পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ থেকে নরেন্দ্র মোদী সরকার সন্ত্রাসের মোকাবিলার নতুন রণনীতি নিয়েছিল। তা হল, ভারত ভবিষ্যতে যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলাকে ভারতের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ (অ্যাক্ট অব ওয়ার) হিসেবে দেখবে। যার অর্থ, তার জবাব ভারত যুদ্ধের মাধ্যমেই দেবে।
পহেলগাম-হত্যার সাত মাস পরে খাস দেশের রাজধানীতে গাড়ি বিস্ফোরণের পরে প্রশ্ন উঠল, মোদী সরকার কী ভাবে জবাব দেবে? লাল কেল্লার কাছে বিস্ফোরণে পাকিস্তানের ভূমিকা পাওয়া গেলে ফের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো পাল্টা প্রত্যাঘাত হবে? না কি এখন তা সম্ভব নয় বুঝেই বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরেও একে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর তকমা দেওয়া হচ্ছে না?
সোমবার সন্ধ্যায় বিস্ফোরণের পরে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী মোদী পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি মেনে ভুটান রওনা হন। সেখানেই দিল্লির বিস্ফোরণ নিয়ে প্রথম মুখ খুলে বলেন, ‘‘আমাদের নিরাপত্তা সংস্থা এই ষড়যন্ত্রের শিকড় পর্যন্ত যাবে। ষড়যন্ত্রকারীদের মাফ করা হবে না।’’ হিন্দিতে এ কথা বলে ইংরেজিতে মোদী বলেছেন, ‘‘যারা দায়ী তাদের সকলের বিচার হবে।’’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে পর্যালোচনার পরে সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, এই ঘটনার পিছনে দোষীদের ‘হান্ট ডাউন’-এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলে নিরাপত্তা সংস্থার ‘চরম রোষ’-এর মুখে পড়বে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, অতীতে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির তরফে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে। কিন্তু লাল কেল্লারপাশে বিস্ফোরণের ঘটনায় জইশ-ই-মহম্মদের দিকে সন্দেহের তির থাকলেও সরকারি ভাবে কিছু বলা হয়নি। সরকারি ভাবে এই বিস্ফোরণকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামলাও বলা হয়নি। যদিও সন্ত্রাস দমন আইন তথা ইউএপিএ-র আওতায় এফআইআর দায়ের হয়েছে।
বিরোধীদের প্রশ্ন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময়ে বাণিজ্য-চাপ দিয়ে সংঘর্ষবিরতি করিয়েছেন বলে বহু বার দাবি করেছেন। ট্রাম্পের এই অবস্থান ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষিতে কি ভারতের পক্ষে ফের সামরিক অভিযান সম্ভব? সেই কারণেই মোদী সরকার লাল কেল্লার বিস্ফোরণকে খোলাখুলি সন্ত্রাসবাদী হামলা বলছে না? প্রসঙ্গত, সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তিও ভারতের কাছে বাড়তি চাপ।
আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিংহ বলেন, ‘‘মোদীজি বলেছিলেন, যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলা যুদ্ধ হিসেবে ধরা হবে। পাকিস্তানের উপরে ভরসা করে ট্রাম্পের চাপে সংঘর্ষবিরতি কেন করা হয়েছিল? লাল কেল্লার বিস্ফোরণে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদ জড়িত। এ বার মোদীজি ট্রাম্পের কাছে নালিশ করবেন না কি পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দেবেন?” পহেলগামে ২৭ জনের মৃত্যুর পরে দিল্লিতে বেসরকারি হিসেবে ১৩ জনের মৃত্যু ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরার বক্তব্য, ‘‘দেশে আতঙ্কের আবহ। মানুষের মনে যে সব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তার জবাব দিতে হবে।’’
এই প্রশ্নের মুখে মোদী সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হয়েছে, যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলাকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে দেখা হবে বলে যে নতুন রণনীতি ঠিক হয়েছিল, তা থেকে মোদী সরকার সরছে না। একই সঙ্গে সূত্রের দাবি, ‘অপারেশন সিঁদুর’ এখনও চলছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ মঙ্গলবার বলেছেন, ‘‘আমি নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে চাই যে তদন্তকারী সংস্থাগুলি সার্বিক ভাবে তদন্ত করছে। তদন্তেকী মিলছে তা দ্রুত জানানো হবে। কোনও পরিস্থিতিতেই দোষীরা ছাড়া পাবে না।’’
বিরোধীদের প্রশ্ন, দেশের রাজধানীতে এত বড় বিস্ফোরণ হল কী করে? বিস্ফোরণের পরেই প্রধানমন্ত্রী দিল্লি ছেড়ে ভুটান গেলেন কেন? কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনতে, আম আদমি পার্টির নেতারা এই প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, ভুটান সফরের কর্মসূচি আগেভাগেই নির্ধারিত ছিল। তা বাতিল করা সম্ভব ছিল না। তবে প্রধানমন্ত্রী বুধবারই দিল্লি ফিরে বিকেলে মন্ত্রিসভারবৈঠক করবেন।
তাঁর ভুটান সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বুঝেই মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ভুটানে পৌঁছে প্রথম অনুষ্ঠানেই দিল্লির বিস্ফোরণ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘খুব ব্যথিত মন নিয়ে এসেছি। গত সন্ধ্যায় দিল্লির ভয়াবহ ঘটনা সকলের মনকে ব্যথিত করেছে।আমি হতাহতদের পরিবারের দুঃখ বুঝি। গোটা দেশ তাঁদের পাশে রয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি গত কাল সারা রাত সমস্ত তদন্তকারী সংস্থা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি। বিচার-বিবেচনা চলছিল। তথ্যগুলিকে এক সুতোয় গাঁথা হচ্ছিল।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)