Advertisement
E-Paper

স্বরাষ্ট্রহীন নীতীশ কি বিহারের ‘নিধিরাম’ মুখ্যমন্ত্রী? নিজেদের হাতে পুলিশ রেখে দিয়ে ‘সম্রাট’ তৈরির পরিকল্পনা বিজেপির

২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় ১০১টি করে আসনে লড়েছিল বিজেপি এবং জেডিইউ। বিজেপি জেতে ৮৯টি আসন। জেডিইউ ৮৫টি। সেই আসনসংখ্যার নিরিখে ‘বড় শরিক’ বিজেপি। ২৭ জনের মন্ত্রিসভায় বিজেপির ১৪ জন রয়েছেন। সেখানে জেডিইউয়ের ৯ জন।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:৪১
Why did BJP take home department from Nitish Kumar in Bihar cabinet

দু'দশক পর মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের হাত থেকে বেরিয়ে গেল স্বরাষ্ট্র দফতর। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

তিনি ‘সর্দার’। কিন্তু তাঁর হাতে ঢাল-তরোয়াল নেই। ফলে তিনি ‘নিধিরাম সর্দার’। বিহারের কুর্সিতে রেকর্ড গড়ে দশম বার মুখ্যমন্ত্রী হলেও দফতর বণ্টনের পরে নীতীশ কুমার ‘নিধিরাম’ই বটে। ২০ বছর পরে তাঁর হাত থেকে বিজেপি ‘ছিনিয়ে’ নিয়েছে বিহারের স্বরাষ্ট্র তথা পুলিশ দফতর। অথচ, এই বিহার পুলিশকে ‘সিধে’ করেই নিজের ‘পল্টুরাম’ ভাবমূর্তি ঢেকে দিতে পেরেছিলেন নীতীশ। নিজেকে তুলে ধরেছিলেন ‘সুশাসনবাবু’ হিসাবে।

নীতীশের মন্ত্রিসভায় দুই উপমুখ্যমন্ত্রীই বিজেপির। তাঁদেরই এক জন সম্রাট চৌধরি। সমতা পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা শকুনি চৌধরির পুত্র সম্রাটের হাতেই গিয়েছে বিহারের স্বরাষ্ট্র দফতর। যে ঘটনাকে বিজেপির অনেকে পরবর্তী ‘সম্রাট’, অর্থাৎ ‘মুখ্যমন্ত্রী’ তৈরির বীজ পুঁতে রাখা হিসাবে অভিহিত করছেন। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উমা ভারতীর ঘনিষ্ঠ এক নেতা বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে মুঙ্গেরের কয়েকটি আসনে প্রচারের সময়ে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ঘটনাটক্রে, সম্রাট মুঙ্গেরেরই ভূমিপুত্র। উমা-ঘনিষ্ঠ ওই বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পুলিশ দফতর না-থাকা চোখে পড়ার মতোই। কিন্তু বিহারের রাজনৈতিক সমীকরণ যে জায়গায় রয়েছে, তাতে এটা আশ্চর্যের নয়। বরং নীতীশের হাতে এ বার স্বরাষ্ট্র বা পুলিশ থাকলে সেটাই হত অবাক হওয়ার মতো বিষয়।’’

যে রাজ্যে, যে দলেরই সরকার থাকুক, সাধারণ ভাবে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই স্বরাষ্ট্র দফতর থাকে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ, কেরলে পিনারাই বিজয়ন, তেলঙ্গানায় রেবন্ত রেড্ডি থেকে শুরু করে অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মা— সকলের ক্ষেত্রেই তা-ই। বাংলাতেও এর আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, জ্যোতি বসু বা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়— যিনিই মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন, তাঁর হাতেই থেকেছে স্বরাষ্ট্র তথা পুলিশ দফতর। তবে ১৯৯৮-১৯৯৯ সাল নাগাদ জ্যোতিবাবু স্বরাষ্ট্র ছেড়ে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেবের হাতে। ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে বসু সেই পদ দিয়েছিলেন উত্তরসূরি বুদ্ধদেবকে। অর্থাৎ, আগেই বুদ্ধদেবের হাতে স্বরাষ্ট্র দফতর দিয়ে দেওয়া ছিল পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রিত্বের সঙ্কেত। বিহারের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যার মিল রয়েছে।

