একজনের অভিযোগ কাকাকে মশলাদার বাটাটা বড়া খেতে দেওয়া নিয়ে। জবাবে অন্যজন বলছেন, কিসের মশালা! বাবাকে রোজই দেওয়া হতো স্বাস্থ্যকর, সহজপাচ্য চিকেন স্যুপ!
একজনের অভিযোগ, কাকাকে পিছন থেকে ছুরি মারা হয়েছে। তাঁর উষ্মা, তেল আর মশলা খাইয়ে আয়ুর শেষটুকু আরও হ্রস্ব করা হয়েছে। এই অনাচার সহ্য করতে না পেরে, আর কিছুটা কাকার অনুরোধেই নিজের হেঁশেল থেকে স্বাস্থ্যকর খাবার পাঠাতেন তিনি।
অভিযোগ করছেন শিবসেনার উত্তরাধিকারে বঞ্চিত বালসাহেব ঠাকরের ভাইপো রাজ ঠাকরে। আর অভিযোগের তির যার দিকে, তিনি বালসাহেব পুত্র উদ্ধব। ভোটের হাওয়া গরম হয়ে উঠতেই মহারাষ্ট্রের মূল সমস্যাগুলিকে পাশ কাটিয়ে আবেগের এই পারিবারিক যুদ্ধের কেন্দ্রে বালসাহেব ঠাকরে। এই শহর তথা রাজ্যে লোকসভা ভোট। অথচ তিনি নেই। গত চল্লিশ বছরে এমন ঘটনা দেখেননি মুম্বইবাসী। আন্ধেরি থেকে নভি মুম্বই, বান্দ্রা থেকে অভিজাত জুহু-র পল্লি শহরে ছড়ানো শিবসেনা-বিজেপির হাজারো বিলবোর্ডে, এবং ভোট প্রচারে দেখা এবং শোনা যাচ্ছে বালসাহেব ঠাকরেকে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বালসাহেব বিনে শিবসেনার সেই জৌলুস যে কিছুটা ফিকে, এমনটাই মনে করছে গোটা মুম্বই।
জীবিত অবস্থায় ইনিই ঠিক করতেন মুম্বইয়ের অনেকানেক ভবিষ্যৎ। ঠিক করতেন পাকিস্তানিরা এখানকার মাঠে খেলবেন কিনা। বিবেচনা করে বিগ বি-কে জানাতেন ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে তাঁকে মানাবে কিনা। এ বার প্রশ্ন উঠেছে, মাত্র দেড় বছর আগে বাল ঠাকরের চিতার আগুন যে আবেগ তৈরি করেছিল মুম্বইকরদের মনে, তার উত্তরাধিকার এ বার কী ভাবে সামলাচ্ছেন পুত্র উদ্ধব ঠাকরে?
ভোটগলিতে কান পাতলে একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে দু’টি পরস্পরবিরোধী উত্তর। সামলাতে পারছেন, এবং পারছেন না! অর্থাৎ একদিকে বালসাহেবের মৃত্যুর পর সেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই সামলাতে পেরেছেন ‘সংগঠক’ উদ্ধব ঠাকরে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে বাবার মতো ব্যক্তিত্ব, গ্ল্যামার তাঁর নেই। লোক টানার, ভোটারদের প্রভাবিত করার ক্ষমতাও কম।
কোলাবায় ৫৫ বছর ধরে পার্সি রেস্তোরাঁ চালাচ্ছেন জামশিদ। সেলস কাউন্টারে বসে মুম্বইয়ের ইতিহাসকে দীর্ঘদিন নজর করে চলেছেন তিনি। বলছেন, “শিবসেনার প্রচারে যে ভিড় রাস্তায় দেখা যেত, এ বার তা উধাও। শিবসেনার জৌলুসটা নিয়ে গিয়েছেন রাজ ঠাকরে।”
ভোটের আগে দাদারে বিশাল শিবসেনা ভবনটি সুনসান। গড় আগলে একা বসে রয়েছেন মুখপাত্র হর্ষল প্রধান। জানা গেল, শরীর সামান্য অসুস্থ উদ্ধবের। তাই নিয়মিত আসছেন না ভবনে। বাছাই করা প্রচারসভাগুলি সারছেন কেবল। গোটা ভবনটি জুড়ে বিরাট বিরাট বালসাহেবের ফোটোগ্রাফ আর তৈলচিত্র। “যারা মনে করছেন উনি এ বার নেই বলে দুর্বল হয়ে গিয়েছে সেনা, তারা কিন্তু ভুল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করছেন” দাবি হর্ষলের। তাঁর যুক্তি, “গত দশ বছর ধরেই বাল সাহেব কার্যত মার্গদর্শক ছিলেন। সেনার দিনগত বিষয়গুলি তিনি দেখতেন না। বছরে দু’টি জনসভা করতেন। একটি নির্বাচনের সময়, অন্যটি শিবাজি পার্কে দশেরার সময়। সংগঠনের পুরো কাজটাই উদ্ধব দেখে আসছেন।”
আপাতত পুত্র এবং ভাইপো দু’জনেই নির্বাচনের প্রচারে এটা প্রমাণ করার চেষ্টায় মেতেছেন যে, কে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন শিবসেনার প্রাক্তন প্রধানের। ঝাঁঝালো ভঙ্গিতে উদ্ধবকে আক্রমণ করে রাজ জনসভায় বলছেন যে তেল-মশলা দেওয়া বড়া খাইয়ে বালসাহেবকে কার্যত শেষ করে দিয়েছেন উদ্ধবেরা। পাল্টা জবাব দিচ্ছেন উদ্ধবও। তবে মরাঠি পত্রিকা ‘চিত্রলেখা’-র সম্পাদক, তথা ‘ঠাকরে-লাইফ অ্যান্ড স্টাইল’ বইটির লেখক দীনেশ মহারাও মনে করছেন এই বিষয়টি ভাল চোখে দেখছে না মরাঠি মনন। তাঁর কথায়, “এই রাজ্যের মানুষ বালসাহেবকে অন্তর থেকে ভালবাসেন। তাঁকে ঘিরে কাদা ছোড়াছুড়ি মানুষ কতটা ভাল ভাবে নেবেন, সন্দেহ রয়েছে।
তাছাড়া ব্যক্তিগত আক্রমণের জেরে মূল সমস্যাগুলি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। কৃষক আত্মহত্যা, রেল পরিকাঠামোর অভাব, বাসস্থানের তীব্র সঙ্কট, কর্মসংস্থানের মতো বিষয়গুলি মরাঠিদের প্রত্যেক দিনের সমস্যা। বালসাহেব শেষজীবনে কী খেতেন তা জেনে মানুষ কেন ভোট দেবেন?”
রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা বা এমএনএস-কে কংগ্রেসের ফাঁদ বলেই প্রচার করছে শিবসেনা। তাদের বক্তব্য, মরাঠা ভোট ভাগ করার জন্য কংগ্রেস কাজে লাগিয়েছে রাজকে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা হল, রাজও কিন্তু মোদীর নামেই ভোট চাইছেন! মোট ৪৮টি আসনের মধ্যে ২৪টিতে লড়াই করছে বিজেপি, ২০টিতে লড়াই করছে শিবসেনা। বাকি চারটি আসন দেওয়া হয়েছে বিজেপি-র সঙ্গী আরপিআই-সহ চারটি দলকে। বিজেপি-শিবসেনার বিরোধী পক্ষ হয়েও কিন্তু পুণে এবং ভিওয়ান্দি ছাড়া বিজেপি-র বাকি ২২টি আসনের কোথাও কোনও বিরুদ্ধ-প্রার্থী দেননি রাজ। এ বিষয়ে সমঝোতা হয়ে গিয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব এবং রাজ ঠাকরের। অথচ শিবসেনার বিরুদ্ধে সবক’টি আসনেই লড়ছে এমএনএস।
সব জেনে বুঝেও কেন চুপ করে বসে রয়েছেন উদ্ধব? শিবসেনার বক্তব্য, চুপ করে তিনি মোটেই বসে নেই। নিতিন গডকড়ী এবং রাজের গোপন বৈঠকের পর উদ্ধব দিল্লিতে ফোন করে সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন জোট ভেঙে দেওয়ার। তার পরই নাকি মোদী নিজে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন এবং দুঃখপ্রকাশ করেন উদ্ধবের কাছে।
কিন্তু তাতে পরিস্থিতি কিন্তু বদলাচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ তথা কলমচি অভয় দেশপান্ডের ব্যাখ্যা, গোটা রাজ্যে খুব বেশি হলে হয়তো একটি বা দু’টি আসন পেলেও পেতে পারেন রাজ। কারণ তাঁর গ্ল্যামার থাকতে পারে কিন্তু সঙ্গে সংগঠিত ক্যাডার নেই (একমাত্র নাসিকের আসনটি এমএনএস-এর পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জাতপাতের সমীকরণে)। কিন্তু মুম্বই-সহ বেশ কিছু আসনে কিছুটা হলেও শিবসেনার ভোট কাটবেন তিনি। মুম্বইয়ের ছ’টি আসনের মধ্যে তিনটি আসনে (উত্তর মুম্বই, উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-মধ্য মুম্বই) গুজরাতি এবং মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভোট এবার বিজেপি পাবে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই আসনগুলিতে বিজেপি-র প্রায় এক থেকে দেড় লাখ করে ভোট কেটেছিল এমএনএস। ফলে সবক’টি আসনই পায় কংগ্রেস-এনসিপি জোট। এবারে নাকি সেটি হচ্ছে না।
মহানগরের আকাশচুম্বী বাড়িগুলির মাথা হোর্ডিংয়ে ছয়লাপ। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসছেন মোদী এবং উদ্ধব। প্রথম জন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। আর দ্বিতীয় জনের কাছে উত্তরাধিকার ধরে রাখার অগ্নিপরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy