সালটা ১৮৬০ সালের আশপাশে। ভারতে তখন ব্রিটিশরাজ। দক্ষিণ ভারতে এখন যেখানে প্রযুক্তিবিদদের খাস তালুক, সেই বেঙ্গালুরু থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে রামনগর এলাকায় রেশমসুতো দিয়ে শাড়ি বুনছেন এক রেশমশিল্পী। কাঠের যন্ত্রে তৈরি হচ্ছে নরম রেশমবস্ত্র, যা রাঙানো হবে উজ্জ্বল রঙে। হয়তো মাইসুরুর ওয়াদিয়ার রাজবংশের কোনও রাজবধূ কিংবা রাজকন্যার জন্য। কে জানত সে শাড়ির দীপ্তি এই ২০২৫ সালেও মুগ্ধ করবে ইউরোপের মানুষকে!
লন্ডনে স্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফলিত শিল্পের সংগ্রহশালা ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজ়িয়ামে সংরক্ষণ করা আছে শাড়িটি। মজার ব্যাপার হল, ওই মিউজ়িয়াম আর ওই শাড়ি প্রায় সমবয়সি। মিউজ়িয়ামের বয়স ১৭৩ বছর আর শাড়িটির বয়সও দেড়শোর কিছু বেশি। কিন্তু হঠাৎ ভারতের নানা রকম ঐতিহ্যবাহী শাড়ি ছেড়ে কেন একটি দেড়শো বছরের পুরনো মাইসুরু সিল্ক সংরক্ষণ করল ব্রিটেনের সংগ্রহশালা! তার উত্তর দিয়েছেন ব্রিটেনের ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি। যিনি আবার ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি এবং ভারতীয় সাংসদ সুধা মূর্তির কন্যা। অক্ষতা জানিয়েছেন, শাড়িটি শুধু দেখতে ভাল বলে নয়, তার ইতিহাসের জন্যও বিরল।
জমি হলুদ রঙের। আঁচলের রং উজ্জ্বল রানি গোলাপি। তার উপর সোনালি আর হলুদ রঙের ডোরা। সাড়ে তিন ইঞ্চি চওড়া মাঠা পাড়ের উপরে নীচে গোলাপি-সবুজ-সাদা সুতোর সওয়া ইঞ্চি রুল। আর জমিতে সরু সরু রানি গোলাপি সুতোর চেকের নকশা। একনজরে দেখলে এর বিশেষত্ব আন্দাজ করা কঠিন। তবে এই শাড়ি বানানো হয়েছিল সেই সময়ে, যখন মাইসুরু সিল্ক শাড়ির জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও কমেছে।
ভারতে যত রকমের সিল্ক পাওয়া যায় তার মধ্যে মাইসুরু সিল্ক কিছুটা আলাদা। অন্য সিল্কের থেকে এই শাড়ি অনেক বেশি নরম। আর দীপ্তিও বাকি সিল্কের থেকে বেশি। এই সিল্কের শাড়ি হালকা এবং সে যুগে ওই শাড়িতে শুধুই সোনা বা রূপোর সুতোর নকশা করা হত। সেই শাড়ি পরতেন রাজপরিবারের মানুষ বা সমাজের উচ্চবংশীয়রা। এ হেন মাইসুরু সিল্কের রমরমা কিছুটা কমে কর্নাটকে টিপু সুলতানের পতনের পরে। সেই সময়েই মাইসুরু সিল্ককে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য উজ্জ্বল রং ব্যবহার করা শুরু হয়। লন্ডনে সংরক্ষিত শাড়িটি সেই প্রথম কিছু শাড়ির মধ্যে অন্যতম, যাতে প্রাকৃতিক রঙের বদলে প্রথম সিন্থেটিক রং ব্যবহার করা হয়।
অক্ষতা বর্তমানে লন্ডনের ওই মিউজ়িয়ামের অছি পর্ষদের সদস্য। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে কিউরেটরকে বলতে শোনা যায় শাড়িটির জমির রং কাঁচা হলুদ থেকে রং বানিয়ে তাই দিয়ে ডাই করা। তবে উজ্জ্বল গোলাপি রংটি আনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সিন্থেটিক ম্যাজেন্টা। সে যুগে ভারতে মূলত প্রাকৃতিক রং দিয়েই শাড়ি তৈরি হত। বিশেষ করে সিল্কের মতো স্পর্শকাতর শা়ড়িতে রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হত না। সেই প্রথম ওই রঙের ব্যবহার হয়। তাই এই শাড়ির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এখন যে সিল্ক শাড়িতে নানা রকমের সিন্থেটিক রং ব্যবহার করা হয়ে থাকে, এ শাড়ি তার পথপ্রদর্শক।
শাড়িটি ভারতের রেশম শিল্পীদের থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে সংগ্রহ করেছিলেন প্যারিসের ফ্যাশন জগতের বিশিষ্টেরা। ফ্যাশন এবং শিল্পের তীর্থ ক্ষেত্র প্যারিসে ওই শাড়ি এক প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেই শাড়িটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসে লন্ডনের ওই মিউজ়িয়াম।
শাড়িটি দেখতে এসেছিলেন অক্ষতা। নিজেই সেই অভিজ্ঞতার ভিডিয়ো শেয়ার করেছেন ইনস্টাগ্রামে। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘ব্রিটেনের ফার্স্ট লেডি হিসাবে আমি প্রথম বার যে শাড়িটি পরে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে দীপাবলি পালন করেছিলাম সেটি ছিল একটি মাইসুরু সিল্ক। আমার বাবা মাইসুরুর মানুষ। শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখে আমার মনে হল আমি আমার পূর্বপুরুষের সঙ্গে জুড়ে রয়েছি।’’