তবে পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। নীতীশ শিবিরের বক্তব্য, স্বরাষ্ট্র যেমন বিজেপির হাতে গিয়েছে, তেমনই অর্থ দফতর বিজেপির হাত থেকে এসেছে জেডিইউয়ের হাতে। এই যুক্তিতে তাঁরা নীতীশকে ‘নিধিরাম’ মানতে নারাজ। আবার এ-ও ঠিক যে, ভূমি ও রাজস্ব, স্বাস্থ্য, খনির মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলি রয়েছে বিজেপির হাতে। স্বরাষ্ট্র দফতর জেডিইউয়ের অন্য কোনও নেতা পেতে পারতেন। কিন্তু তা-ও হয়নি। বিহার নির্বাচনে সক্রিয় একাধিক বিজেপি নেতার বক্তব্য, নীতীশের শারীরিক অবস্থা যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে পুলিশ দফতর তাঁর হাতে রাখা যেত না। অর্থ দফতর নীতীশের দলের হাতে গেলেও তা নীতীশের নিজের হাতে নেই। এখানে মুখ্য বিষয় নীতীশের শারীরিক পরিস্থিতি। যা বিহার নির্বাচনের সময়েও অন্যতম আলোচ্য হয়ে উঠেছিল। আলোচনায় রসদ জুগিয়েছিলেন স্বয়ং নীতীশই। একাধিক ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে, তাঁর স্মৃতি ঠিকমতো কাজ করছে না। ভরা জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ বলে বসেছিলেন! এমনিতে রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের অসুস্থতাকে সাধারণত গোপনই রাখতে চান। কারণ, কেউ একবার অসুস্থ হিসাবে জনমানসে রটে গেলে তাঁর আর সেই ‘প্রভাব’ থাকে না।

২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় ১০১টি করে আসনে লড়েছিল বিজেপি এবং জেডিইউ। বিজেপি জেতে ৮৯টি আসন। জেডিইউ ৮৫টি। ফলে সংখ্যার নিরিখে ‘বড় শরিক’ বিজেপি। ২৭ জনের মন্ত্রিসভায় বিজেপির ১৪ জন রয়েছেন। সেখানে জেডিইউয়ের ৯ জন। আরজেডি এবং কংগ্রেসের জোট থেকে ২০২৪ সালে বেরিয়ে এসেছিলেন নীতীশ। লোকসভা ভোটের চার মাস আগে বিজেপির সমর্থন নিয়ে সরকার গড়েছিলেন। সেই মন্ত্রিসভাতেও নীতীশের দলের চেয়ে বিজেপির সদস্যসংখ্যা ছিল বেশি। গত মন্ত্রিসভায় জেডিইউ-এর মন্ত্রী ছিলেন ১৩ জন। বিজেপির ১৯ জন। এ বার দু’দলেরই সংখ্যা কমেছে। কারণ, চিরাগ পাসোয়ান, জিতনরাম মাঝিঁর দলের মতো ছোট দলকেও জোটরক্ষায় মন্ত্রিসভায় জায়গা দিতে হয়েছে।

প্রাথমিক ভাবে বিজেপির তরফে বলা হয়েছিল ৬:১ সূত্রে মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। অর্থাৎ, প্রতিটি দলের ছয় জন বিধায়ক প্রতি এক জন মন্ত্রী হবেন। সেই সূত্র যে মানা হয়নি তা সংখ্যাতেই স্পষ্ট। তবে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সেই সূত্রেই এগোতে পারে পদ্মশিবির। রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, জোটধর্ম পালনের জন্য নীতীশকে আবার মুখ্যমন্ত্রী করলেও দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভায় সংখ্যাধিক্য রেখে আসলে বিজেপি তাঁকে চাপেই রেখেছিল। স্বরাষ্ট্র দফতর নিজেদের হাতে রেখে সেটাই আরও স্পষ্ট করে দিল পদ্মশিবির।

যদিও অনেকে বলছেন, কেন্দ্রে নীতীশের সমর্থন প্রয়োজন মোদীর। ফলে বিহার নিয়ে টানাপড়েনে ঢুকবে না বিজেপি। তবে এ কথা প্রায় সকলেই মানছেন যে, নীতীশের পরবর্তী সময়ে জেডিইউ-এর এমন কোনও উচ্চতার নেতা বিহারের রাজনীতিতে নেই, যিনি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন। নীতীশের যা শারীরিক অবস্থা, তাতে তিনি কত দিন সক্রিয় ভাবে মুখ্যমন্ত্রিত্ব সামলাতে পারবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েয়েছে। এখনই কোনও বদল না হলেও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা শুরু করে দিল বিজেপি।

Bihar Politics Nitish Kumar Bihar Cabinet
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy