Advertisement
E-Paper

মোদীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে কেজরীবাল

জনতার ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভাঙার জোগাড়। নয় নয় করে জনসমর্থন র্যালির বয়স তখন চার ঘণ্টারও বেশি। অন্ধকার গুঁড়ি মেরে গ্রাস করে নিচ্ছে বেনিয়াবাগের মাঠটিকে। সন্ধের আজানের রেশও মিলিয়ে গিয়েছে অনেক ক্ষণ। দূরে মঞ্চে বসে অরবিন্দ কেজরীবাল ও অন্য আম আদমির নেতারাও ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। অসহিষ্ণু হয়ে পড়া জনতার একটাই প্রশ্ন, কখন হবে গণভোট?

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৪ ০২:৪৫
মঙ্গলবার বারাণসীর রাজঘাটে অরবিন্দ কেজরীবাল। ছবি: পিটিআই।

মঙ্গলবার বারাণসীর রাজঘাটে অরবিন্দ কেজরীবাল। ছবি: পিটিআই।

জনতার ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভাঙার জোগাড়। নয় নয় করে জনসমর্থন র্যালির বয়স তখন চার ঘণ্টারও বেশি। অন্ধকার গুঁড়ি মেরে গ্রাস করে নিচ্ছে বেনিয়াবাগের মাঠটিকে। সন্ধের আজানের রেশও মিলিয়ে গিয়েছে অনেক ক্ষণ। দূরে মঞ্চে বসে অরবিন্দ কেজরীবাল ও অন্য আম আদমির নেতারাও ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। অসহিষ্ণু হয়ে পড়া জনতার একটাই প্রশ্ন, কখন হবে গণভোট?

দর্শক অসহিষ্ণু। অনেকেই বাড়িমুখো। প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন ছোট-বড় আপ নেতারাও। পরিস্থিতি চট করে বুঝে নিয়ে আর অপেক্ষা করা সমীচীন মনে করলেন না কেজরীবাল। হঠাৎই থামিয়ে দিলেন বক্ততা। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানতে চাইলেন, “আমার কি বারাণসী থেকে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়া উচিত?” এটার জন্যই এত দিন ধরে এত অপেক্ষা। সমস্বরে হাত তুললেন উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঝেঁটিয়ে আসা আপ সমর্থকেরা। ধ্বনি উঠল, “হ্যা।”ঁ জনতাকে আশ্বস্ত করে কেজরীবাল জানালেন, মোদীর বিরুদ্ধে লড়ার চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করলেন। ডিম ছোড়া থেকে শুরু করে কালি ছেটানো কিংবা বিশ্বনাথ মন্দিরের গলিতে বিজেপি সমর্থকদের প্রবল আপ-বিরোধী স্লোগান, কোনও কিছুকেই গ্রাহ্য না করে শেষ পর্যন্ত বারাণসী থেকে লড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কেজরীবাল। কাশী-বিশ্বনাথের শহরে শুরু হয়ে গেল মোদী-কেজরীবাল মহারণের প্রস্তুতি।

তবে তিনি যে কংগ্রেসের হাতে তামাক খাচ্ছেন না, তা বোঝাতে কেজরীবাল অমেঠিতে রাহুল গাঁধীকে হারাতে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন বারাণসীর ওই মঞ্চ থেকেই। ওই কেন্দ্রে আপ প্রার্থী কুমার বিশ্বাস। কেজরীবালের দাবি, দুর্নীতির প্রশ্নে কংগ্রেস ও বিজেপি টাকার এ-পিঠ ও-পিঠ। তাঁর কথায়, “আমাদের লক্ষ্য দু’দলের প্রধান সেনাপতিদের পরাস্ত করা। যাতে দু’টি দলই নেতৃত্বের অভাবে মনোবল হারিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তবেই নতুন শক্তি রাজনীতিতে উঠে আসবে।”

