Advertisement
E-Paper

নদী-পাহাড়-প্রপাত-লাবণ্য

কেবলই মনে হচ্ছে আগামী কালই তো মুম্বইয়ের ডেরায় ফিরে যেতে হবে। কেমন এক মনকেমন ধাক্কা দিল মনের দরজায়। দূর বিজনে ঘুমিয়ে থাকা বসতি। ছাগলের পাল নিয়ে গাঁয়ের কিশোরীর ঘরে ফেরার আবারও সে সব দৃশ্য। চার পাশ কেমন যেন লঘু হয়ে ওঠে। পড়ন্ত বেলায় উদাসী হচ্ছে সামনের শস্য খেত। পাহাড় ও শস্য খেতের মন কাড়া দৃশ্য ক্যামেরায় ভরতে ভরতেই বিকেলের আলো নিভে আসতে থাকে। একাকার হয়ে ওঠে ভ্রমণ। লিখছেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।ঘুম থেকে এখনও জাগেনি এই শহরতলি, এই সড়ক-চিহ্ন। অস্ফুট ছঁুয়ে যাচ্ছে পর্যটন আখ্যান। আকাশের ছায়াটুকু নিয়ে কুয়াশা ছড়ানো স্নিগ্ধ সকাল। ভ্রমণ সুখের অভিসন্ধিকে কাজে লাগিয়েই দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে চলেছি অবসরের ঠিকানায়। গতকাল সপ্তমীর বিকেলে প্রবল এক ঝঞ্ঝা, সঙ্গে শিলাবৃষ্টি বয়ে গেছিল নভি মুম্বইয়ের তাবত অঞ্চল জুড়ে। ঘুম ঘুম সাতসকালে এই পথে আইরোলি পর্যন্ত সেই তাণ্ডবের ঘোষণা। চোখে পড়ছে শিকড় শুদ্ধ সমূলে উপড়ানো বড় গাছ, গাছালির অগণিত ভাঙা ডাল, দোমড়ানো বাতিস্তম্ভ, মোচড়ানো রাস্তার ডি’ভাইডার, ফেন্সিং এর রেলিং, হেলে পড়া বিদ্যুত্‌ খঁুটি, ঝুলে থাকা কেবল।

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০

২ অক্টোবর ২০১৪

হোটেল পারিজাত গার্ডেন

মুম্বই-নাসিক হাইওয়ে

NH3 সময় সকাল ৭.১০

ঘুম থেকে এখনও জাগেনি এই শহরতলি, এই সড়ক-চিহ্ন। অস্ফুট ছুঁয়ে যাচ্ছে পর্যটন আখ্যান। আকাশের ছায়াটুকু নিয়ে কুয়াশা ছড়ানো স্নিগ্ধ সকাল। ভ্রমণ সুখের অভিসন্ধিকে কাজে লাগিয়েই দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে চলেছি অবসরের ঠিকানায়। গতকাল সপ্তমীর বিকেলে প্রবল এক ঝঞ্ঝা, সঙ্গে শিলাবৃষ্টি বয়ে গেছিল নভি মুম্বইয়ের তাবত অঞ্চল জুড়ে। ঘুম ঘুম সাতসকালে এই পথে আইরোলি পর্যন্ত সেই তাণ্ডবের ঘোষণা। চোখে পড়ছে শিকড় শুদ্ধ সমূলে উপড়ানো বড় গাছ, গাছালির অগণিত ভাঙা ডাল, দোমড়ানো বাতিস্তম্ভ, মোচড়ানো রাস্তার ডি’ভাইডার, ফেন্সিং এর রেলিং, হেলে পড়া বিদ্যুত্‌ খুঁটি, ঝুলে থাকা কেবল। থানে পর্যন্ত প্রায় এমনই সব ঝঞ্ঝা বিধ্বস্ত এলাকা। তার পর জাতীয় সড়ক ৩ আসতেই মসৃণ সড়ক পথ।

পদঘা, ভেসিন্দ অঞ্চল থেকেই পথের দু’পাশে ধাবার বিজ্ঞাপন। আসানগাঁও। সড়কের বাম পাশে এই ধাবায় আমাদের দিন চারেকের জন্য বরাদ্দ সওয়ারি গাড়ি নিয়ে সটান ঢুকে পড়ি প্রাতরাশের জন্য। শুদ্ধ শাকাহারি রেস্তোরাঁ। যদিও আজ দুর্গাষ্টমী। আজ তো হিন্দু মতে শুদ্ধ নিরামিষ খাওয়ারই দিন। এক প্লেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, মশালা-পাও, ইডলি-সম্বর আর ফিল্টার কফির অর্ডার দিয়ে, অপেক্ষার ফাঁকে একটু ডায়েরি লিখে নিচ্ছি। এ বারে ক্যালেন্ডারের পাতায় ছুটিটাও পড়েছে বেশ জমিয়ে। এমন একটা লং উইকএন্ড পেলে মুম্বইয়ে বেশির ভাগ মানুষ জন ভিড় জমান কাছে পিঠের পর্যটন অঞ্চলগুলোয়। দুর তো আর বেশি কিছু নয়। নিজস্ব বাহনে বা গাড়ি ভাড়া করেই চলে আসা যায় কাছে বা কিছুটা দূরের মুম্বইয়ের আশপাশের দেখা না দেখা অঞ্চলগুলোয়। এ বার যেমন দুর্গাপুজোর ছুটি ও সপ্তাহান্তিক ছুটিকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা করছিলাম কোথায় যাই কোথায় যাই। খানিক আবছা জানা আবছা শোনা ভাণ্ডারদারা না লাভাসা। মনস্থির করতে খানিকটা সময়ও নিই। অতঃপর ঠিক হয় সহ্যাদ্রী পাহাড়ের কোলে, প্রকৃতির রম্যতায় ভাণ্ডারদারায় তিন রাত চার দিনের অবসরের ঠেক ও নিপাট আয়াসের।

২ অক্টোবর ২০১৪

লেক ভিউ রিসর্ট

ভাণ্ডারদারা

গ্রাম-সেন্ধি, তা লুক-আকোলে

মহারাষ্ট্র ৪১৪৬০১

সকাল ১১:২০

প্রখর বৃষ্টি দিনে প্রভারা নদীর জলপুষ্ট উইলসন জলাধার যখন জল ছাড়তে থাকে একটু একটু করে সে দৃশ্য নাকি ক্যামেরার লেন্সে টুকে রাখার মতো ভরা বর্ষায় ভাণ্ডারদারার তখন অন্য রূপ। মেঘ ভর্তি কুয়াশার চাঁদোয়ায় সে সময় ঢাকা থাকে তামাম ভাণ্ডারদারা নামের পাহাড়ি গ্রামটি। সহ্যাদ্রী পাহাড়ের কোলে, সবুজাভার বর্ণময়তায় ৭৫০ মিটার উচ্চতায় নদী-হ্রদ-প্রপাত ও পাহাড় ঘেরা ভাণ্ডারদারা--- ছোট্ট ছুটি ও অবকাশের মনোরম ঠাঁই।

প্রকৃতির অফুরান লাবণ্যের মাঝে মুম্বই থেকে ভাণ্ডারদারা সড়কপথে পাড়ি জমাতে সময় লাগলো ঘণ্টা তিনেক মতো। দূরত্ব তো আর তেমন বেশি কিছু নয়, ১৮৫ কিমি মাত্র। আসানগাঁও পেরিয়ে আর কিছু পথ যাওয়ার পর খারাদি, কামারা এমন সব জনপদ পেরিয়ে ইগাতপুরী। ঘাট রোড অর্থাত্‌ পাহাড়ি পথ চলা শুরু। সড়ক মানচিত্রে নিরবন্তর পাহাড়ি বাঁক। কাছে বা দূর নাগালে সহ্যাদ্রীর তরঙ্গমালা। ৫৮০ মি উচ্চতায় অবস্থিত ইগাতপুরীকে বলা হয় ‘TOWN OF DIFICULTTIES’. স্বব্ধতার অতলে হারিয়ে যেতে থাকা। চোখের সীমানায় সহ্যাদ্রী পাহাড়ের তরঙ্গায়িত বৈভব। প্রকৃতির আঙিনায় দিগন্ত ঘেরা সেই সহ্যাদ্রীর মায়া আর সবুজের আলিঙ্গন। প্রকৃতির সঙ্গে গল্প করতে করতে কিছুটা পথ পেরিয়ে এসেছি। ইগাতপুরী থেকে ঘোটি নামের জনপদটি ৮ কিমি। মূল সড়ক NH3 চলে গেছে নাসিক। আমরা ধরলাম এ বার ডান দিকের SH44 পথ। আরও প্রায় ৩২ কিমি পথ সাঁতরে গন্তব্য শেষ হল ভাণ্ডারদারা MTDC লেক ভিউ রিসর্ট-এ। ঘর গোছানো নিপাট বাঙালির মতো আগেভাগেই মহারাষ্ট্র পর্যটনের এই আবাসটি বুক করা ছিল। ভাগ্যিস। না হলে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতেই রাত কাটানো অথবা ফিরে আসতে হত। ওই যে বলছিলাম, এ বার ক্যালেন্ডারে আস্ত লম্বা সপ্তাহান্তিক ছুটি থাকায় এখানে ভিড়টাও এ বার বড্ড বেশি।পাহাড়টিলায় আদিগন্ত সবুজ,আর্থার লেক-কে পশ্চাদপটে রেখে লেক ভিউয়ের ছড়ানো আস্তানা। আশ্বিনের হাওয়ায় মৃদু দুলছে ফুলের বাগিচা। গাছের পাতা। আলতো শীত পরশ। তেমন বেলা হয়নি। আর এক মুহূর্তও হোটেলের ঘরে নয়। ক্যামেরা নিয়ে সমস্ত হোটেল চত্বরটা ইতিউতি বেড়াতে থাকি। কখনও গার্ডেন চেয়ার টেনে আর্থার লেকের নীলাভ জলের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি। আর্থার হ্রদের জলে নীল আকাশের ছায়া, শরত্‌ মেঘের ছায়া।

২ অক্টোবর ২০১৪

লেক ভিউ রিসর্ট

ভান্ডারদারা

সন্ধে ৭:৫০

শেষ দুপুরে আলগা ভাত-ঘুম শেষেই আবার বেরিয়ে পড়ি। বেড়াতে এসে ঘুমকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নই মোটেই। সূর্য্যি আলো থাকতে না ঘুরলে মনের খুশিতে ছবি তোলা ও ঘোরা কোনওটাই হবে না। অর্কদেব ডুব দেওয়া মাত্রই এই সব পাহাড়তলি আরও নিশুতি হয়ে যায়।

হোটেল ছাড়িয়ে পথটা খানিকটা উতরাই বেয়ে চলে যাচ্ছে। লোকালয় ছেড়ে এ বার শুনশান সড়ক। গাছগাছালির ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে উইলসন ড্যাম। প্রভারা নদীর মদতপুষ্ট এই জলাধারাটি ভাণ্ডারদারার মূল আকর্ষণ। ১৫০ মিটার উচ্চতায় এর অবস্থান। ভারতের প্রাচীনতম এই জলাধারটি হাই অলটিটিউটে অবস্থিত মর্মরে তৈরি জলাধারও। স্যর লেসলি ওর্মে উইলসন নামের ব্রিটিশ আধিকারিকের তত্ত্বাবধানে ১৯১০ সালে নির্মাণকার্য শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯২৬ সালে। জলাধারে নীচে বেড় দেওয়া একটা সুদৃশ্য বাগানও আছে। তদানীন্তন বম্বের গভর্নর ১৯২৬ সালের ১০ ডিসেম্বর এই জলাধারটি উদ্বোধন করেন এবং উইলসন সাহেবের কৃতিত্বের স্মারক হিসাবে জলাধারটির নামকরণ করেন উইলসন ড্যাম। রঙিন নৌকায় সওয়ার হয়ে বিনোদিনী অভিজ্ঞতার শরিক হচ্ছেন উত্‌সাহী পর্যটক। স্বচ্ছ নীল জলে নৌবিহারে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে ঢলে পড়া বিকেলের আঁচ মেখে নিচ্ছি। প্রকৃতির আবিলতায় নীল মোহে চূড়ান্ত নৈঃশব্দের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া। নৈঃশব্দ তো শুধু মনে। ও দিকে কলকাতার পুজোমণ্ডপে তো আজও দুর্গার অষ্টমী ও নবমী পুজো। সন্ধে যত নামল আকাশে নবমী নিশির চাঁদও তত মুখর হল। এক বার লোকালয় বাস টার্মিনাসের কাছ থেকে গরম এলাচি চা খেয়ে আসা হল। এমনই হাঁটব বলে। রাতে লাচ্চা পরোটা কড়াই পনির গ্রিন স্যালাড। কিচ্ছুটি করার নেই এখন। মোবাইলের টাওয়ার এই আছে এই নেই। রাত বাড়ে। চোখে ঘুমের ক্লান্তি।

৩ অক্টোবর

লেকভিউ রিসর্ট

ভাণ্ডারদারা

দুপুর-৩.৩০

পুব দিগন্তে আলোর আভাস ফুটে উঠতেই ঘুম চোখে বাইরে আসি। আর্থার লেকের জলে কুয়াশার হালকা আস্তরণ। বাতাসে হালকা হিমেল পরশ। আবারও খানিক ঘুম দিয়ে নিই। কিছু পরে জানলার পর্দা সরাতেই সকালের রোদ ছিটকে এল। ভাণ্ডারদারার পাহাড়ের খাঁজে তার প্রস্ফুটন। ভাণ্ডারদারা থেকে সড়কপথে অমৃতশ্বর শিবমন্দিরের দূরত্ব ২৪ কিমি। ১১ শতকের স্বয়ম্ভু শিবমন্দির। উইলসন ড্যাম পেরিয়ে সামান্য এগিয়ে ডান হাতি পথ চলে গেছে গ্রামের মধ্য দিয়ে। নিঝুম গ্রাম ছোট ছোট নদী খাল ধান খেত। আজ দশেরা। বেশির ভাগ পাথুরে নদীর সেচ খালে স্থানীয় আধিবাসীরা নিজেদের ট্র্যাক্টর, মোটর সাইকেল, স্কুটার ধোয়াধুয়ি করছে। ফুলের লম্বা লম্বা মালা বিকোচ্ছে রাস্তার ধারে অস্থায়ী দোকানে। দশেরায়, ভগবানকে নিবেদিত করে যে যার যানবাহনকে ফুলের মালায় সাজাবে। মহারাষ্ট্রে প্রায় প্রতিটি জায়গায় দেখেছি দশেরার সকাল থেকেই গাড়ির ইঞ্জিনে ফুলের মালা চড়ানোর রীতি। ভাণ্ডারদারা ও আশপাশের প্রায় প্রতিটি স্থানীয় মানুষকেই দেখছি একে বারে নিজস্ব মরাঠি পোশাক পরিহিত। স্থানীয় সব পুরুষদের পরণে সাদা শার্ট, মাথায় সাদা টুপি অবশ্যই রয়েছে। সঙ্গে সাদা পাজামা বা সাদা প্যান্ট অথবা ধুতি। কারওর পরণে অন্য রঙা প্যান্ট যদিও বা থাকে, কিন্তু সাদা টুপি ও সাদা শার্ট অবশ্যই। স্থানীয় মহিলাদের পরণে কোঁচা মেরে মরাঠি স্টাইলে রঙিন ছাপা শাড়ি। এ সব অঞ্চলে আধুনিকতার রেশ কিছুটা ছুঁয়ে গেলেও, নিজেদের কৃষ্টি-রীতি-প্রথা-পরিচ্ছদকে এই সব স্থানীয়রা আজও সযত্নে আগলে রেখেছেন।

কখনও পথের পাশে সুউচ্চ পাহাড়টিলার প্রাচীর কখনও বা উপত্যকা, হরিয়ালি। ছাগলের পাল নিয়ে গ্রামীণ কিশোরী গাছের একটা ভাঙা ডাল নিয়ে রাস্তার মাঝ বরাবর হেঁটে চলেছে। গাড়ির হর্ন শুনে গৃহপালিত ছাগলের দঙ্গলকে সেই ভাঙা ডাল মেরে কপট শাসন করে নিরাপদে সরিয়ে গাড়ির রাস্তা ছেড়ে দেয়। কোনও মহিলা তার নিজের ও তার বালক পুত্রের মাথায় গাছের ভাঙা কাঠকুটো চাপিয়ে আপনমনে ঘরের পানে চলেছে। ওই কাঠকুটোই আজকের জন্য বরাদ্দ জ্বালানির সঞ্চয় হয়ত বা। কোমরের পেছনে গোঁজা এক ফালি কাস্তে। এ সবই এখানকার পরিচিত দৃশ্য। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে বিখ্যাত আমব্রেলা ফলস। যদিও এই মুহূর্তে গোলাকৃতি পাহাড়টিতে জলের চিহ্নমাত্র নেই। তবে ভরা বর্ষায় উইলসন ড্যামের স্লুইস গেটগুলো যখন খুলে দেওয়া হয় কিংবা কৃষিকাজের প্রয়োজনেও যখন জল সরবরাহ অনিবার্য হয়ে পড়ে তখন কৃত্রিম এই প্রপাতটির জলোচ্ছ্বাস দুর্দান্ত দেখায়। বহু দূর পর্যন্ত নজরে আসে আপাত শুষ্ক ওই ছাতা সদৃশ্য পাহাড় প্রাচীর।

অমৃতেশ্বর মন্দির প্রান্তে এসে পৌঁছাই। কালো মর্মরে সৃষ্ট মন্দির গাত্রের স্থাপত্য অসাধারণ। এই অঞ্চলে এই কালো পাথর পাওয়া যায়, যেহেতু ১১ শতকে ‘হেমাদপানথি শৈলিতে’ নির্মিত ও খোদিত মন্দিরটি আকর্ষণও অনবদ্য। পবিত্র মন্দির চত্বরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পুজোর ডালি, স্থানীয় শালুক ফুল, নারকোল ফুলের মালা নিয়ে কিছু বালিকা বিক্রির অপেক্ষায়। গর্ভগৃহের ভেতর স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ। পাশেই বেশ বড় একটা জলা। এখানে দুরাগত পরিযায়ী পাখিরা প্রজননের সময় ভিড় করে। ব্ল্যাক ইবিশ, হেরন, ইগ্রেট, জলমোরগ, সাদা গলা স্ট্রক এই সব পরিযায়ী ও ভারতীয় পাখিদের অবাধ চরাচর এই পরিখাগুলিতে। মাটি খুঁড়ে পাওয়া কিছু প্রাচীন মূর্তি পাথরে খোদিত শিলালিপি ইত্যাদি প্রাচীন এক অশ্বথ্ব বৃক্ষের নীচে ঠেস দিয়ে রাখা। একটি ছোট্ট পুষ্করিণীও রয়েছে। খনন কার্যে পাওয়া সেই পুষ্করিণীর জলে প্রচুর মাছ। আর্থার লেক থেকেও নাকি ঘণ্টা খানেকের নৌ যাত্রায় এখানে আসা যায়। সমস্ত নৌ যাত্রাটুকু সম্মোহিত করে রাখবে পরমা প্রকৃতি। কাছেই অগস্ত্য মুনির আশ্রম। লাল রঙা আশ্রমটিতে সাদা একটি মন্দির। কথিত আছে পুলস্ত্য মুনি ও ঊর্বসীর পুত্র অগস্ত্য শুধুমাত্র জল ও বাতাসের ওপর নির্ভর করে টানা এক বছর এখানে কঠোর সাধনা করেছিলেন। অগস্ত্য মুণির সাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবতারা তাঁকে গঙ্গার বারি সিঞ্চন করেন। যেটি প্রভারা নদী নামে খ্যাত। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা এসেছেন এই আশ্রমে। শ্রীরামচরিতমানসে আছে বারণ বধের অস্ত্রও অগস্ত্য মুণি রামকে দান করেন।

আরও একটি অদ্ভুত কাহিনিও কথিত আছে, মহর্ষি অগস্ত্যর শিষ্য বিন্ধ্যপর্বত নারদেব অভিশাপে ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকলে দেবতারা প্রমাদ গোনেন। তাঁরা অগস্ত্যকে অনুরোধ করেন যথাবিহিত উপায়ের কিছু ব্যবস্থা করার। অগস্ত্য মুনি স্ত্রী লোপামুদ্রাকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যের পথে অগ্রসর হন। বিন্ধ্য গুরু ও গুরুপত্নীকে মাথা নত করে অভিবাদন করেন। অগস্ত্য মুণি সেই অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং ‘তথাস্তু’ বলে আরও বলেন যে তিনি না ফেরা পর্যন্ত বিন্ধ্য পর্বত যেন সে ভাবেই অপেক্ষায় থাকেন। অগস্ত্য মুণি সে যাত্রায় আর ওই পথ দিয়ে ফেরেন না। সেই জন্য ‘অগস্ত্য যাত্রা’ বলে একটি শব্দবন্ধ চালু আছে। কবি শঙ্খ ঘোষের এই নিয়ে একটা অসামান্য কবিতা আছে।

৩ অক্টোবর ২০১৪

লেক ভিউ রিসর্ট

ভাণ্ডারদারা

সময়-রাত ৯.৪০

অমৃতেশ্বর মন্দির অগস্ত্য আশ্রম বেরিয়ে হোটেল ফিরে স্নান, মধ্যাহ্নভোজন। বাসমতি চালের ভাত, ডাল মাখানি, গ্রিন স্যালাড, তায়া ভিন্ডি, পনির ৬৫ প্রন মশালা। ডাইনিং হলেই জমিয়ে আলাপ হল। জি টিভি ডান্স বাংলা ডান্স রিয়েলিটি শোয়ের একটা সিজনের সেলেব বিচারক যোগেশ তার পরিবারের সঙ্গে। জি বাংলার অনুষ্ঠানে দেবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সবাই বলতেন ‘যোগেশ স্যার’ ‘যোগেশ জি’ ইত্যাদি। আজ দশেরা। পাহাড়ি এই ছোট্ট গ্রামটিতে আজ উত্‌সবের মেজাজ। ভাণ্ডারদারার পিক সিজন পুরো মনসুন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর। বৃষ্টির মরসুমে এখানকার অন্যতম প্রভারা নদী, শাখা নদী নালা, হ্রদ ছোট বড় প্রপাতগুলি যেন খিল খিল হেসে ওঠে অনাবিল। হেলে কুটি কুটি ওই সবুজের পরত মাখা সহ্যাদ্রীর পাহাড়ি ঢেউ। রান্ধা ফলস, স্পিলওয়ে ফলস, আমব্রেলা ফলস সবাই তখন নিজেদের মৃদু গল্প নিয়ে কারুসাজ রেখে যায়। যদিও এই প্রপাতগুলি প্রতিটিই বলতে গেলে মরসুমি প্রপাত। বৃষ্টি ধারা পেলেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। প্রভারা নদীর একটি শাখা ১৭০ ফুট নীচে গিরিখাত-এর ভেতর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রপাতটির এক দিকে প্রকাণ্ড মধুচক্র আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা দড়ির সাহায্যে জঙ্গলে নেমে মধু সংগ্রহ করে। এখানকার জঙ্গলে এক ধরনের বিশালাকৃতি কাঠবিড়াল দেখা যায়। জৈববিজ্ঞান পরিভাষায় বলা হয় ‘RATUFA INDICA’। চুপচাপ নিরিবিলি-তে এদের দেখতে পাওয়াও যায় সহসা। আমরা যদিও যাইনি, তবে, ওয়াইল্ড লাইফ প্রেমীদের ভারী পছন্দের জায়গা কালসুবাঈ-হরিশচন্দ্রগড় ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। ভাণ্ডারদারা থেকে হরিশচন্দ্র গড় প্রায় ৪৫ কিমি দূরে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ, অর্ধেক নাম জানা ও অর্ধেক নাম শোনা পাখপাখালি, নেকড়ে, শেয়াল, হায়না, লেপার্ড, বনবিড়াল, বাকিং ডিয়ার, বন্যশুয়োর এ সব দেখা যায়। পক্ষীবিশারদদের ঈপ্সিত পাখিদের দেখা পাওয়ার, ক্যামেরাবন্দি করার মোক্ষম অঞ্চল এই হরিশচন্দ্রগড় স্যাংচুয়ারি। বাইরে আতসবাজির শব্দ কানে আসছে। আকাশ জুড়ে আলোর রোশনাই। কাছেপিঠে কোথাও হয়তো ‘রাবণ দহন’ হচ্ছে। হোটেল চত্বরে বসে দেখতে না পেলেও আভাস পাচ্ছি। ইতিমধ্যে মোবাইলে ঘন ঘন বিজয়ার শুভেচ্ছা। বার্তা আসছে। প্রত্যুত্তর...

৪ অক্টোবর ২০১৪

ভিউ রিসর্ট

ভাণ্ডারদারা

সময়-দুপুর ২.৩০

পাহাড় দেখার কী আর শেষ আছে। আশ্চর্য ধারাবাহিকতায় সহ্যাদ্রী ও তার রূপ আভিজাত্য লাবণ্য মেলে ধরে পর্যটক মনে। ভিন্ন রূপে ভিন্ন অবয়বে। বছরভর সুন্দর আবহাওয়া শান্ত বাতারণ ও প্রাকৃতিক ব্যাঞ্জনার দুনির্বার হাতছানি টের পাওয়া যায় পর্যটক মনে। ভাণ্ডারদরায় দ্রষ্টব্য স্থানগুলো এক দিনেই হয়ত দেখে ফেলা যেত কিন্তু আমরা তো এসেছি বাড়ির বাইরে নির্ঝঞ্ঝাটে কটা দিন নিপাট নির্জনতায় বুঁদ হয়ে থাকতে। পাহাড়ের ঘেরাটোপে স্বচ্ছ নির্মল জলের আর্থার লেক। প্রভারা নদীর উদ্বৃত্ত জলরাশি থেকে সৃষ্ট বিশাল এই হ্রদ। ভাণ্ডারদারায় ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ জামানার এক মুখ্য প্রযুক্তিবিদ আর্থার হিল-এর তত্ত্বাবধানে এখানে বিশাল জলবিদ্যুত্‌ কেন্দ্র হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট ফেজ ওয়ান সৃষ্ট হয়। এখানে ১২ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্‌ সরবরাহ করা হয়। তদানীন্তন বম্বে রেসিডেন্সির এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পর আর্থার হিল সাহেবের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ হ্রদটির নাম হয় ভাণ্ডারদারা হ্রদ বা ‘আর্থার লেক’। ভাণ্ডারদারার গর্বিত অহং এই আর্থার লেক।

অর্থ শতাব্দী পর্যন্ত ভাণ্ডারদারা নিজাম ও মোঘলদের দখলে ছিল। মরাঠা বীর শিবাজি রাজে ভোঁসলে নিজে দুই বার ১৬৫৭ ও ১৬৬৫ সালে আহমেদনগর আক্রমণ করেছিলেন। এখানে ভৌগোলিক অবস্থানগত প্রাকৃতিক সুবিধার জন্য, এবং সহ্যাদ্রী পবর্তমালা ঘেরা সেই প্রাকৃতিক তথা ভৌগোলিক প্রাচীরকে কাজে লাগিয়ে এখানকার শাসক দল নিশ্চিন্তে রাজ্যপাট চালাতে পারতেন। এই পাহাড়শ্রেণী বহির্শত্রু মোকাবিলা প্রতিহত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল মহারাষ্ট্রের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট কালসুবাঈ (৫৪০০ ফুট) ব্যাপক ভাবে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণ শিবিরের কাজ করত।অদিবাসীরা স্বতন্ত্রতা সংগ্রামের সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৮১৭ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি সমগ্র আহমেদনগর অঞ্চলটি নিজ অধীন করে নেয়।

৪ অক্টোবর ২০১৪

লেক ভিউ রিসর্ট

ভাণ্ডারদারা

সময়-রাত ৮.০০

বিকেলের দিকে গেছিলাম ঘেটির দিকে। ভাণ্ডারদারার আতিথেয়তা খানিক এমনি এমনি ঘুরে বেড়াতে। তছনছ হয়ে যাচ্ছে ভ্রমণরসিক ভাবুক মন। এমন কী মনের সব কটা আগল। আমাদের সামনে তো পুরোদস্তুর মতো উপুর হয়ে আছে উপত্যকা। সর্ষে খেত-প্রপাত-গ্রামীণ বাড়িঘর-স্থানীয় নদী নালা ঝর্না-বাগিচা পাহাড়। তেমন কিছু তো আর করারও নেই। আমাদের গাড়ির সারথি বাব্বু নায়েকও আমাদের ঘুরিয়ে আনে ভাণ্ডারদারার কাছে-পিঠে এ দিক সে দিক। মসৃণ সড়কপথের দু’পাশে চোখ মেলে দু’চোখে সবুজ ভরে নিই। এখানকার কালুসাবাঈ শৃঙ্গটি ট্রেকার প্রেমীদের জন্য পছন্দের ঠিকানা। পাহাড় চূড়ায় ছোট্ট একটা মন্দির আছে দেবী কালসু নামে। কোলি সম্প্রদায়ের গৃহদেবতা এই কালসুদেবী। উত্‌সবের দিনে এরা আসেন পুজো দিতে। কথিত আছে কালসু নামে এক বালিকা অবাক বিস্ময়ে পাহাড় জঙ্গলে আপন মনে ঘুরে বেড়াত। একদিন সে পাহাড়তলির এক গ্রামে এল। কাজের সন্ধানে। কালসু জানিয়ে রেখেছিল আর যা কাজ হোক, বাসন ধোয়া মাজার কাজ সে করতে পারবে না। তবু এক পরিবার যখন তাকে সেই কাজের জন্যই বহাল করতে চাইল, বালিকা তত্‌ক্ষণাত্‌ সেখান থেকে পাহাড়চুড়ায় পালিয়ে গেল। এবং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গেছিল। ঘরে ফেরা পাখির ডাকে মুখরিত বিকেলটা আমাদের কাছে বেজায় মনোগ্রাহী। কেবলই মনে হচ্ছে আগামী কালই তো মুম্বইয়ের ডেরায় ফিরে যেতে হবে। কেমন এক মনকেমন ধাক্কা দিল মনের দরজায়। দূর বিজনে ঘুমিয়ে থাকা বসতি। ছাগলের পাল নিয়ে গাঁয়ের কিশোরীর ঘরে ফেরার আবারও সে সব দৃশ্য। চার পাশ কেমন যেন লঘু হয়ে ওঠে। পড়ন্ত বেলায় উদাসী হচ্ছে সামনের ওই শস্য খেত। পাহাড় ও শস্য খেতের মন কাড়া দৃশ্য ক্যামেরায় ভরতে ভরতেই বিকেলের আলো নিভে আসতে থাকে। একাকার হয়ে ওঠে ভ্রমণ। তত দূর নয় ওই অতিথি আবাস। সূর্য্যির ফিরে যাওয়ায়, ম্লান হলদেটে আলোয় চোখে চোখে শুধু নদী প্রপাত ওই পাহাড়...।

mumbai bhandadara tour madhuchchanda mitra ghosh madhuchanda mitra ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy