রাজা রঘুবংশীকে বিয়ে করতে চাননি সোনম রঘুবংশী। বিয়ের আগেই মায়ের কাছে ‘স্বীকার’ করে নিয়েছিলেন প্রেমের কথা। রাজ কুশওয়াহার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাও সোনমের মা জানতেন। এমনকি, জোর করে বিয়ে দিলে তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে, মাকে সেই হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছিলেন সোনম। সংবাদমাধ্যমে এমনটাই দাবি করলেন রাজার ভাই বিপিন রঘুবংশী। তিনি জানিয়েছেন, সোনমের ভাই গোবিন্দের থেকে এই তথ্য তিনি জানতে পেরেছেন। সোনমের কঠোরতম শাস্তির দাবি জানিয়েছেন বিপিন। পুলিশ সূত্রে খবর, বিয়ের আগেই ‘তৈরি’ ছিল রাজাকে খুনের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা! সোনম এবং এই ঘটনার অন্য অভিযুক্তদের মেঘালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সোনমকে বুধবার শিলঙের আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। পুলিশ ১০ দিনের হেফাজতের দাবি জানালেও তাঁকে আপাতত আট দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সংবাদ সংস্থা এএনআইকে মেঘালয় পুলিশ জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত সোনম বা অন্য অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা যায়নি। নথি সংক্রান্ত কাজগুলিতে তদন্তকারীরা ব্যস্ত ছিলেন। বৃহস্পতিবার তাঁদের পুরোদমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পূর্ব খাসি পাহাড়ের সহকারী এসপি। খুনের ঘটনার সঙ্গে সোনমের জড়িত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
মধ্যপ্রদেশের ইনদওরের বাসিন্দা রাজা এবং সোনম গত মাসে বিয়ের পর মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন। ২৩ মে থেকে তাঁদের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেকেই মনে করেছিলেন, অচেনা জায়গায় গিয়ে নবদম্পতি দুষ্কৃতীদের কবলে পড়েছেন। এর পর ২ জুন মেঘালয়ের একটি ঝর্নার ধার থেকে উদ্ধার করা হয় রাজার রক্তাক্ত দেহ। তখনও সোনমের খোঁজ পায়নি পুলিশ। তাঁর খোঁজে চিরুনিতল্লাশি চালাচ্ছিলেন মেঘালয়ের তদন্তকারীরা। মনে করা হচ্ছিল, সোনমকে দুষ্কৃতীরা বাংলাদেশে পাচার করে দিয়েছে। কারণ যেখানে তাঁদের শেষ বার দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত খুব দূরে নয়। স্থানীয় এক ট্যুর গাইড পুলিশকে জানান, তিনি ২৩ তারিখ সোনম এবং রাজাকে তিন জন হিন্দিভাষী যুবকের সঙ্গে পাহাড়ে উঠতে দেখেছিলেন। এই বয়ানের পর রাজা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছিল। হিন্দিভাষীদের খুঁজতে মেঘালয় পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল পৌঁছে গিয়েছিল ইনদওরে। কিন্তু তাতেও কোনও সুরাহা হচ্ছিল না রহস্যের। অবশেষে ৮ জুন মধ্যরাতে সোনম আত্মসমর্পণ করেন। ইনদওরে বা মেঘালয়ের কোথাও নয়, উত্তরপ্রদেশের গাজ়িপুরে। স্বামীকে খুনের অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে মেঘালয় পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় আরও তিন জনকে। অভিযোগ, স্বামীকে খুনের জন্য সোনম ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের টাকাও দিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরেই রাজ কুশওয়াহা নামের যুবকের সঙ্গে সোনমের প্রেমের সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে আসে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোনম এবং রাজ একে অপরকে বিয়ের আগে থেকেই চিনতেন। রাজ পারিবারিক ব্যবসার সূত্রে সোনমের পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ, রাজাকে খুনের অন্যতম মূলচক্রী এই রাজ। তাঁকেও ইনদওর থেকে গ্রেফতার করে মেঘালয় পুলিশ। জানা যায়, গাজ়িপুরের একটি ধাবায় রাত ১টা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছিলেন সোনম। সেখান থেকে বাড়িতে ফোন করেন। তিনি খুব কান্নাকাটি করছিলেন বলেও জানান ওই ধাবার মালিক। কী ভাবে মেঘালয় থেকে তিনি উত্তরপ্রদেশে পৌঁছোলেন, তা স্পষ্ট হয়নি তখনও।
আরও পড়ুন:
‘কী করি শুধু দেখো’
রাজার ভাই বিপিন সংবাদমাধ্যমে সোনমের ভাইয়ের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘গোবিন্দ আমাকে বলেছে, সোনমই মূল ষড়যন্ত্রকারী। গোবিন্দ আমাদের পাশে আছে। ও মনে করে, ওর বোনের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।’’ বিপিন আরও বলেন, ‘‘সোনম আসলে রাজকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর মা তাতে রাজি হননি। তখনই মাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে সোনম বলেছিল, তুমি যদি আমার বিয়ে দিয়ে দাও, শুধু দেখো আমি কী করব।’’ রাজার ভাই জানিয়েছেন, রাজা নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। কারও একার পক্ষে তাঁকে মারা সম্ভব ছিল না। সোনমও এতে সাহায্য করেছিলেন বলে তাঁর সন্দেহ।
বিয়ের আগেই ষড়যন্ত্র
পুলিশ সূত্রে দাবি, বিয়ের আগে থেকেই রাজাকে খুনের পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছিলেন সোনমেরা। তিনিই মেঘালয়ের টিকিট কেটেছিলেন। মধুচন্দ্রিমার জন্য বেছে নিয়েছিলেন দেশের সম্পূর্ণ অন্য প্রান্তকে। রাজের সঙ্গে গোপনে দেখা করতেন সোনম। বাকি অভিযুক্তদের সঙ্গেও নিয়মিত দেখা হত তাঁর। একটি গোপন ডেরায় দেখা করে তাঁরা খুনের পরিকল্পনা করতেন বলে খবর। এখনও এই সমস্ত তথ্য নিশ্চিত করেনি পুলিশ। খুনের উদ্দেশ্যও এখনও স্পষ্ট নয়। তবে তদন্তকারীদের ধারণা, রাজকে বিয়ে করার ইচ্ছা বাস্তবায়িত করতেই সোনম এই চক্রান্ত করেছিলেন।
সোনমের প্ল্যান ‘বি’
‘ভাড়াটে খুনি’রা যদি রাজাকে খুন করতে ব্যর্থ হতেন, তা হলেও তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিকল্প উপায় বা প্ল্যান ‘বি’ ভেবে রেখেছিলেন সোনম। পুলিশ সূত্রে খবর, সোনম স্থির করেছিলেন, যদি তাঁর ‘প্রেমিক’-এর বন্ধুরা (যাঁদের ২০ লক্ষ টাকা দিয়ে খুনের সুপারি দেওয়া হয়েছিল), খুন করতে না পারেন, তা হলে নিজস্বী তোলার বাহানায় রাজাকে পাহাড়ের ধারে নিয়ে গিয়ে ঠেলে ফেলে দেবেন। পুলিশ আরও জানতে পেরেছে, রাজা যাতে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে না পারেন, তার জন্যই ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। পাহাড়ের উপরে খুনের পর রাজার দেহ ফেলে দেওয়া হয় শিলঙের গভীর খাদে।
৯ ঘণ্টার ‘ঘটনাক্রম’
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৩ মে, ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ মেঘালয়ের নোংরিয়াটে শিপারা হোমস্টে ছেড়ে দেন রাজা, সোনম। সকাল ৬টায় নোংরিয়াট থেকে ট্রেকিং করতে বেরিয়ে পড়েন। শিপারা হোমস্টে থেকে কিছুটা দূরে আরও একটি হোমস্টেতে ছিলেন সোনমের ‘প্রেমিক’ রাজ এবং তাঁর তিন বন্ধু আকাশ, বিশাল, আনন্দ। এই তিন জনকেই রাজাকে খুনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সোনম। তাঁরা যখন হোমস্টে ছেড়ে ট্রেকিংয়ে বার হন, পাশের হোমস্টে থেকে ট্রেকিংয়ে যান আকাশেরাও। সকাল ১০টা নাগাদ সোনম এবং রাজা নোংরিয়াটে ২০০০ সিঁড়ি ট্রেক করে ওঠেন। সেখানে দেখা হয়ে যায় ‘ভাড়াটে খুনি’ আকাশ, আনন্দ এবং বিশালের সঙ্গে। রাজার সঙ্গে ওই তিন জন পরিচয় করেন। তার পর তাঁরা একসঙ্গে আগে আগে হাঁটছিলেন। পিছনে হাঁটছিলেন সোনম। পুলিশ সূত্রে খবর, পাঁচ জনকে একসঙ্গে দেখতে পেয়েছিলেন স্থানীয় ট্যুর গাইড অ্যালবার্ট পেড। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ শাশুড়ি উমা রঘুবংশীকে ফোন করেন সোনম। রাজার সঙ্গেও তাঁর মায়ের কথা হয়। দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০-এর মধ্যে ওয়েইসডং জলপ্রপাত দেখতে যান সোনমেরা। সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় পৌঁছোতেই সোনমের ইঙ্গিত পেয়ে কাটারি দিয়ে পিছন থেকে রাজার মাথায় আঘাত করেন বিশাল। লুটিয়ে পড়েন রাজা। ঘটনাস্থলে তাঁর মৃত্যু হয়। দুপুর সওয়া ২টোয় রাজার ফোন থেকে তাঁর সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্টে সোনম পোস্ট করেন, ‘‘সাত জন্মের সাথী আমরা।’’ দুপুর ২টো ৩০ নাগাদ রাজার দেহ খাদে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়।
সোনমের দাবি
গাজ়িপুরের ধাবায় গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্য দাবি করেছিলেন সোনম। জানিয়েছিলেন, মেঘালয়ে গিয়ে দুষ্কৃতীদের কবলে পড়েছিলেন তাঁরা। সোনমকে বাঁচাতে গিয়েই তাঁর স্বামী রাজার মৃত্যু হয়েছে। সোনমের কথায়, ‘‘ওরা আমার গয়না ছিনিয়ে নিতে এসেছিল। আমাকে বাঁচাতে গিয়েই রাজা মরে গেল!’’ সেই ঘটনার পর তাঁর কিছু মনে নেই বলেও ধাবায় দাবি করেছিলেন সোনম। কী ভাবে মেঘালয় থেকে তিনি উত্তরপ্রদেশে পৌঁছোলেন, তা বলতে পারেননি। পুলিশ সূত্রে দাবি, ধাবায় ‘গল্প’ ফেঁদেছিলেন সোনম। আদৌ সত্যি বলেননি। তবে সোনমের বয়ানও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
২০ লক্ষ টাকার লোভে খুন?
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কোটি কোটি টাকার সানমাইকার ব্যবসা রয়েছে রঘুবংশী পরিবারের। তাঁদের কারখানাতেই কর্মচারী হিসাবে কাজ করতেন সোনমের ‘প্রেমিক’ রাজ। মাসে ২০,০০০ টাকা বেতন পেতেন। স্বামীকে খুন করার জন্য ‘ভাড়াটে খুনি’দের ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন সোনম। এমনকি, ‘প্রেমিক’কে এও আশ্বাস দিয়েছিলেন, বিধবা হলে তাঁকেই বিয়ে করবেন। তবে কি ২০ হাজার টাকা থেকে একবারে ২০ লক্ষ টাকা পেতেই রাজা-খুনে সোনমকে মদত দিয়েছিলেন রাজ? না কি পেতে চেয়েছিলেন সোনমকেই? পুলিশকে ভাবাচ্ছে সে সব প্রশ্নও।
কোন পথে কোথায়
পুলিশ সূত্রে খবর, রাজাকে খুনের পরই ট্যাক্সিতে শিলং চলে আসেন সোনম। সেখান থেকে ট্যুরিস্ট ট্যাক্সিতে চড়ে গুয়াহাটি পৌঁছোন। তার পরে ট্রেনে চেপে চলে যান ইনদওরে। সেখান থেকে পরের দিনই উত্তরপ্রদেশে পাড়ি দেন। গাজ়িপুরে রাজের বাড়ি আছে। সেখানে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন সোনম। ‘ভাড়াটে খুনি’দের যাত্রাপথও একই ছিল। তবে সোনমের সঙ্গে তাঁরা যাননি। অন্য দিকে, সোনমের ‘প্রেমিক’ রাজ আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন ইনদওর। যাতে এই ঘটনায় কেউ কোনও সন্দেহ করতে না পারেন। এমনকি, রাজার শেষকৃত্যেও হাজির ছিলেন রাজ।
কী বলছে পুলিশ
বুধবার পূর্ব খাসি পাহাড়ের এসপি বিবেক সিয়েম এএনআইকে বলেছেন, ‘‘আমরা অভিযুক্তদের সবে মেঘালয়ে নিয়ে এসেছি। এ বার বিস্তারিত তদন্ত শুরু হবে। খুনের ঘটনার সঙ্গে যে সোনম জড়িত ছিলেন, আমাদের কাছে তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু তিনি কতটা জড়িত ছিলেন, তাঁর কী ভূমিকা ছিল, পরে সে সব জানা যাবে।’’ সহকারী এসপি আশিস বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের আদালতে হাজির করানো এবং সেই সংক্রান্ত নথিপত্রের কাজ চলছে। আমরা এখনও জিজ্ঞাসাবাদের সময় পাইনি। সোনমের এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত জোরালো। কিন্তু এখনই নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা তদন্তের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। নতুন তথ্য পেলেই আমরা আপনাদের জানাব।’’