কংগ্রেস-বিজেপি দুই শিবিরই মানুষকে বোঝাচ্ছে, কেন্দ্রে সরকার গড়তে পারবে না আপ। ফলে তাদের ভোট দিয়ে লাভ নেই। আপ এই অবস্থায় ভোটারদের বার্তা দিতে চাইছে, দু’দলের প্রধান কান্ডারিদের পরাস্ত করলেই তথাকথিত প্রধান দল দু’টি বেকায়দায় পড়ে যাবে। ফলে নতুন এক সমীকরণ গড়ে উঠবে দিল্লিতে। তাই অমেঠি-বারাণসী দুই কেন্দ্রেই সর্বশক্তিতে ঝাঁপাবে আপ।

বারাণসীতে মোদী হাওয়ার দাপট দেখে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, কাজটা আদৌ সহজ হবে না এখানে। তবু মোদীকে হারাতে আপাতত দ্বিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা করেছেন কেজরীবাল। l মোদীর তথাকথিত উন্নয়নের ফানুসকে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে চুপসে দেওয়া। l মোদী জুজু দেখিয়ে সংখ্যালঘু ভোটকে নিজের পক্ষে টানা।

মোদীর উন্নয়নের মিথ ভাঙতে আজ থেকেই গুজরাতের কৃষক ও সাধারণ মানুষের দুর্দশার ছবি তুলে ধরার কাজ শুরু করেছেন আপ শীর্ষনেতা। এর সঙ্গে তিনি মুখর হয়েছেন অম্বানী ও আদানির মতো শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে মোদীর অশুভ আঁতাঁতের অভিযোগ তুলে। কেজরীবালের কথায়, “গুজরাত সরকার জোর করে সস্তায় কৃষকদের কাছ থেকে জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে গত কয়েক বছরে ওই রাজ্যে ৫,৮৭৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। মোদী খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগেরও পক্ষে। সেই কারণে গত দশ বছরে ৬০ হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বসে গিয়েছে সে রাজ্যে। কাজ হারিয়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। মোদী কিন্তু সেই বিষয়ে চুপ!”

দ্বিতীয় কৌশল, সংখ্যালঘু ভোট টানা। সেই লক্ষ্যেই কেজরীবাল ভারতরত্ন বিসমিল্লা খান রোডের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বেনিয়াবাগকেই প্রথম সভা করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। এই লোকসভা কেন্দ্রে প্রায় ১৬ শতাংশ মুসলিম ভোট রয়েছে। শুরু থেকেই তাঁদের পাশে পেতে তৎপর আপ। যে কারণে আজই কেজরীবালের সমর্থনে মাঠে নামানো হয় বারাণসীর শাহি ইমামকে। তিনি কেজরীবালকে ভোট দেওয়ার জন্য মঞ্চ থেকে মুসলিম সমাজের কাছে অনুরোধ জানান। তবে আপ নেতৃত্বের আশঙ্কা, লড়াইটা দ্বিমুখী না-ও হতে পারে। বারাণসীতে নিজেদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা ঝুলিয়ে রেখে কংগ্রেস এখনও তাদের প্রার্থীকে সমর্থন করার জন্য অন্যান্য দলের সঙ্গে কথা বলছে। তবে মোদীর বিরুদ্ধে অভিন্ন প্রার্থীর কথা বলেও আপকে তার বাইরেই রাখছে তারা। এ অবস্থায় অন্য প্রার্থী থাকলে তাঁরাও ঝাঁপাবেন সংখ্যালঘু ভোটের জন্য। ফলে আজ স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় গণভোটের মাঠটিকে অর্ধেক ভরিয়ে রাখলেও শেষ পর্যন্ত কতটা ভোট আপের ঝাঁপিতে আসবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছে দলেই।

তবে সংখ্যালঘু ভোট পাওয়ার জন্য আপকে ঝাঁপাতে দেখে বিলক্ষণ স্বস্তিতে বিজেপি শিবির। দলের মতে, যে দল যত সংখ্যালঘু ভোটের সমর্থনে মুখ খুলবে, তত হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে ঝুঁকবে। বিজেপি যে মরুকরণের রাজনীতি করবে, সেটা মাথায় রেখেই আপ নেতারা আজ হর হর মহাদেব ধ্বনিও তুলেছেন ক্ষণে ক্ষণে। সাংবাদিকদের অজস্র ক্যামেরার সামনে কেজরীবাল নিজে গঙ্গায় স্নান করে, মাথায় চন্দন লাগিয়ে বিশ্বনাথের পুজো দিয়েছেন। বার্তা দিতে চেয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজকেও।

তবে কতটা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়তে লেমেছেন, তা প্রথম দিনেই হাড়ে হাড়ে মালুম হয়েছে কেজরীবালের। সকালে প্রায় ৪৫ মিনিট দেরিতে শিবগঙ্গা এক্সপ্রেস বারাণসী পৌঁছয়। স্টেশনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান আপ সমর্থকরা। এর পরের গন্তব্য এক বন্ধুর বাড়ি। সেখান থেকে সোজা রাজঘাট। গঙ্গায় ডুব দিয়েই কেজরীবাল যান বিশ্বনাথ দর্শনে। আম আদমি পার্টির নেতা আসছেন বলে বন্ধ করে দেওয়া হয় আম-আদমির বিশ্বনাথ দর্শনও। ফলে কাশীর ছোট্ট গলিতে তখন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। তারই মধ্যে স্থানীয় দোকানদার ও বিজেপি সমর্থকরা এখান থেকে কেজরীবালের ভোটে লড়ার বিরুদ্ধে একনাগাড়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এরই মধ্যে পুলিশ পাহারায় কোনও ভাবে বিশ্বনাথ দর্শন করে বেরিয়ে আসেন কেজরীবাল। গাড়িতে উঠতেই ছোড়া হয় ডিম। নিরাপত্তারক্ষীরা কেজরীবালকে গাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ায় সরাসরি আক্রমণ থেকে বেঁচে যান তিনি।

পরের গন্তব্য সঙ্কটমোচন মন্দির হয়ে তুলসী ঘাট। স্থানীয় রাজনীতিক তথা গঙ্গা সাফাই আন্দোলনের কর্মী শিবনারায়ণ মিশ্রের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন কেজরীবাল। আপ সূত্রের খবর, গঙ্গাকে কী ভাবে দূষণমুক্ত করা সম্ভব, তা নিয়ে এক প্রস্ত আলোচনা হয়। গঙ্গাদূষণ নিয়ে স্থানীয় মানুষের ভাবাবেগ রয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে বিজেপির বর্তমান সাংসদ মুরলীমনোহর জোশীর বিরুদ্ধে। তাই গঙ্গার দূষণ যে তাঁর ভোট প্রচারের অঙ্গ হতে চলেছে, তা আজই স্পষ্ট করে দিয়েছেন কেজরীবাল। বলেছেন, “কাশী এসেছি বলে গঙ্গায় স্নান করলাম ঠিকই। কিন্তু জল খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।”

এর পর কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে শোভাযাত্রা করে তিনি রওনা হন বেনিয়াবাগের দিকে। সভাস্থলে পৌঁছনোর ঠিক আগে তাঁর মুখে-জামায় কালি ছিটিয়ে দেন এক জন। নিজেকে হিন্দু সেনার সমর্থক বলে দাবি করলেও ওই ব্যক্তি বিজেপির লোক বলেই অভিযোগ আপের। গুজরাতে বিভিন্ন স্থানে তাঁকে কালো পতাকা দেখানো কিংবা আজ কালি ছেটানোর পিছনে মোদীর ভাড়া করা গুন্ডারা রয়েছেন বলে দাবি করেন কেজরীবাল। তাঁর কথায়, “বারাণসীর সংস্কৃতি যে এটা নয়, সেটা পরাস্ত হলেই বুঝতে পারবেন নরেন্দ্র মোদী।”

modi kejriwal aap loksabha election baranasi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy