Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

টেবল-টপ পাহাড় আর মায়াবি হ্রদ

সাপুতারা এখন মোহময়ী আর আদিবাসী সুন্দরী, দেহে আধুনিকতার ঢেউ আছড়ে পড়েছে। প্রায় তিন হাজার একশো ছিয়ানব্বই ফুট উচ্চতায় বুকের মাঝখানে একটা ছোট্ট হ্রদ নিয়ে পাহাড়ের কোলে শুয়ে শহরটা। সারা বছরই বেশ মনোরম আবহাওয়া। বর্ষায় সবুজ মখমলে মোড়া মেঘকুয়াশা জড়ানো ঝরনার মেখলায় সাপুতারা বোধ হয় সবথেকে সুন্দর, যে রূপ আমরা এখন দেখতে পাব না। তবু কল্পনা করে নিতে ক্ষতি কি? ঘুরে এসে লিখছেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়।সাপুতারা এখন মোহময়ী আর আদিবাসী সুন্দরী, দেহে আধুনিকতার ঢেউ আছড়ে পড়েছে। প্রায় তিন হাজার একশো ছিয়ানব্বই ফুট উচ্চতায় বুকের মাঝখানে একটা ছোট্ট হ্রদ নিয়ে পাহাড়ের কোলে শুয়ে শহরটা। সারা বছরই বেশ মনোরম আবহাওয়া। বর্ষায় সবুজ মখমলে মোড়া মেঘকুয়াশা জড়ানো ঝরনার মেখলায় সাপুতারা বোধ হয় সবথেকে সুন্দর, যে রূপ আমরা এখন দেখতে পাব না। তবু কল্পনা করে নিতে ক্ষতি কি? ঘুরে এসে লিখছেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

‘হাম তেরে বিন অব রহ নেহি সক্তে, তেরে বিনা কেয়া ওয়াজুদ মেরা।/ তুঝ সে জুদা আগর হো যায়েঙ্গে তো খুদ সে হো যায়েঙ্গে জুদা।/ কিঁউকি তুম হি হো অব তুম হি হো জিন্দেগি অব তুম হি হো/ চ্যান ভি মেরা দর্দ ভি মেরি আশিকি অব তুম হি হো।

গাড়ি ছুটে চলেছে দুরন্ত-মসৃণ গতিতে। রেডিওতে বাজছে গানটি। ‘আশিকি টু’ ফিল্মের গান। অরিজিত্‌ সিংহ-র মন মাতাল করা কণ্ঠ আর পাগল-করা গানের কথা। বুঁদ হয়েছিলাম গানটির মধ্যে। গাড়ির জানালা দিয়ে সরে যাচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তার সর্পিল বিভঙ্গ। দেখেও যেন দেখছিলাম না। মন এ সময় শুধু এক জনকেই চাইছিল। রাজ, আমার রাজ। ‘তুম হি হো অব তুম হি হো জিন্দেগি অব তুম হি হো।’ কত দিন... কত দিন তোমাকে দেখি না রাজ। জীবনের একঘেয়েমির বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে কত সময় মনে হয়েছে তোমার হাতে হাত রেখে হারিয়ে যাই। কিন্তু... এই কিন্তুটাই বারবার বাদ সেধেছে। মনের কথা মনেই রয়ে গেছে। তোমাকে আর বলা হয়ে ওঠেনি। আজ ওই কিন্তুটিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি, রাজ। আজকের এই দিনটা শুধু তোমার আর আমার। পারবে না রাজ কেবল একটা দিনের জন্য আমার রাজা হতে।

মাই ডিয়ার! তোমার এই ছোট্ট অনুরোধটুকু রাখতে পারব না, এমন অধম আমি নই।

চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি...এ কী! রাজ তুমি! ইয়ে...য়ে...য়ে! তুমি এলে রাজ? শেষ পর্যন্ত তুমি এলে? দেখো, তুমি এলে আমি কিছুতেই আমার আনন্দ চেপে রাখতে পারি না। তোমাকে ঘিরে এত আবেগ কোথা থেকে এসে জড়ো হয় বুকের মাঝখানে, বলো তো?

ডার্লিং! এই আবেগটাই তো তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসে, একে হারিয়ে ফেলো না। বাঁচিয়ে রেখো যত্ন করে, চিরটাকাল।

রাজ, আমরা আজকে কোথায় হারিয়ে যাব, বলো না!

চলো আমার সাথে। যেতে যেতে পথই বলে দেবে কোথায় চলেছি আমরা!

চোখ রাখি গাড়ির জানালায়। পশ্চিমঘাট পাহাড়ের ঢেউ চলেছে পাশে পাশে। কখনও সুদূর বিসর্পী দিগন্তবিস্তারী সে পাহাড়ের প্রবাহ। মনে হচ্ছে যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলছে পাহাড়ের এই নিঃশব্দ পথচলা। অচল পাথরের স্তূপকে যেন চড়াই-উতরাই, সমতল-অসমতলের পালাবদলে সচল করে তুলেছে প্রকৃতি। আমাদের এই জীবনের মতো পাহাড়ের পথচলাও যেন এক ভ্রম। স্থির অথচ মনে হয় গতিশীল। রুক্ষ, কঠিন, বিস্তৃত এই পাহাড়ি ভূমিরূপ ফসলের জন্ম না দিতে দিতে কর্কশ, শ্যামলতা বিহীন। শ্যামলিমার প্রসন্নতা নেই, আছে শুধু সূর্যের জ্বলন্ত উত্তাপে দগ্ধ হয়ে যাওয়া পাথুরে বেদনা। তাই যত দূরে তাকাই ধূসর আর হলুদ রঙের চোখ পুড়িয়ে দেওয়া দাবানল। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য আর পায়ের তলার তপ্ত মাটিকে কার্যত অগ্রাহ্য করে হেঁটে আসছে মানুষ...নারী-পুরুষ-বালক। খালি পা, হাতে লাঠি, মাথায় গামছা দিয়ে ওই উত্তপ্ত রোদ আড়াল করার চেষ্টা। বিস্তীর্ণ পাথুরে জমিতে মাঝে মধ্যে দুটো-একটা বাবলা গাছ বা ফণীমনসার ঝাড়। তারই তলায় ক্ষুদ্র ছায়াটুকু আশ্রয় করে কেউ কেউ একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। মুখে-মাথায় ঢালছে একটু শীতল বারি। তারপর আবার পথচলা শুরু পায়ে হেঁটে।

কোথায় চলেছে এরা রাজ?

একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে কোথায় চলেছে এরা। দেখো, এঁদের পরিধানে আঁকা রয়েছে সিরডি সাঁইবাবার মুখ। সাঁইবাবার দু’চোখ পরম করুণাঘন। হাতে আশীর্বাদের ভঙ্গি। তাঁরই কৃপা মাথায় নিয়ে ওঁরা হেঁটে চলেছেন। শরীরের কষ্টকে ভুলতে হয়তো ওঁরা মনে মনে জপ করে চলেছেন, ওঁ সাঁই নমো নমঃ/শ্রীসাঁই নমো নমঃ/ জয় জয় সাঁই নমো নমঃ/সদ্গুরু সাঁই নমো নমঃ। এই দেশটার নাম ভারতবর্ষ। আধ্যাত্মিকতা এই দেশের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে রয়েছে। ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম/ যত্‌কৃপা তমহং বন্দে, পরমানন্দমাধবম’। তাঁর কৃপালাভ করলে পথের কষ্ট তো কোনও কষ্টই নয়।

এখান থেকে সিরডি। সে তো অনেক দূর।

হ্যাঁ, অনেক দূরই তো। কিন্তু যিনি পরম প্রিয় তাঁর কাছে যেতে হলে দূরত্ব সে যত বেশিই হোক ঠিক অতিক্রম করে যাওয়া যায়।

আচ্ছা রাজ, এবারে বলো তো আমরা কোথায় চলেছি?

আমরা চলেছি নাগভূমি।

নাগভূমি! সে আবার কী! এরকম জায়গার নাম তো শুনিনি কখনও। রাজ, তুমি কি আমাকে শেষমেশ সাপের মুখে ফেলতে চাও?

আহাহা! বালাই ষাট! তোমাকে ফেলব সাপের মুখে, এমন পাষণ্ড আমাকে ভাবলে কী করে? তুমি আমার হৃদয়েশ্বরী বলে কথা! বরং তোমাকে সর্পদেবী করে রাখতে পারি।

কথার ওসব কারসাজি ছাড়ো। খোলসা করে বলো তো দেখি কোথায় চলেছি আমরা?

ঠিক আছে। এত পীড়াপীড়ি যখন করছ তখন বলেই দিই, জায়গাটার নাম সাপুতারা। সাপুতারা নামের মানে কী জান? সাপেদের বাসস্থান। সাপেদের বাসস্থান নাগভূমিই তো হয়, নাকি! খুব তো আমাকে একহাত নিচ্ছিলে।

দুঃখিত রাজ।

না না, ওসব দুঃখটুঃখ পেতে হবে না। এখন শুধু হাসি আর আনন্দ। নাসিকে পুণ্য সঞ্চয় করে এলে। এ বার সাপুতারায় সেই পুণ্যের ফল লাভ করবে চলো। তুমি জানতে চাইছিলে না সিরডি এখান থেকে কত দূর? মহারাষ্ট্রের মানচিত্রটা মনে করো। নাসিক থেকে কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বে সিরডি। প্রায় ৮৭ কিমি দূরত্ব। আবার নাসিক থেকে কিছুটা উত্তর-পশ্চিম ঘেঁষে গুজরাত-মহারাষ্ট্র সীমান্তে সাপুতারা। দূরত্ব প্রায় ৭৮ কিমি। তাহলে বুঝলে পায়ে হেঁটে এই অঞ্চল থেকে কতটা পথ অতিক্রম করতে হয় সিরডি যেতে হলে। প্রায় একশো-দেড়শো কিলোমিটারের পথ। মুখের কথা নয় মোটেই। তার ওপর এমন মালভূমিপ্রবণ পাহাড়ি রাস্তা।

হুমম্। ঠিক। মানুষ ইচ্ছে করলে কী না পারে! অবশ্য শুধু ইচ্ছে নয়, তাঁর কৃপালাভ করাও চাই। তা নইলে লক্ষ্যে পৌঁছবে কী করে? রাজ, সাপুতারা সম্বন্ধে একটু বলো না শুনি।

সাপুতারা। নামের মধ্যেই সরীসৃপের সর্পিল আনাগোনা। সরীসৃপ বললেই আদিম এক অনুভূতিতে শিরশির করে ওঠে শরীর। সরীসৃপ মানে যেন আদিমতার স্পর্শ। ছোট্ট শহর সাপুতারাকে বেষ্টন করে রয়েছে এমনই এক আদিম অরণ্য। মহারাষ্ট্র আর গুজরাত সীমান্তের খুব কাছে দক্ষিণ গুজরাতের আদিবাসী-অধ্যুষিত ডাং জেলার এক পাহাড়ি শহর এই সাপুতারা। এবং এটিই গুজরাতের একমাত্র শৈলশহর। তবে ব্রিটিশরা এর সন্ধান পায়নি। স্বাধীনতার পর এর আবিষ্কার। তাই বিলিতি নয়, শহরটাকে হাবেভাবে দেশিই বলা চলে।

যদিও বর্তমানে শহরে যে আধুনিকতার স্পর্শ তাকে পুরোপুরি দেশি বলা যাবে না, কারণ নানাবিধ পর্যটকের আনাগোনা। আসলে সাপুতারা এখন মোহময়ী আদিবাসী সুন্দরী, যার দেহে আধুনিকতার ঢেউ আছড়ে পড়েছে। প্রায় তিন হাজার একশো ছিয়ানব্বই ফুট উচ্চতায় বুকের মাঝখানে একটা ছোট্ট হ্রদ নিয়ে পাহাড়ের কোলে শুয়ে আছে শহরটা। সারা বছরই বেশ মনোরম আবহাওয়া। বর্ষায় সবুজ মখমলে মোড়া মেঘকুয়াশা জড়ানো ঝরনার মেখলায় সাপুতারা বোধ হয় সবথেকে সুন্দর, যে রূপ আমরা এখন দেখতে পাব না। তবু কল্পনা করে নিতে ক্ষতি কি?

দেখো রাজ, মালভূমির রুক্ষ পাহাড়ি ঢেউ পেরিয়ে এ বার আমরা পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ বেয়ে উঠতে শুরু করেছি।

হ্যাঁ, শুরু হল সহ্যাদ্রি পর্বতের গা বেয়ে ওপরে ওঠা। নীচে তাকিয়ে দেখো, ঘন অরণ্য। এই অরণ্যে আদিম উপজাতিদের বাস। এই অরণ্যসংকুল জীবনে সাপ যে তাদের সঙ্গী হবে, এ তো বলাই বাহুল্য। জানো কি সাপুতারায় সর্পগঙ্গা নদীর ধারে ফণাতোলা সাপের একটি বিশাল মূর্তি আছে। বিভিন্ন পালাপার্বণে, বিশেষ করে হোলি ও নাগপঞ্চমীতে স্থানীয় আদিবাসীরা ওই সর্পদেবতার পুজো করে।

ওই যে এ বার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে লেকটাকে। লেকের চারপাশ ঘিরে পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠেছে সাপুতারা শহরটা। ভারী চমত্‌কার না? আবার রোপওয়েও আছে দেখছি।

রোপওয়ে আছে, লেকের জলে নৌকাবিহার আছে, ভিউপয়েন্ট আছে, মিউজিয়াম আছে, এবং আরও কত কী আছে! এক দিনে এত কিছু কী করে দেখবে সোনা? তার চেয়ে বরং এসো ধীরেসুস্থে রয়েসয়ে যেটা ভাল লাগবে সেটাই দেখব। একদম মর্জিমাফিক। ঠিক আছে? রাজি তো?

রাজি, আমি রাজি। নিয়মের বেড়াজাল ভাঙতেই তো বেড়িয়েছি আজ তোমার সাথে। নিয়ম মেনে সব কিছু দেখেশুনে বেড়ানো আজ হবে না। আজ শুধু খেয়ালি এই মনদুটোর এ-দিক সে-দিক নিরন্তর খেয়ালিপনা।

তাহলে চলো টস করি, বেটিং, না রোপওয়ে। অ্যা অ্যা অ্যাই...মুঠো খুলছি। দেখো কী উঠল হাতে।

নৌকাবিহার। চলো চলো আর দেরি নয়। ওই শান্ত স্থির হ্রদের জল আমাদের ডাকছে।

গাড়ি নিয়ে এক্কেবারে লেকের কাছে চলে এলাম রাজের সাথে। ফেরিঘাট থেকে তড়িঘড়ি টিকিট কিনে বোটে চড়ে বসলাম। চারিদিকে পাহাড়ঘেরা হ্রদটা কেমন মায়াময় আবেশে ভরপুর। লেকের ওপর অনেক উঁচুতে রোপওয়ের তার চলে গিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট ছ’টা কেব্লকার পাশাপাশি ঝুলে রয়েছে শূন্যে। যাওয়ার তিনটে, আসার তিনটে।

কী হল? অমন ওপর দিকে তাকিয়ে কী দেখছ? রোপওয়ে চড়া হল না বলে আফশোস হচ্ছে?

রাজ, সে কথা ভাবলে তো এই জীবনটাই একটা মস্ত বড় আফশোস। না পাওয়ার দুঃখ কেবলই মনের ভেতর ঘুরতে থাকবে। কিন্তু না রাজ, যেটা পাইনি, যাকে চেয়েও পাইনি, তা নিয়ে আফশোস করে কী লাভ? সব কিছু কি এই এক জীবনে পাওয়া যায়? সব পেয়ে গেলে জীবনটা মনে হয় এতটা উপভোগ্য হত না। যা পেলাম তাই বা কম কী! এই যে তোমার সঙ্গে একটা দিন, রাজ! এটাই কি অনেক নয়?

রাজ সব সময় মুখে আমার কথার জবাব দেয় না। কথা বলে ওর চোখ। রাজের মতো অত সুন্দর চোখের চাহনি আমি দেখিনি আর কারও চোখে। অত মায়া দিয়ে আর কেউ আমাকে বেঁধে রাখতে পারে না। রাজ যখন তার মায়াময় চোখদুটো মেলে আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, মনে হয় কেন তোমাকে সারা জীবনের জন্য পেলাম না রাজ।

এই যে আমার সপনো কি রানি, এই বোটেই অনন্তকাল বসে থাকলে চলবে? সময় যে চলে যাচ্ছে দ্রুত। চলো, আমার পাশে পাশে একটু হাঁটবে না?

হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো। নৌকা এ বার তীরে ভেড়াই।

ভাললাগার সাথির সঙ্গে সময় কী তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়! তাই না? রাজের সাথে এ বার চললাম সাপুতারার একটি ভিউ পয়েন্টে। এই জায়গাটা অনেকটা পঞ্চগোনির টেবল টপের মতো। চারপাশে পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা, আদিবাসীদের ছোট ছোট গাঁও. টেবল টপের ওপর উট আর ঘোড়ার চলাফেরা শখের সওয়ারি পিঠে নিয়ে। চড়া রোদে উটগুলো বসে বসে ঝিমোচ্ছে। সওয়ারি এলে তবে ধড়মড়িয়ে উঠছে তাদের পিঠে নিয়ে। দুলকি চালে এক চক্কর ঘুরে আসছে। এক জায়গায় দেখি, বছর পাঁচেকের এক খুদে উটের লাগাম ধরে বসে আছে টুলের ওপর। তার মতো ছোট ছেলেরা উটের পিঠে চেপে মজা করছে, আর সে দেখভাল করছে উটের।

দারিদ্র কী নির্মম ভাবে ঠেলে দিয়েছে এই ছোট্ট বাচ্চাটিকে জীবনের নিষ্ঠুর দোলাচলে। জীবন ও জীবিকার কত বিচিত্র সমাপতন। এই বিশাল টেবল টপে কী নেই! উট, ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি, মোটর সাইকেল, ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য ফোলানো স্লাইড, ছোট্ট নাগরদোলা, খাবারের দোকান, ফটোগ্রাফার। এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে আবার বিশাল প্রমাণ সাইজের একটি খেলনা বাঘ। আসল বাঘের মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই। অতএব, এই পা রাখলুম নকল বাঘের গায়ে, তোলো ছবি। কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে শুকনো মুখগুলো।

রাজ, এই সব খেটে খাওয়া, রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা অচেনা মুখগুলোর ক্লান্ত রেখায় জীবনযুদ্ধের কত ইতিহাস লেখা আছে আমাকে বলতে পারো?

সে ইতিহাস তোমাকে নিজেই পড়ে নিতে হবে। তাই তো তোমায় নিয়ে পথে নামি। পথে না নামলে মানুষ দেখবে কেমন করে?

রাজের সঙ্গে পথে নামা মানেই মনের দৃষ্টি উন্মোচিত হওয়া। অভিজ্ঞতায় ভরে ওঠে ঝুলি। রাজের পাশে পাশে হেঁটে চলি। দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখি কী ভাবে পাহাড় আর জঙ্গলে মুখ ঢেকেছে আকাশের প্রান্তসীমা। এ সময় পৃথিবী আর আকাশটা কী বিশাল মনে হয়, আর নিজেদের সেই বিশালতার মাঝখানে মনে হয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অনন্তকাল ধরে যেন আমাদের এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসা ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বেঁচে থাকা জীবনের পর জীবন।

ফুরিয়ে আসছে সময়। নেমে আসি টেবল টপ থেকে। লেকের ধারে পাহাড়ের কোলে এক শিবমন্দির। নাগেশ্বর শিব। মন্দিরের খোলা চাতালে বসি দুজনে। কেউ কোনও কথা বলি না। জলের ধার থেকে বয়ে আসা নরম ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ জড়িয়ে আসে। মাথা রাখি রাজের কাঁধে। ক্লান্ত চোখে নেমে আসে তন্দ্রার ঘোর। সে ঘোর যখন ভাঙে রাজ, কোথায় তুমি? সচকিত হয়ে দেখি, আমি একা! মন্দিরের থামে এলানো ক্লান্ত শরীরটা বিদ্রোহ করে। তবু মন্দির চত্বর থেকে বাইরে বেরিয়ে খুঁজি রাজকে। চিত্‌কার করি, রা-জ! তুমি কোথায়? পাহাড় প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দেয় কিন্তু রাজ ফিরে আসে না।

না, উতলা হই না আমি। আমি জানতাম রাজকে আমি বন্দি করে রাখতে পারব না আমার প্রাত্যহিকতার গণ্ডিতে। সে আমার সমুদ্র। সাগরকে কি বেঁধে রাখা যায়? সে কূলহীন, অবারিত, মুক্ত সে আমাকে বারবার ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এতেই তার আনন্দ। বিদায় রাজ! আবার হয়তো কোনও দিন তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে। অন্য কোথাও ...অন্য কোনখানে। আমি অপেক্ষায় থাকব শুধু তোমারই জন্য....।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE