পরাস্ত ‘রাবণ’।
কলিযুগের রামরাজ্যেও হার হল ‘রাবণ’-এর। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারতে চলেছেন দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ। যিনি সাধারণ ভাবে ‘রাবণ’ বলেই পরিচিত। গোরক্ষপুর শহর বিধানসভা কেন্দ্রে নিজের তৈরি দল আজাদ সমাজ পার্টির প্রার্থী হয়ে ভোটের ময়দানে নেমেছিলেন চন্দ্রশেখর। প্রথম রাউন্ড গণনার শেষে তাঁর প্রাপ্ত ভোট ১৩৩! একই কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছিল দলিত-মুখী মায়াবতীর পার্টি বসপা। প্রথম রাউন্ডে তাদের প্রার্থী পেয়েছেন ৩৪৩টি ভোট।
বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে যে ক’টি প্রতীকই থাকুক না কেন, বাস্তবে গোরক্ষপুর শহর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী ছিলেন একজনই। যোগী আদিত্যনাথ। তবে রূপকার্থে ধরলে গোরক্ষপুর শহরের লড়াইয়ে রামচন্দ্রের ভক্ত গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে ছিলেন ‘রাবণ’। যাঁর পোশাকি নাম চন্দ্রশেখর আজাদ। বিদেশি সাময়িকীতে যাঁকে ‘ভবিষ্যতের প্রভাবশালী ভারতীয়’-দের মধ্যে একজন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দলিত নেতা। বয়স ৩৪ বছর। সাদা লিনেনের শার্ট, নীল ডেনিম, চোখে ব্র্যান্ডেড রোদচশমা— যোগীর বিরুদ্ধে ‘রাবণ’ ভোটে লড়তে নেমেছিলেন খানিকটা অসম সাহসে ভর করেই। তিনি উত্তরপ্রদেশের দাপুটে মুখ্যমন্ত্রীকে হারিয়ে দেবেন, এমন আশা সম্ভবত তাঁর অতিবড় সমর্থকও করেননি। বিশেষত, যখন গোরক্ষপুরে শহর কেন্দ্রে যোগীর বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছিলেন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী শুভাবতী শুক্লও। ধারেভারে শুভাবতী অনেক এগিয়েছিলেন।
অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত একার শক্তিতেই ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাঁর দল আজাদ সমাজ পার্টি। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বারাণসীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন বলে ঠিক করেছিলেন চন্দ্রশেখর। কিন্তু দলিত ভোটের ভাগাভাগি রুখতে অখিলেশের সপা এবং মায়াবতীর বসপা প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন তিনি।
অম্বেডকর অনুসরণকারী এবং দলিত সমাজের ‘বৈগ্রহিক’ নেতা হিসেবে উঠে-আসা চন্দ্রশেখর ২০১৪ সালে সতীশ কুমার এবং বিনয় রতন সিংহের সঙ্গে একজোট হয়ে ‘ভীম আর্মি’ তৈরি করেছিলেন। তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সর্বত্র দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনের মানোন্নয়ন।
এর পরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ২০২০ সালের মার্চ মাসে ‘ভীম আর্মি’ থেকে নিজের আলাদা দল ‘আজাদ সমাজ পার্টি’ তৈরি করেন চন্দ্রশেখর। ২০২০ সালেই বিহারের নির্বাচনে প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয় তাঁর দল। সেই মর্মে পাপ্পু যাদবের নেতৃত্বাধীন ‘প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ (পিডিএ)-সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে অংশও নেয় চন্দ্রশেখরের দল।
তার মধ্যেই অবশ্য দলিত সমাজের বিভিন্ন ভালমন্দ এভং আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন এই যুবক। হাথরস ধর্ষণ-কাণ্ডে দেশজু়ড়ে প্রতিবাদ চলাকালীন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন এই দলিত নেতা। হাথরসের দলিত যুবতীকে গণধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে ধর্নায় বসেছিলেন চন্দ্রশেখর। নয়াদিল্লির যন্তরমন্তরে আয়োজন করেছিলেন বিশাল প্রতিবাদ সভার।
বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হাথরসের নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর। পুলিশি বাধায় থামতে হয়েছিল। তবে তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। শেষমেশ নির্যাতিতার বাড়ি গিয়ে তিনি ওই দলিত পরিবারের সদস্যদের জন্য ‘ওয়াই’ ক্যাটিগরির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। হাথরস-কাণ্ডে ‘অতিসক্রিয়’ চন্দ্রশেখরকে আটক করে সাহারানপুরে গৃহবন্দি করেছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। পরে তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারও করা হয়েছিল।
দিল্লি-গাজিপুর সীমানায় কৃষক আন্দোলনেও সামিল হয়েছিলেন চন্দ্রশেখর। সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিয়ে হায়দরাবাদ এবং দিল্লিতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। কড়া বিজেপি-বিরোধী মনোভাব থেকেই সম্ভবত তাঁর যোগীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া। জিতবেন যে, তা সম্ভবত ভাবেননি চন্দ্রশেখর নিজেও। বাস্তবও অলৌকিক কিছু ঘটায়নি।
ভবিষ্যৎ বলবে, ‘রাবণ’-এর রাজনীতির কেরিয়ার শুধু আন্দোলন এবং ভোট লড়ার মধ্যেই সীমিত থাকবে কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy