Advertisement
১৯ মে ২০২৪

যখন-তখন মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত ওরা

গঙ্গার ধার ঘেঁষে ছোট্ট একটা গাঁ। কাটরা সাদাতগঞ্জ। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবারের বাস। উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁ জেলার সেই অখ্যাত গ্রামের নাম গত দশ-এগারো দিনে জেনে গিয়েছে প্রায় গোটা দুনিয়া। বিদেশি সংবাদপত্রেও বড় বড় করে বেরিয়েছে, কী ভাবে এই গ্রামের ছেলেরা দুই কিশোরী বোনকে ধর্ষণ করে খুন করেছে। আর তার পর ঝুলিয়ে দিয়েছে গাছে।

সংবাদসংস্থা
বদায়ূঁ শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

গঙ্গার ধার ঘেঁষে ছোট্ট একটা গাঁ। কাটরা সাদাতগঞ্জ। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবারের বাস। উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁ জেলার সেই অখ্যাত গ্রামের নাম গত দশ-এগারো দিনে জেনে গিয়েছে প্রায় গোটা দুনিয়া। বিদেশি সংবাদপত্রেও বড় বড় করে বেরিয়েছে, কী ভাবে এই গ্রামের ছেলেরা দুই কিশোরী বোনকে ধর্ষণ করে খুন করেছে। আর তার পর ঝুলিয়ে দিয়েছে গাছে।

গ্রামের মেঠো পথে এখন ঘন ঘন চার চাকার আওয়াজ। নেতামন্ত্রীদের যাতায়াত। এই ঘটনার পর হেলিকপ্টারও দেখেছে গ্রামবাসী। প্রতিদিনই ক্যামেরা কাঁধে ছুটে আসছেন সাংবাদিকরা। কিন্তু এত কিছুতে বড় বিপদে পড়েছে গ্রামের মেয়েরা। অধিকাংশ বাড়িতেই যে শৌচাগার নেই। কাজ সারতে তাই মাঠেঘাটে যেতে হয়। কিন্তু গ্রামে এখন এত লোকের আনাগোনা, যাওয়াই দায়।

এক সাংবাদিককে এমনই সব কথা জানিয়েছে বছর ষোলোর কিশোরী শ্রীদেবী। যখনই সে শৌচকর্ম সারতে মাঠে যায়, মাথায় অনেক কিছু ঘুরপাক খায়। ছেলেরা দেখতে পেলেই কটূক্তি করবে। ওই সময় কেউ দেখতে পেলেও তো খুব লজ্জার। আবার শৌচকর্মে যাওয়ার জন্য ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড গোনা। সব সময় তো যাওয়া যায় না। দুপুরটাই সেরা সময়। তখন সকলে ঘুমোয়। কিন্তু এখন সে উপায়ও নেই। ভিড় লেগেই আছে। তার উপর, নিহত ওই দুই বোনের বাড়িও শ্রীদেবীদের বাড়ির কাছেই। ও পথে লোকের আনাগোনা তাই একটু বেশি-ই।

গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে শ্রীদেবী। এখন গরমের ছুটি। কবে স্কুল খুলবে, অধীর অপেক্ষায় রয়েছে মেয়ে। স্কুল থাকলে, সেখানের শৌচাগারেও যাওয়া যেত।

মেয়েটির কথায়, “চেপে রাখতে গিয়ে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা করে। মা বার বারই বলে বাড়ির উঠোনে খড়ের গাদায় কাজ সেরে নিতে।” কিন্তু মায়ের এ সব কথা মোটেই পছন্দ হয় না মেয়ের। সে স্কুলে পড়ে। বইয়ে পড়েছে, এ সব ভীষণ অস্বাস্থ্যকর।

কিশোরী এটাও জানিয়েছে, ইন্দিরা আবাস যোজনা থেকে তাঁর বাবা টাকা পেয়েছিল। তাতে শৌচাগার বানানোর টাকাও ছিল। কিন্তু বাড়ি পাকা করতে গিয়েই সব টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। মাটির বাড়িতে যে খুব কষ্ট। বৃষ্টি হলেই খড়ের চালা-ঘরে জল পড়ে। বাড়ির কাছেই গঙ্গা। প্রায় প্রতি বছর বন্যার জলে ধুয়ে যায় ঘর। শৌচাগারের থেকেও তাই মাথার উপর পাকা ছাদ থাকাটা জরুরি। ষোলো বছর বয়সেই সংসারের এই সব খুঁটিনাটি বুঝে গিয়েছে কিশোরী।

শ্রীদেবীর মতো অবস্থা গ্রামের প্রায় সব মেয়েরই। প্রাতঃকৃত্য থেকে প্রস্রাব, সবের জন্যই বাইরে যেতে হয়। সে দিন ওই দুই বোন শৌচকাজ সারতেই মাঠে গিয়েছিল। তার পর নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে বাড়ির লোক জানতে পারে গ্রামেরই কিছু লোক একটি বাড়িতে আটকে রেখেছে তাদের। অভিযুক্তের বাড়িতে ছুটেও গিয়েছিল তাঁরা। কিন্তু লোকগুলি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, রেহাই মিলবে না কিছুতেই। এর পর পুলিশের কাছে গেলেও, তারা অভিযোগ দায়ের করতে চায়নি। দেড় দিন কেটে যায় ওই করেই। এক সময় খবর আসে তাঁদের দুই মেয়েকে খুন করেছে নৃশংস লোকগুলো।

কাটরা গ্রামে মেয়েদের এ ভাবে হেনস্থা হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। সে দিনের ঘটনায় ধৃত তিন ভাই পাপ্পু, অবধেশ ও উর্বেশ যাদব এ রকম কাজ আগেও করেছে। এক সময় তারা ফারুকাবাদে থাকত। জমিজমা বন্যার জলে ডুবে যাওয়ার পর বদায়ূঁতে চলে আসে। এখানে এসে তারা তামাক চাষ শুরু করে। কাটরা গ্রামের চাষিদের একটা বড় অংশই তামাক চাষ করে। তাতে অনেক লাভ। এক একর জমি থেকে প্রায় ৫ টন উৎপাদন। লাভের হিসেবে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। হাতে টাকা আসতেই ক্ষমতাও চলে আসে পাপ্পুদের কাছে। স্থানীয় বাসিন্দার মতে, পকেটে টাকা থাকলে, পাশে পুলিশ-প্রশাসনও থাকে। শিক্ষার যে কোনও পথ নেই। অধিকাংশ অল্প বয়সি ছেলে স্কুলের গণ্ডিতেই পড়াশোনা শেষ করে দেয়। বিপথে যাওয়াও তাই খুব সহজ।

এমনই এক দল গ্রামবাসী জানিয়েছে, ক্ষমতার জোরে পাপ্পুরা প্রায়শই মেয়েদের হেনস্থা করত। বহু মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছে তারা। অন্তত বার দশেক এ ভাবেই তুলে নিয়ে গিয়েছে গ্রামের গরিব মেয়েদের। গোপন জায়গায় আটকে রেখে কয়েক দিন ‘ভোগ’ করার পর একরাশ যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা-অপমানের বোঝা চাপিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে বাড়িতে। গরিবদের মুখ খোলার উপায় নেই। নিহত কিশোরীদের বাবারাই সাংবাদিকদের বলেছেন, “মুখে সিগারেট, কোমড়ে পিস্তল ঝুলিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় ওরা। ওদের কে কী বলবে?” পুলিশও ওদের হাতে। তাই পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতে হয় মেয়েদের। কৈশোরেই কখন ‘বড়’ হয়ে যায় তারা।

যে কাজটা হয়তো কেউ এত দিন ভুল করেও করেনি, সেটাই করে ফেলেছিলেন দুই তুতো বোনের বাবা। পাপ্পু-অবধেশরা তুলে নিয়ে গিয়েছে শুনেও, তাদের বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। সাহস দেখিয়েছিল পুলিশের কাছে যাওয়ার। তারই প্রতিদান দিতে হল দুই মেয়েকে হারিয়ে।

সমাজের উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিয়েছে “মিডিয়া চলে গেলে মহাভারত বানিয়ে ছাড়ব!” এই যুদ্ধে পরিবারের সবাইকে মরতে হবে, নিশ্চিত বদায়ূঁর ওই পরিবার। তাই তাঁরা ঠিক করেছেন ভিটেমাটি ছেড়ে দিল্লি চলে যাবেন। বাড়ির কর্তা বললেন, “সব ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। দিল্লি থেকেই শুরু হবে পরবর্তী লড়াই।”

শাসাচ্ছে সিট, অভিযোগ বাবার

সংবাদ সংস্থা • লখনউ

পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে একাধিক বার। এ বার রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারীরাই (সিট) শাসাচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন বদায়ূঁর ধর্ষিতাদের এক জনের বাবা। তাই তদন্তে সিটের সঙ্গে কোনও সহযোগিতা করা হবে না বলে জানিয়েছে ওই পরিবার। খুনের পিছনে সম্পত্তির লোভ রয়েছে, উত্তরপ্রদেশের ডিজির এই দাবিও তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। “রাজ্য পুলিশ তো নিজেরাই চাপ দিচ্ছে। ওদের তদন্তে আস্থা নেই আমাদের। সিবিআই তদন্ত হলেই সত্যিটা সামনে আসবে” মন্তব্য তাঁর। আগে আঙুল উঠেছিল সমাজের মাথাদের দিকে। আর এ বার অভিযোগ সরাসরি রক্ষাকর্তাদের দিকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

badaun rape uttar pradesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE