Advertisement
E-Paper

সঙ্কেত সত্ত্বেও সতর্কতায় টান, মাসুল দিচ্ছে বাঁকুড়া

খিঁচুনি-জ্বরের ঝড়ে বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। তবু প্রশাসন যেন খানিকটা নির্লিপ্তির বালিতে মুখ গুঁজে পরিস্থিতির গুরুত্ব অগ্রাহ্য করতে চাইছে। বাঁকুড়ায় মাথা চাড়া দেওয়া যে অভিযোগের মধ্যে উত্তরবঙ্গেরই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের একাংশ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪৩

খিঁচুনি-জ্বরের ঝড়ে বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। তবু প্রশাসন যেন খানিকটা নির্লিপ্তির বালিতে মুখ গুঁজে পরিস্থিতির গুরুত্ব অগ্রাহ্য করতে চাইছে। বাঁকুড়ায় মাথা চাড়া দেওয়া যে অভিযোগের মধ্যে উত্তরবঙ্গেরই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের একাংশ।

উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির মতো দক্ষিণবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ হিসেবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নথিতে চিহ্নিত। বাঁকুড়া জেলা স্বাস্থ্য দফতরের রেকর্ড বলছে, গত বছরও খাস বাঁকুড়া পুরসভা-এলাকা সমেত জেলার আটটি ব্লকে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ছড়ায়। ২১ জনের শরীরে মিলেছিল রোগের ভাইরাস। জানুয়ারিতেও বাঁকুড়া দু’নম্বরে একটি শিশু জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়েছে।

এমন যখন অবস্থা, তখনও রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসন এ ব্যাপারে বিস্ময়কর ভাবে নির্লিপ্ত থেকেছে বলে অভিযোগ। স্বাস্থ্যমহলেরই একাংশের আক্ষেপ, ঠিক যেমন উত্তরবঙ্গের তিন জেলায় খিঁচুনি জ্বর অনেক দিন ধরে দাপিয়ে বেড়ানো সত্ত্বেও রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসেনি, বাঁকুড়াতেও তা-ই হয়েছে। বস্তুত অনেকের মতে, বাঁকুড়ায় নতুন করে রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে বিশেষ হইচই হোক, স্বাস্থ্যভবন আদৌ তা চায়নি। তাই তথ্য সংগ্রহ থেকে আরম্ভ করে জন-সচেতনতা গড়ে তোলা কংবা রোগ প্রতিরোধের সর্বাত্মক কোনও প্রয়াসও নজরে আসেনি এত দিন।

অর্থাৎ, সঙ্কট মোকাবিলার প্রস্তুতি কার্যত নেই। এমতাবস্থায় সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগী আসতে শুরু করায় জেলা স্বাস্থ্য দফতর বিপাকে পড়েছে। রবিবার এমন উপসর্গে (অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম, সংক্ষেপে এইএস) শিশুর মৃত্যু হয়েছে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা শিশুটির শরীরে প্রাথমিক পরীক্ষায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা না-পড়লেও ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। রোগ প্রতিরোধে প্রশাসনিক সক্রিয়তার ‘অভাব’ নিয়ে জেলার মন্ত্রী তথা বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে রবিবার গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে।

রোগ ঠেকানোর ক্ষেত্রে সরকারি কাজকর্মে ঘাটতিটা ঠিক কোথায়?

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য প্রশাসন সূত্রের ব্যাখ্যা: এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ হওয়ার সুবাদে বাঁকুড়ায় বছরভর নজরদারি থাকার কথা। কারা, কোথায়, কখন জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে বা এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গে আক্রান্ত হলেন, তার তথ্য রাজ্যের কাছে থাকতে হবে। অবস্থা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে অঞ্চল ধরে ধরে টিকাকরণ করতে হবে। সারা বছর ধরে চালাতে হবে সচেতনতার প্রচার, সঙ্গে শুয়োর খেদানো ও মশা নিধন অভিযান। কিন্তু অভিযোগ: খাতায়-কলমে এ সব বলা থাকলেও কিছুই হয়নি। স্রেফ হাতে গোনা ক’টি ব্লকে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি ‘শুরুর’ সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রশাসন দায়িত্ব সেরেছে! আর সেই কর্মসূচিরও সিংহভাগ বাস্তবায়িত হয়নি।

সরকারের কী বক্তব্য? জেলা স্বাস্থ্য দফতর জানাচ্ছে, গত বছর পুজোর আগে জেলার কোথাও কোথাও ১ থেকে ১৫ বছরের শিশু-বালকদের জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছিল। কিছু লোকের বাধায় তা বন্ধ হয়ে যায়। এ বার ঠিক হয়েছে, শিশুদের সাধারণ টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হবে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের টিকাও। আক্রান্তদের কোনও খতিয়ান কি দফতরের হাতে আছে?

সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর বাঁকুড়া পুর-এলাকায় ৬ জন, সোনামুখীতে ৩ জন, বড়জোড়ায় ৩ জন, পাত্রসায়রে ২ জন, শালতোড়ায় ২ জন ও ছাতনা, রাইপুর, সিমলাপাল, ইঁদপুর ও গঙ্গাজলঘাটিতে ১ জন করে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের রোগী মিলেছিল। যদিও এতে গত বছর কারও মৃত্যু হয়নি। “তবে পাত্রসায়রে শ্রাবণী বাউড়ি নামে দু’বছরের একটি শিশুর পক্ষাঘাত হয়ে গিয়েছে।” বলেন এক স্বাস্থ্য-কর্তা।

বিগত শতাব্দীর আশি-নব্বইয়ের দশকে বর্ধমান, বাঁকুড়া ও তদানীন্তন মেদিনীপুর জেলায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের সঙ্গে লড়াই চালিয়েছেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ বিজয় মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, যে তল্লাটে আগে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ছড়িয়েছে, এই সময়ে সেখানে সর্বক্ষণ কড়া নজরদারি রাখা জরুরি। বিশেষত গত ক’বছরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে ক’জন আক্রান্ত হয়েছেন, ক’জনের এইএস দেখা দিয়েছে, তাঁদের যথাযথ রক্ত পরীক্ষা হয়েছে কি না এই বিষয়গুলির যথাযথ তথ্য না-থাকলে রোগ মোকাবিলা করা কঠিন হবে বলে তাঁর অভিমত। “এমন সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কড়া নজরদারিটাই আসল কথা। নচেৎ রোগটা কিন্তু ফিরে ফিরে আসবে।” হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিজয়বাবু।

রাজ্যের শীর্ষ স্বাস্থ্য-কতার্রা অবশ্য গাফিলতি বা নির্লিপ্তির অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, সব ঠিকঠাক চলছে। বাঁকুড়া-পরিস্থিতি প্রসঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী সোমবার বলেন, “আমাদের কাছে সমস্ত তথ্য রয়েছে। আমরা পুরোমাত্রায় সতর্ক। মোকাবিলার সর্বতো চেষ্টা চলছে। নজরদারিতেও ঘাটতি নেই।”

rajdip bandyopadhyay bankura encephalitis
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy