Advertisement
E-Paper

এই পথে পা ফেলে হেঁটেছেন যিশুও

সারা বিশ্বে অজস্র গির্জা ছড়িয়ে থাকলেও মহা পীঠস্থান কিন্তু ভ্যাটিক্যান শহরই। যিশুর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে সেখানে পৌঁছে নজরে পড়ল তুলকালাম আনন্দের ফোয়ারা। সারা শহরের কোনও হোটেল-পান্থনিবাসে তিলধারণের ঠাঁই নেই। অনেকটা গঙ্গাসাগর মেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। রোম ঘুরে লিখলেন মিলন মুখোপাধ্যায়।সারা বিশ্বে অজস্র গির্জা ছড়িয়ে থাকলেও মহা পীঠস্থান কিন্তু ভ্যাটিক্যান শহরই। যিশুর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে সেখানে পৌঁছে নজরে পড়ল তুলকালাম আনন্দের ফোয়ারা। সারা শহরের কোনও হোটেল-পান্থনিবাসে তিলধারণের ঠাঁই নেই। অনেকটা গঙ্গাসাগর মেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। রোম ঘুরে লিখলেন মিলন মুখোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৭

…. শীত আসে। শীত যায়।

প্রতি বছরই ডিসেম্বর-জানুয়ারি লেপ-কম্বল মুড়ি দিতে হয়। কলের জলে হাত দিতে ভয় করে। এই বুঝি ছ্যাঁকা লাগল! কলকাতা-দিল্লি-মুম্বইতে এমন দশা হলে, সেই শীতের দেশে শীত কেমন থরথরিয়ে, তুষারের সঙ্গে ফিসফিস করে নেমে আসে তার নমুনা পেয়েছিলাম পৌষমাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইউরোপের ইতালিতে। যেখানে হাজার বছরেরও আগে যিশুখ্রিস্ট বয়ে নিয়ে চলেছিলেন ভারি কাষ্ঠখণ্ড-নির্মিত ক্রুশ চিহ্ন। সেই রোমে। সেই ভ্যাটিকানের আদি সেন্ট পিটার গির্জা দেখতে গিয়েছিলাম এমনই বরফ বৃষ্টিময় শীত মাথায় করে।

ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি শীত সারা বছরের জন্য আনন্দ-হুল্লোড়ের শেষ হয় না—সারা পৃথিবীর যেন কেন্দ্রবিন্দু হল যিশুখ্রিস্ট। ভ্যাটিক্যান সিটির সেন্ট পিটার চার্চ। রোম। ইতালি।

হিন্দু দেবদেবীর সংখ্যা তো বিস্তর! ফলে তীর্থস্থানও অজস্র। কাশী, বৃন্দাবন, মথুরা তো আছেই। দক্ষিণের জনপ্রিয় তিরুপতি থেকে উত্তরে হিমালয়ের কোলে তো বলতে গেলে সবই পীঠস্থান। কেদার-বদ্রী, অমরনাথ থেকে কামাক্ষ্যা। মা-কালীর ছিন্ন ছিন্ন শরীরের একশো আটটি অংশই তো হিন্দুদের পীঠস্থান। শ্রীকৃষ্ণের ‘দ্বারকা’ বা গুজরাতিদের ‘রণছোড়জিতে’ তো বিশাল মন্দির রয়েছে পশ্চিম ভারতে।

ও দিকে, মসজিদ পৃথিবীময় হাজারে হাজারে ছড়িয়ে থাকলেও, তীর্থক্ষেত্রে কিন্তু একটিই। সৌদি আরবের ‘‘হজ’’ বা মক্কা-মদিনাই মহাতীর্থ। কথায় বলে নানান তীর্থ বার বার, ‘হজযাত্রা’ একবার।

খ্রিস্টানদের প্রায় এই রকম। সারা বিশ্বে অজস্র পবিত্র গির্জা ছড়িয়ে থাকলেও মহা পীঠস্থান কিন্তু ‘ভ্যাটিকান’ শহরেই। সেন্ট পিটার গির্জা। ‘যিশুখ্রিস্টের শহরে’ বা ‘পবিত্র শহর ভ্যাটিক্যান’’ নামে সারা বিশ্বে এর পরিচয়।

যিশুর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম ইতালির ‘রোম’ শহরের প্রান্তে ‘ছিয়াম্পিনো’ বিমান বন্দরে। ইংরাজি ‘সি’ অক্ষরটিকে এঁরা ‘ছি’ উচ্চারণ করেন। খুঁজে পেতে শহরের ভেতরে সেঁধিয়ে উঠলাম গিয়ে আর এক মধ্যবিত্ত আস্তানায় ‘হোতেল ছেন্ত্রো’। ছিমছাম হোটেলটি একেবারে ঠাসা বলতে পারেন। নানান দেশ-বিদেশের লোকে। আহা। ‘ক্রিসমাস’ আসছে না! ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পুত্র যিশুর জন্মদিন। ফলে, তুলকালাম আনন্দের ফোয়ারা। চলবে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। ফলে রোম তথা পবিত্র ‘ভ্যাটিক্যান সিটি’ এখন জমজমাট। সারা শহরের কোনও হোটেল-মোটেল পান্থনিবাস তিলধারণের ঠাঁই নেই। অনেকটা গঙ্গাসাগর মেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। খ্রিস্টধর্মের মহামিলন ক্ষেত্র। ‘একা রামে রক্ষে নাই, লক্ষণ সহোদর’। ডিসেম্বরের শীত নেমেছে জাঁকিয়ে। সঙ্গে সহোদর লাগাতার বরফ কণা ‘ফিসফিস’ বৃষ্টি সেই সকাল থেকে। প্রায় হাঁটুর নীচ অবধি টানা-লম্বা গরম মোজা ও ট্রউজারের ওপরে গরম গেঞ্জি হাফ-হাতা সোয়েটার। তার ওপরে উষ্ণ জামা গলা অবধি বন্ধ। তদুপরি ফুলহাতা দাদুর সোয়েটার। এই সব বর্মর ওপরে গায়ে চড়াতে হয়েছে একটি ত্রিপল জাতীয় কড়ক বস্তু দিয়ে বানানো ওভারকোট গোছের বর্ষাতি। এ জিনিস দেওয়ালে টাঙানোর দরকার নেই। স্রেফ খুলে মেঝের যে কোনও জায়গায় দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দিন—‘বোরো’ (বা বোবটে) মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। নট নড়ন চড়ন, নট কিচ্ছু! রাশিয়ায় বছর তিনেক ছিল এমন বন্ধুর উপহার, ‘‘যা, যা নিয়ে যা। ঠিক কাজে লাগবে—ইউরোপের শীত বলে কথা। যেখানে সেখানে ছেড়ে দিবি— দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝামেলা নেই! মাথায়, রোমশ পশমের কান ঢাকা ‘কসাক’ টুপি।

যাই হোক, অত্তসব প্রায় দশ পনেরো কেজি সজ্জায় ঢাকা শরীরও থেকে থেকে কেমন কেঁপে উঠছে। শত হলেও, বঙ্গদেশের ভেতো বাঙালি। তা সেই গজকচ্ছপ গোছের ধুমসো পোশাকে ‘রোমে’র প্রাচীন পাথুরে পথে ঘুরতে বেরিয়েছি। রোমান রাজ্যের অজস্র রাজা-গজারা এই সব পথ বিচরণ করেছেন। ইতিহাস বিখ্যাত সব ধর্মযাজকগণ হেঁটেছেন তাঁদের শুভ্র শরীর ঢাকা পোশাকে। প্রায়ঃস্মরণীয় শিল্পী ভাস্করদের পদধূলি পড়েছে এই পথে। এমনকী গত দরিদ্র অত্যাচারিত তাবৎ রোমান প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা দূর করতে, তাদের মধ্যে গিয়ে, তাদের সঙ্গে বসবাস করে তাদের ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত’ বলে সাহস-মানসিক শক্তি দিতে, নেমে এসেছিলেন স্বয়ং যে ঈশ্বরের সন্তান বা সাক্ষাৎ ভগবান অবতার সেই যিশুখ্রিস্টও এই পথে পা ফেলে হেঁটেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে চরম সেই দুঃখের দিনে, ছিন্ন-ভিন্ন মলিন কৌপীন পরে প্রায় নগ্ন শরীরে, আপন কাঁধে বিশাল ওজনের রোমান ‘দণ্ডকাষ্ঠ’ বা ক্রুশ বয়েছেন। হা-ক্লান্ত পা টেনে-টেনে তাঁর জন্যেই নির্ধারিত বধ্যভূমিতে ‘মৃত্যুদণ্ড’ নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ‘ক্রুশবিদ্ধ যিশু’ আজ বিশ্ববাসীর ধর্মের প্রতীক।

যত ভাবতে ভাবতে হাঁটছি, তত শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছে। শহরের প্রায় প্রধান কেন্দ্রে পৌঁছে এক বয়স্কা পথচারীকে জিগ্যেস করলাম,

‘‘সেন্ট পিটার চার্চে’ কোনও বাস যায় না কি? অনুগ্রহ করে কোন বাস, কত নম্বর একটু বলবেন—’’ স্থূলকায় মহিলা একটু খাট মতন। আমার কোনও বিলিতি, গোলাপি রঙের পিসিমা-মাসিমা থাকলে হয়তো অনেকটা এই রকম দেখতে লাগতো।

চশমা কপালে তুলে আমায় ‘পর্যবেক্ষণ’ করলেন। মিষ্টি হেসে বললেন, যে কোনও বাসে উঠে পড়ুন। প্রায় বেশির ভাগই ভ্যাটিকান যাবে।’’

তারপর, জিগ্যেস করলেন তুমি কি লাতিন অমেরিকা থেকে এসেছ, না পাকিস্তান?’’

আপন দেশ বলতে, পিসিমা আরও এক গাল হেসে বললেন,

‘‘ভেরি হোলি ল্যান্ড’! কাম অন, সান। আমরাও ভ্যাটিকান যাব—’’

বলে, ‘আমরা’-টিকে ডাকলেন।

একটি মদ্য কিশোরী, ছটফটে। ভিড়ের মধ্যেই দু’চার কদম আগে হাঁটিল। প্রায় নাচতে নাচতে। অ্যাত্ত মানুষজন রাস্তায় হাঁটছে। একটা উৎসব-উৎসব ভাব, গন্ধ, দৃশ্য। মেয়েটির নাম সারিয়া। সবুদ-হলুদ গরম ফ্রকের ওপরে খালি একটা সোয়েটার।

তা, পৌঁছে গেলুম গন্তব্যে—একেবারে বিনে মাগনায়। ভ্যাটিকানের ‘সেন্ট পিটার গির্জা’ এক এলাহি ব্যাপার। ভীমাকৃতি থামের পর থাম। চওড়া চওড়া পাথরের সিঁড়ির পর সিঁড়ি। দশাসই পাথুরে মূর্তির প্রতিকৃতির ছড়াছড়ি। অনেকখানি জায়গা জুড়ে মস্ত মস্ত পাথর দিয়ে তৈরি প্রাঙ্গণ। তারই চারপাশ ঘিরে অতি প্রাচীন সময়ও পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। এই প্রশস্ত বিশালতার মধ্যে বড়দিনের নানান রঙিন সাজ-পোশাক পরা আধুনিক মানুষ-মানুষিদের কেমন খেলনা পুতুল পুতুল লাগছে।

গির্জার মাথার নীচে, ডানপাশে প্রকাণ্ড একটা ঘড়ি। তার নীচে দুলছে ঘণ্টা। প্রার্থনার সময় তখন। ঘণ্টার গম্ভীর ধ্বনি এই পুরাতন ভগবানের শহরে প্রতিধ্বনি তুলে ঘুরছে। গম্ভুজ থেকে সিঁড়িতে, সিঁড়ি থেকে পাথরের মূর্তিদের গায়ে গায়ে। এই গমগম শব্দ, এই প্রতিধ্বনি যেন আজকের পুতুলদের জন্যে নয়। এ যেন অনেক গভীর গভীরে কথা। ‘‘অ-উ-ম’’ অথবা ‘‘ও’’-এর মতন কোনও অতি বিশুদ্ধ, পবিত্র ধ্বনি প্রতিধ্বনি।

প্রধান গির্জায় ঢোকার আগে একটি থামের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলুম। ডান কান থামে চেপে ধরতে, কেমন যেন শ্বাসের শব্দ। ‘সাস’ বা ‘জিসাস! জাতীয়। হঠাৎ খেয়াল হল ‘মা’ বেশ শক্ত করে হাত ধরে আছেন আমার। চোখে চোখ মারিয়ার পড়তে সামান্য আলগা দিলেও ছেড়ে দিলেন না। বললেন, কেমন যেন ভয় ভয় করে। তাই না?’’

এখানে বড়দিনের মরসুম শুরু হয়েছে পুরোদমে দু’দিন আগেই। বঞ্চনা তরতাজা কিশোরী যৌবনের দিকে দ্রুত হাঁটছেন। ছটফটে ভঙ্গিতে চোখের ইশারায় বললে, ‘ভেতরে যাই চলুন’! ওর হালকা কটাক্ষে শরীর কেমন চাঙ্গা হয়ে উঠল। ভারি অদ্ভুত অনুভূতি। ভিন্ন বয়েসের দুটি বিদেশিনীর সঙ্গে রোমের পৃথিবীর ধর্মীয় পীঠস্থানে দাঁড়িয়ে নানান বোধ মনে খেলা করছে। বাস্তব-অবাস্তবের বিচিত্র সংমিশ্রণ।

না। বয়স্কার মতো ঠিক ‘ভয় ভয়’ নয়। তবে, হ্যাঁ খানিকটা হয়ত বা তাই। সঙ্গে চমক, সঙ্গে পরিবেশের গভীরতা। যিশুর জন্মদিনে যেন দিকবিদিক থেকে বাতাস বয়ে আনছে কোনও বার্তা। হয়তো বা জয়ধ্বনি প্রণাম। স্তম্ভিতের মতো পরিবেশের, ধ্বনির মধ্যে ডুবে যাচ্ছি পবিত্রতায় স্নান-ঘণ্টার শব্দ-আউম-জিসাস চোখে জল….

vatican city milan mukhopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy