লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্যের মতো বিষয়গুলি নিয়ে যেভাবে ভাঙাগড়া চলছে, তাতে উদ্বিগ্ন বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নিত্যই মার খাচ্ছে। আগামি দিনের গবেষণা বা শিক্ষার কাজে তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির সভাপতি তৈমুর রাজা চৌধুরী ও সম্পাদক পরিতোষ দে বলেন, লোকসংস্কৃতি এখন পঠনপাঠনের বিষয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে মানব সভ্যতার অনেক প্রত্ন উপাদান। বিশুদ্ধি নষ্ট হলে এর তাৎপর্য হারিয়ে যায়। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বিভ্রান্তি ঘটছে।
উদাহরণ দিয়ে লোকসঙ্গীতের গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, আজকাল ভাটিয়ালির মাঝে ভাওয়াইয়া ঢুকে পড়ছে। নদী-বিলে নৌকাচালনার সূত্রে সৃষ্টি দীর্ঘ টানা সুরের গান ভাটিয়ালি। আর মৈষাল-গাড়িয়ালদের বন্ধুর পথ চলার গান হল ভাওয়াইয়া। দু’টির বৈশিষ্ট্য না জানলে শুদ্ধভাবে তা পরিবেশন করাই মুশকিল। এ ছাড়া, লোকনৃত্যের বিশেষত্ব হচ্ছে, নাচের সময় ঘড়ির কাঁটার ঘূর্ণনের বিপরীত দিক ধরে শিল্পীরা ঘোরেন। আজকাল অনেকেই উল্টোটা করছেন। ওঝা নৃত্যে নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরছেন শিল্পীরা।
তাত্ত্বিক ধারণা স্পষ্ট না হওয়াতেই এ সব হয় বলে মনে করছেন বরাক বঙ্গের কর্মকর্তারা। তাই লোকসঙ্গীতের শিল্পী, শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে তাত্ত্বিক দিকগুলি তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁরা। তৈমুরবাবু জানান, ১৬ অগস্ট বঙ্গভবনে শুরু হবে তিনদিনের কর্মশালা। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক বরুণকুমার চক্রবর্তী ও দোহার-খ্যাত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকবেন।
সুরমা সাহিত্য সম্মিলনীর শিলচর অধিবেশনের শতবর্ষ পূর্তি ও শ্রীভূমি পত্রিকা প্রকাশের শতবর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। অমলেন্দুবাবু জানান, লোকসংস্কৃতির বিশুদ্ধি নষ্ট হওয়ার বিষয়টি গত ছ’-সাত বছর ধরে বরাক বঙ্গকে ভাবাচ্ছে। এর আগের শিলচর অধিবেশনের সময়েই একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এ বারের অধিবেশনেও তা করা হয়। অমলেন্দুবাবুর কথায়, ওই একই ছবি। শিল্পীদের তাত্ত্বিক ধারণা স্পষ্ট নয়। লোকসঙ্গীত সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পর্কে শিল্পীরা অবহিত নন। রাধারমণ, হাসনরাজা, শিতালং শাহ, দৈখুরা প্রমুখের একাধিক গীতি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, বহু শিল্পী তা জানেনই না। সঙ্গে রয়েছে নতুন শিল্পীর অভাব। এ ছাড়া, বরাক উপত্যকায় লোকসঙ্গীত বহু পর্যায়ে সমৃদ্ধ। কিন্তু শিল্পীরা পরিবেশন করেন মাত্র কয়েকটি পর্যায়ের গান।
দু’টি অধিবেশনের তুলনা টেনে অমলেন্দুবাবু বলেন, এই অঞ্চলে লোকসঙ্গীত চর্চার মান নিম্নমুখী। ছ’বছর আগের অধিবেশনে লোকমঞ্চে অংশ নিয়েছিল ২৮টি সংস্থা ও ৪০জন শিল্পী। গত বছর অংশ নেয় ২৪টি সংস্থা ও ২২জন শিল্পী। ঠাটকীর্তন, টুসুগানের দল পাওয়াই যায়নি। লোকসঙ্গীতের ৫৭টি পর্যায়ের মধ্যে পরিবেশিত হয়েছিল মাত্র ২৪টি পর্যায়ের গান। ‘লোকসঙ্গীতের কয়েকটি আধুনিক সমস্যা’-র কথায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলে গিয়েছেন, “সুরে আঞ্চলিকতা রক্ষা শুধু নয়, আঞ্চলিক উপভাষার বিশেষ উচ্চারণভঙ্গীটি বজায় রাখার দিকে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। পূর্ববঙ্গে চান বা চান্দ-এর যে উচ্চারণ তাকে চাঁদ বললে সমস্ত রসই নষ্ট হয়ে গেল। তারপর পূর্ববঙ্গে দীর্ঘ উচ্চারণ প্রায় নেই। আবার অনেক সময় ‘ও’কার ‘উ’কার হয়ে যায়। ‘তুমার’ সংশোধন করে ‘তোমার’ বললে হবে না। উত্তরবঙ্গের ‘কয়া যাও’-কে ‘কৈয়া যাও’ বললে ভুল হবে। পূর্ববঙ্গের ‘কেনে আইলাম’-কে ‘কেন আইলাম’ বললেও চলবে না।’’
সে সব বিষয় পর্যালোচনা করেই তিনদিনের এই লোকসঙ্গীত কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বরাক বঙ্গের কর্মকর্তা দীনেন্দ্রনারায়ণ বিশ্বাস, সৌরীন্দ্র ভট্টাচার্য, হারাণ দে ও সুবীর কর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy