Advertisement
E-Paper

দোলের সকালে ঝটিকা সফরে ঘুরে আসুন চৈতন্য এবং নিত্যানন্দের ইতিহাসবিজড়িত ঠাকুরবাড়ি থেকে

জায়গাটি হুগলি জেলার আদিসপ্তগ্রামে। কলকাতা থেকে যেতে সময় লাগবে বড়জোর আড়াই ঘণ্টা। দোলের দিন সেখানে হোলি খেলায় শামিল হওয়ার পাশাপাশি দেখতে পাবেন ৫০০ বছরের পুরনো মাধবীলতা গাছ।

উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ি।

উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:৩১
Share
Save

দোলের বেড়ানো। মানে শহরের চৌহদ্দি পেরিয়ে একটু শান্তির ঠিকানা। হাইওয়ের হু-হু আওয়াজকে সঙ্গী করে ঝপ করে এমন এক জায়গার মুখোমুখি, যেখানে প্রাণের আরাম, কানেরও আরাম। আবার সেই ঠিকানাতেই দু’পাশের সবুজে ঘেরা মেঠো রাস্তা পেরিয়ে গল্প শোনাবে ইতিহাস। সেই গল্পে সুলতান আছেন, আছেন বণিক চূড়ামণি, আছেন চৈতন্যদেব আর তাঁর সঙ্গী নিত্যানন্দও। গৌড়বঙ্গের ইতিহাসবিজড়িত তেমনই এক জায়গা উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ি।

ইতিহাস

বাংলায় যখন সুলতানি শাসনের রোয়াব কিছুটা ঝিমিয়েছে, সেই সময় ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল গৌড়বঙ্গে। গৌড়বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষজন তো বটেই, মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্তেরাও শান্তি পেয়েছিলেন নবদ্বীপের চৈতন্যদেবের প্রেমের বাণীতে। কালীপ্রেমী বঙ্গে সেই সময় জোরালো কৃষ্ণপ্রেমের ঢেউ উঠেছিল হঠাৎ। রাজারাজড়া, অর্থবান বণিকেরাও সেই কৃষ্ণপ্রেমে মজলেন। গৌড়বঙ্গের বহু রাধাকৃষ্ণের আরাধনার মন্দির সেই সময়ে তৈরি, যার কয়েকটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গৌর-নিতাই (চৈতন্যদেব এবং তাঁর ছায়াসঙ্গী নিত্যানন্দ) কাহিনি। উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ি তেমনই এক স্থান।

উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ির প্রবেশপথ।

উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ির প্রবেশপথ। —নিজস্ব চিত্র।

নামমাহাত্ম্য

জায়গাটি হুগলি জেলার আদিসপ্তগ্রাম। যাঁর নামে ওই ঠাকুরবাড়ি তিনি ছিলেন গৌড়বঙ্গের সুবর্ণবণিক। উদ্ধারণ দত্ত তাঁর নাম পেয়েছিলেন বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণের পর। উদ্ধারণ শব্দের অর্থ যিনি উদ্ধার করেন। সে কালে গৌড়বঙ্গের রাজা বল্লাল সেনের কোপে পড়ে বিপন্ন সুবর্ণবণিক সমাজকে উদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল উদ্ধারণকে। তাই ওই নাম রেখেছিলেন চৈতন্যদেবের প্রিয় সখা নিত্যানন্দ।

মন্দিরের লাগোয়া পরিচ্ছন্ন উঠোনে ঘুরে বেড়াতেও ভাল লাগবে।

মন্দিরের লাগোয়া পরিচ্ছন্ন উঠোনে ঘুরে বেড়াতেও ভাল লাগবে। —নিজস্ব চিত্র।

সুবর্ণবণিকের মন্দির

ইতিহাস বলছে, গৌড়বঙ্গের সুবর্ণবণিক, অর্থাৎ সোনা-রূপোর ব্যবসায়ীরা সেই সময়ে সপ্তগ্রামের বন্দর থেকেই ব্যবসা করতেন। সরস্বতী নদীর তীরবর্তী সপ্তগ্রামের বন্দরে এসে নোঙর ফেলত ইরান, ইউরোপের বাণিজ্যতরীও। বাংলায় তখন বণিকদের রমরমা। সেই সময়েই সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের প্রধান বল্লভচন্দ্র পড়েছিলেন গৌড়ের রাজরোষে। বল্লালচরিত গ্রন্থে লেখা আছে, বল্লভচন্দ্রের দম্ভে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন রাজা। ঠিক করেছিলেন দাম্ভিক সুবর্ণবণিকদের ‘শূদ্রত্বে পতিত’ করে ছাড়বেন। আচমকাই সমাজের মাথা থেকে নেমে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন সুবর্ণবণিকেরা । চৈতন্যদেবের সংস্পর্শে তাঁরা আবার সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে ফেরেন। নিত্যানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পরে সেই কাজ করেছিলেন উদ্ধারণই। তার পরেই সপ্তগ্রাম এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওই রাধাকৃষ্ণ মন্দির, যেখানে পূজিত হন গৌর-নিতাইও।

মূল মন্দির এবং বিগ্রহ।

মূল মন্দির এবং বিগ্রহ। —নিজস্ব চিত্র।

নিত্যানন্দ কথা

বৈষ্ণবেরা চৈতন্যদেবকে যেমন শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলে মনে করেন, ঠিক তেমনই নিত্যানন্দকে মনে করেন শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের অবতার। চৈতন্যদেবের মতোই নিত্যানন্দকে ঘিরেও নানা অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত নবদ্বীপ এবং এই বঙ্গের অন্যত্রও। লোককথা অনুয়ায়ী, নিত্যানন্দ যখন চৈতন্যদেবের উপদেশে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন, তখন চৈতন্যদেব উদ্ধারণকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন নিত্যানন্দের পাত্রী খোঁজার। পরে বিয়েতেও দশ হাজার মুদ্রা অর্থব্যয় করেছিলেন উদ্ধারণ। কথিত আছে, উদ্ধারণের প্রতিষ্ঠিত ওই সপ্তগ্রামের মন্দিরে নিত্যানন্দ নিয়মিত আসতেন, থাকতেনও। উদ্ধারণের হাতে রান্না করা অন্ন ছাড়া খেতেন না। ওই মন্দিরেই তিনি নিজে হাতে রোপণ করেছিলেন মাধবীলতা গাছের চারা, যা এখন ৫০০ বছরের পুরনো বৃক্ষ।

উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ির সেই ৫০০ বছরের পুরনো ফুল গাছ।

উদ্ধারণ দত্তের ঠাকুরবাড়ির সেই ৫০০ বছরের পুরনো ফুল গাছ। —নিজস্ব চিত্র।

সপ্তগ্রামের ‘বুড়ো গাছ’

জটজুটধারী সেই প্রাচীন মাধবীলতা গাছ ফুলে ভরে থাকে বসন্তে। তার নীচে বাঁধানো চাতালে এবং মন্দিরে প্রতি বছর দোলে হয় উৎসব। সেই দোল উৎসব দেখতে গিয়ে আশপাশটাও ঘুরে দেখা যায়। ঠাকুরবাড়ির বিস্তৃত এবং সাজানো মূল মন্দিরচত্বর তো রয়েছেই। রয়েছে বিগ্রহও। তবে তার চারপাশটিও সুন্দর। মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে ছড়ানো উঠোন, বড় বাগান আর সেই বাগানের এক প্রান্তে রয়েছে নিত্যানন্দের স্নানের পুকুরও।

নিত্যানন্দের স্নানের ঘাট।

নিত্যানন্দের স্নানের ঘাট। —নিজস্ব চিত্র।

আশপাশে

নিত্যানন্দের ওই ঠাকুরবাড়ি থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে রয়েছে আরও একটি ইতিহাসবিজড়িত স্থান, সৈয়দ জামালউদ্দিন মসজিদ। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষিত ওই মসজিদ বাংলার দ্বিতীয় সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরত শাহের আমলে তৈরি। অর্থাৎ অন্তত ৫০০ বছরের পুরনো। ইরানের সৈয়দ ফকরুদ্দিনের পুত্র জামালউদ্দিন ওই মসজিদ তৈরি করেন। ফকরুদ্দিন ইরানের কোনও নবী ছিলেন, না কি ধর্মগুরু, তা জানা যায় না। তবে তাঁদের সমাধি রয়েছে ওই মসজিদের এক প্রান্তে। মসজিদটিও দেখার মতো। ইসলামিক স্থাপত্যে তৈরি ওই মসজিদের গায়ে রয়েছে টেরাকোটা তথা পোড়ামাটির নকশা। এখন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকলেও নকশাগুলি দৃশ্যমান।

টেরাকোটার মসজিদ।

টেরাকোটার মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত।

খাওয়াদাওয়া

ঠাকুরবাড়িতে ভোগ খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে। তবে দোলের দিন এ বছর খাওয়াদাওয়া হচ্ছে না। বদলে দোলের উৎসব হবে ২৩ মার্চ। সে দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়ির তরফে জানানো হচ্ছে, সকালের চা থেকে শুরু হবে খাওয়াদাওয়া, সন্ধ্যার চা-কফি দিয়ে শেষ। তবে তার জন্য কুপন কাটতে হবে সে দিন সকালে গিয়ে। দাম মাথাপিছু ৪০০ টাকা করে। তবে কুপন দেওয়া হবে আগে গেলে আগে পাওয়ার ভিত্তিতে। তবে দোলের দিন গেলে খাবার রাস্তায় খেয়ে যাওয়াই ভাল। মন্দিরচত্বরে বাইরের খাবার খাওয়া যায় না। আশপাশের দোকানও দোলের দিন বন্ধ থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তবে আদিসপ্তগ্রাম আসার পথে হাইওয়েতে অনেক ধাবা পাবেন। স্টেশনের দিক থেকে এলে সেখানেও খাবার দোকান পাওয়া যাবে।

কী ভাবে পৌঁছোবেন?

কলকাতা থেকে গাড়িতে এলে আড়াই ঘণ্টার পথ। তবে ট্রেনে এলে দু’ঘণ্টাও লাগবে না। হাওড়া থেকে বর্ধমান যাওয়ার মেন লাইনের যে কোনও লোকাল ট্রেন ধরে নামতে হবে আদিসপ্তগ্রাম স্টেশনে। সময় লাগবে বড়জোর দেড় ঘণ্টা। স্টেশনের কাছেই ওই মন্দির। টোটোয় সেখানে পৌঁছোতে ৫ মিনিট লাগবে। দোলের দিন রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সমস্যা থাকে অনেকেরই। তাঁরা ট্রেনে যেতে পারেন। জানলা দিয়ে ছুটে চলা সবুজ মাঠ-ঘাট, বোল ধরা আমগাছ, মাঝেমধ্যে দু’-একটি পলাশ-শিমুলের গাছ দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছোতে মন্দ লাগবে না।

Day Trip From Kolkata

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}