সংস্থাগুলির খরচ বাড়বে বছরে ৯০০ থেকে ১১০০ কোটি আমেরিকান ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। তার প্রভাব পড়বে মূল্যবৃদ্ধি, দেশে পেট্রল, ডিজেলের দামে।