ভোট দেওয়ার পর কিরণ বেদী। শনিবার। ছবি: পিটিআই
খাতায় কলমে ভোট-প্রচারে যবনিকা পড়েছিল বৃহষ্পতিবার সন্ধে ছ’টায়। কিন্তু বৈদ্যুতিন মাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার নিরঙ্কুশ দাপটের এই যুগে প্রচারের কি কোনও শেষ হয় নাকি! ভোটজ্বরে কাঁপতে থাকা রাজধানী তাই আজ বুথ-বন্ধের সন্ধে পর্যন্ত সাক্ষী হয়ে রইল সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে তোয়াক্কা না-করা, নিরবচ্ছিন্ন ভোট-প্রচারের।
শুধু ভোটের প্রচারই নয়। পারস্পরিক বাদানুবাদ, চাপানউতোর, অভিযোগ, জয়ের দাবি, শক্তিপ্রদর্শন, এমনকী, নির্বাচন-পরবর্তী সমঝোতার ইঙ্গিতটুকু পর্যন্ত যে নেতা যে ভাবে পেরেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন টিভি চ্যানেল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বা দলের ওয়েবসাইটে। এই সমান্তরাল প্রচারের সূত্রেই আজ গোটা দিন লাজপতনগর থেকে লালকেল্লা, মালব্যনগর থেকে মুনিরকা রাজধানীর রাজপথ হয়ে দাঁড়াল রাজনীতির নাটমঞ্চ।
নাট্যমঞ্চ! তা না হলে, বলা নেই কওয়া নেই ভরদুপুরে পাঁই-পাঁই করে কেন দৌড়তে যাবেন ৬৫ বছর বয়স্ক বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী কিরণ বেদী? এতই গতি সে দৌড়ের যে, খানিকটা ধাওয়া করে পিছিয়ে পড়লেন উপস্থিত ছবি-শিকারিরাও!
ঘটনাস্থল কিরণ বেদীর নির্বাচনকেন্দ্র পূর্ব দিল্লির কৃষ্ণনগর। সকাল থেকেই পথে টই-টই করে ঘুরতে থাকা বেদী হঠাৎ দৌড়তে শুরু করায় প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে যান কাছেই অপেক্ষারত ক্যামেরা কাঁধে সাংবাদিকরা। মুহূর্তে টানটান উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। গুজব রটে, কাছের বুথে নিশ্চয়ই হিংসার ঘটনা ঘটেছে। তা না হলে কেনই বা দৌড়বেন প্রাক্তন এই পুলিশকর্তা! তাঁর দৌড় ক্যামেরাবন্দি হয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে যাওয়ার পর বেদী জানালেন, তিনি বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মাত্র! সমস্বরে প্রশ্ন, দেখা করতে গিয়েছিলেন, ভাল কথা, কিন্তু দৌড়তে হল কেন?
বেদীর জবাব, “এটা আমাদের জয়ের দৌড়। আম আদমি পার্টি এখনই পিছিয়ে পড়েছে।’’
বুথফেরত সমীক্ষার ফলের স্পষ্ট আভাস পাওয়া দূর-স্থান, তখনও ভোটদানের বেলাও ভাল করে গড়ায়নি। তখনই জয়ের দৌড়? সব দলের নেতারাই মানছেন, হারজিত পরের কথা, সংবাদমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ-নিজ ভোটব্যাঙ্ককে অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত, এমনকী উত্তেজিত করার অল্পবিস্তর চেষ্টা করে গিয়েছেন দিল্লির রাজনীতির বেশির ভাগ কুশীলবই।
চিরপরিচিত মাফলার ছাড়াই আজ সকাল থেকে যেমন চ্যানেলে চ্যানেলে দেখা গিয়েছে কেজরীবালকে। প্রথমেই জানিয়েছেন গত তিন মাস সময় পাননি, তাই গত কাল সেলুনে গিয়ে চুল ছেঁটে একটু হাল্কা হয়েছেন! যেখানেই যাচ্ছেন, ক্যামেরা তাঁর পিছনে। সেই সুযোগ নিতে ছাড়েননি কেজরীবাল। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তুলোধোনা করেছেন প্রতিপক্ষকে। গোটা দিন ধরেই খণ্ড খণ্ড ‘বাইট’ দিয়ে গিয়েছেন। টুইট করেছেন দেদার। নির্বাচন কমিশনের কাছে কিরণ বেদীর নামে নালিশ ঠুকতেও ছাড়েননি। তাঁর নালিশের প্রতিপাদ্য, এই বিজেপি প্রার্থী গোটা দিন বাইকবাহিনী নিয়ে ক্যামেরার সামনে প্রচার করে গিয়েছেন।
বেদী বনাম কেজরীবাল দিনভর চলেছে ভাবমূর্তি বিক্রির লড়াই। প্রথম হইচইটা কিন্তু শুরু করেছিলেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসারটিই। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, গোটা চিত্রনাট্যের কৌশল রচনা হয়েছিল, প্রাথমিক ভাবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের কথা ভেবেই। টিভি-খবরের তামাম দর্শক সকাল সকালই দেখলেন যে, নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বেদী একটি ঝুগ্গিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখান থেকে বেড়িয়ে এলেন কিছু ব্যক্তি। তাঁদের অধিকাংশেরই মাথায় বিজেপির টুপি। ক্যামেরার সামনে তাঁরা অভিযোগ করলেন, গত রাতে ‘গুন্ডার মতো দেখতে’ কিছু লোক এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছে, আপকে ভোট না দিলে বোমা মারা হবে বস্তিতে। আগাম ঘুষ হিসেবে ৩০০ টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাবও নাকি দেয় সেই লোকগুলি। কিরণ বেদী এই ব্যক্তিদের অভিযোগ গোটাটাই মোবাইলে ভিডিওবন্দি করেন। পরে জায়গায় জায়গায় অপেক্ষারত চ্যানেল সাংবাদিকদের সামনে তিনি দেখিয়েছেন সেই ভিডিও ফুটেজ। কেজরীবাল তার পাল্টা জবাবও দিয়েছেন সেই চ্যানেলে। তাঁর কথায়, “কিরণের অভিযোগ অসত্য। ওই ব্যক্তিদের তোতাপাখির মতো শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল কী বলতে হবে। আর সেটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যখন দেখা গিয়েছে যে, তাঁদের মাথায় বিজেপির টুপি পরা।”
শুধু কি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার? সকাল থেকে লাগাতার চলছে টুইটের টক্কর। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, কিরণ বেদী, অরবিন্দ কেজরীবাল, শীলা দীক্ষিত কে না নেই এই টুইট-বাজারে? যে বুথ ক্যাম্পে যে দলের বেশি ভিড়, সেই দলের সমর্থকরা তার ছবি তুলেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে।
তবে দিনের শেষে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বললেন বিজেপি মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্র। তাঁর কথায়, “গোটা দিন পরোক্ষে হয়তো প্রচার করল সব দলই। অনেক নাট্যরঙ্গ হল। কিন্তু সব চেয়ে বড় কথা, কোনও হিংসা হল না। এটা গণতন্ত্রের জয়। আপনাদের পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু এমনটা দেখা যাচ্ছে না ইদানীং!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy