Advertisement
E-Paper

মিষ্টি তৈরির ইতিহাস এবং উদ্‌যাপন নিয়ে গোটা সাহিত্য উৎসব, সাক্ষী রইল কলকাতা

মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির জন্য এ বার আয়োজন করা হয়েছিল একটি আস্ত সাহিত্য উৎসব যার কেন্দ্রেই ছিল মিষ্টি। মিষ্টির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা থেকে নানা স্বাদের মিষ্টি চেখে দেখা, ছিল সব ব্যবস্থাই।

শুধু আলোচনা নয়— গবেষণা, ডকুমেন্টেশন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে মিষ্টি শিল্পের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই ছিল এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য।

শুধু আলোচনা নয়— গবেষণা, ডকুমেন্টেশন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে মিষ্টি শিল্পের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই ছিল এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

সায়ন্তনী মহাপাত্র

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৩৪
Share
Save

দেশের মিষ্টতম অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই বাংলার বুকেই যে অনুষ্ঠিত হবে মিষ্টি নিয়ে পৃথিবীর প্রথম সাহিত্য উৎসব, তা খুব একটা আশ্চর্যজনক নয়! কিন্তু সেই সাহিত্য উৎসব যখন আপামর জনগণকে খাবারের মাধ্যমে মানুষের ইতিহাসের গল্প বুঝতে শেখায় তখন মিষ্টি নিয়ে বাঙালির পুরনো আবেগই পেয়ে যায় এক অন্য মাত্রা।

২০২২ সালের মাঝামাঝি যখন কলকাতার মিষ্টি সংস্থা যুগলের তৃতীয় প্রজন্মের কর্ণধার লহনা ঘোষ, তাঁদের ১০০ বছর পূর্তিতে টাউন হলে এই মিষ্টি উৎসব আয়োজনের কথা বলেন, তখন থেকেই উৎসাহী মানুষদের চোখ ছিল এই অনুষ্ঠানের দিকে। আর লহনাও আমাদের নিরাশ করেননি। দুই দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানে ৩টি দেশ আর ৭টি রাজ্য থেকে অংশগ্রহণ করা ৩৬ জন প্যানেলিস্টদের আলোচনায় উঠে এসেছে মিষ্টি শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বিষয়। ক্রেতারা মিষ্টিকে একটি স্বতন্ত্র একক হিসেবে দেখলেও এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে মানুষের অভিপ্রয়ানের ইতিহাস, কারিগরের শ্রম, জাতি ধৰ্ম লিঙ্গ বিশেষে শ্রমের বিভেদ, শিল্পীর হাতযশ, সীমান্তের শাসন, আর্থসামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব এবং আরও অনেক কিছু। শুধু আলোচনা নয়— গবেষণা, ডকুমেন্টেশন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে মিষ্টি শিল্পের এই বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই ছিল এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য।

মিষ্টির ইতিহাসে দেখা যায়, প্রাচীনকালের সব মিষ্টিই ছিল বাড়ির মহিলাদের হাতে তৈরি।

মিষ্টির ইতিহাসে দেখা যায়, প্রাচীনকালের সব মিষ্টিই ছিল বাড়ির মহিলাদের হাতে তৈরি। ছবি: সংগৃহীত।

চিজকেক আর দেশি দুধ থেকে তৈরি করা এই মিষ্টির লড়াইয়ে ডাক্তার এবং পুষ্টিবিদরা আবার এগিয়ে রাখেন দেশি মিষ্টিকে। ‘ইজ মিষ্টি হেলদি’ এই আলোচনায় ডাক্তার সুদীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, যে কোনও ধরনের মিষ্টি স্বাদের খাবার থেকেই রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। বাঙালি মিষ্টি আর কেক, প্যাস্ট্রি অথবা চকলেট তাই শরীরের জন্য সমান ক্ষতিকর। ডাক্তার আভেরি সেনগুপ্ত আবার এই বিভিন্ন দেশি বিদেশি মিষ্টির উপকরণের উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, দেশি মিষ্টিতে ব্যবহৃত দুধ, গুড় ইত্যাদি বেকারিতে ব্যবহৃত পাম তেল, মাখন ও চকলেট এর বিকল্প উপকরণগুলির থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। আলোচনায় উপস্থিত সব ডাক্তারই তবে একমত হন যে, মিষ্টি উপভোগ করার ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।

কারিগরি, মিষ্টি শিল্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অথচ সর্বত ভাবে উপেক্ষিত একটি বিষয়। এই কারিগরির ইতিহাসে শুধু শিল্পী মানুষের মেহনত আর আবেগ নয়, জড়িয়ে থাকে বহু বছরের চেষ্টায় অর্জিত দক্ষতা এবং প্রয়োগ পদ্ধতি। মিষ্টি শিল্পের এই দক্ষ কারিগররা না পেয়েছেন তাদের যোগ্য সম্মান, না হয়েছে তাদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার নথিভুক্তিকরণ।

প্রফেসর ঈশিতা রায়ের সঙ্গে এ পার ও ও পার বাংলায় মিষ্টি শিল্পীদের জাত ও শ্রমের বিভেদ নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে অনেক অজানা তথ্য। ‘ময়রা’ কথাটা এদেশে মিষ্টি তৈরি করা সব মানুষের পরিচয় হলেও ও পার বাংলায় তাঁদের পরিচয় তাঁদের ঘোষ পদবী। একই ভাবে আমরা যাঁদের কারিগর বলি ও পার বাংলায় জাতিভেদে তাঁরাই অভিহিত হন ‘ওস্তাদ’ হিসেবে। এমনকি, সীমান্তভেদে বদলে যায় মিষ্টিতে ব্যবহৃত চিনির পরিমাণ। এ পারের কম মিষ্টত্বের মিষ্টি যেমন আমরা পিস্ হিসেবে কিনতে পারি, ও পারে আবার সব মিষ্টিই মেলে ওজন হিসেবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে সীমান্ত তৈরি হলেও স্বাদকে কোনও রাজনৈতিক বেড়াজাল দিয়ে বেঁধে ফেলা যায় না। তাই মিষ্টি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কিছু সংস্কার মুক্তির আশু প্রয়োজন। যার মধ্যে জাত, বর্ণ এবং ধর্ম অন্যতম। একই ধারণা ধ্বনিত হয় জনপ্রিয় সিরিজ ফুডকা খ্যাত ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর কথায়, যিনি বলেন শহর এবং দেশের পার্থক্যে বদলে যেতে পারে মিষ্টির আকার এবং আকৃতি কিন্তু মিষ্টি আমাদের সকলেরই সংস্কৃতি এবং মনস্তত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

‘মিষ্টি বিয়ন্ড বর্ডারস’ বিষয়ে আলোচনায় উপস্থিত সকলেই এ বিষয়ে একমত হন যে, মিষ্টিকে সীমানা দিয়ে বাঁধা যায় না। সময়, স্থান, উপকরণের সহজলভ্যতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং খাবারের ধর্মীয় রাজনীতির উপর নির্ভর করে মিষ্টির আকার, আকৃতি, স্বাদ এবং নামের পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দিনের শেষে মিষ্টির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য আমাদের সকলের।

কথায় কথায় আলোচনা এই পরিসর থেকে বেরিয়ে ছুঁয়ে ফেলে মিষ্টি ব্যবসায়ীদের চিরকালীন দুঃখ যে, কারিগরের সন্তানেরা এখন আর এই পেশায় আসতে আগ্রহী নন। জনপ্রিয় মিষ্টি প্রতিষ্ঠান কে.সি.দাসের কর্ণধার ধীমান দাস বলেন, নতুন প্রজন্ম শেফ হতে ইচ্ছুক হলেও মিষ্টির কারিগর হতে নারাজ। একই কথা শোনা যায়, ‘মিষ্টি অ্যাজ এ আর্ট ফর্ম’ আলোচনায় যেখানে সরকারের উচ্ছপদে আসীন শাওন সেন বলেন যে, এখনও পর্যন্ত হাতেকলমে মিষ্টি তৈরি শেখানোর কোনও পাঠ্যক্রম কোথাও নেই। এমনকি, কোনও হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্সের কোনও শাখাতেও এর অন্তর্ভুক্তি নেই। এটিই নতুন মিষ্টি কারিগর গড়ে তোলার পথের প্রধান অন্তরায়। এর কারণ হিসেবে সকলেই দায়ী করেন এই শিল্পের অসংগঠিত প্রকৃতিকে। যা এই শিল্পকে এবং মিষ্টি কারিগরদের উপযুক্ত সম্মান দিতে পারেনি। বাংলাদেশি পোশাকশিল্পী বিবি রাসেলও সহমত হয়ে বলেন যে এই শিল্পে নিযুক্ত দক্ষ কারিগরেরা আরও নতুন এবং সৃজনশীল কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু সেই কাজ করার জন্য তারা সঠিক পরিকাঠামো ও সাহায্য পান না।

image of sweets

দেশের পার্থক্যে বদলে যেতে পারে মিষ্টির আকার এবং আকৃতি কিন্তু মিষ্টি আমাদের সকলেরই সংস্কৃতি এবং মনস্তত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ছবি: সংগৃহীত।

একই ভাবে মিষ্টি শিল্পে মহিলা কারিগরদের অন্তর্ভুক্তি এই শিল্পের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিষ্টির ইতিহাসে দেখা যায়, প্রাচীনকালের সব মিষ্টিই ছিল বাড়ির মহিলাদের হাতে তৈরি। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই শিল্পে নিযুক্ত বেশির ভাগ কারিগররাই পুরুষ। রাজনীতিবিদ সায়রা শাহ হালিমের মতে, মেয়েরা হাতে তৈরি মিষ্টির ক্ষেত্রে যে রুচি এবং সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, তা ব্যবসায়িক ভাবে ব্যবহার হলে এই শিল্প অবশ্যই অন্য একটি মাত্রা পাবে। কিন্তু মেয়েদের এই পেশায় নিয়ে আসার মতো পরিবেশ এখনো আমরা তৈরি করে উঠতে পারিনি।

অন্য একটি আলোচনা ‘ইজ মিষ্টি সেক্সিস্ট’-এ উঠে আসে এই বিষয়ের অন্য একটি দিক। প্রফেসর ঈশিতা দে এই প্রসঙ্গে তুলে আনেন আরও একটি চমৎকার তথ্য যে, বাংলার বেশির ভাগ মিষ্টির দোকানগুলিই পারিবারিক মালিকানাধীন। বিশেষ পারিবারিক রেসিপিগুলির গোপনীয়তা রক্ষার্থে অনেক সময়েই বাইরের কারিগরকে নিযুক্ত করা হয়না। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মহিলারাও এই কাজের হাল ধরেন। বহু দিন থেকেই তারা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন, কিন্তু সামাজিক বিভিন্ন কারণে বেশির ভাগ সময়ে পর্দার পেছনে থেকেই কাজ করেন।

আলোচনা ছাড়াও এই সাহিত্য উৎসবে মিষ্টির ইতিহাস নিয়ে একটি ইনস্টলেশন রাখা ছিল। মিষ্টি তৈরি হাতেকলমে দেখানোর জন্য ছিল একটি কর্মশালা। এ ছাড়াও ছিল মিষ্টি টেস্টিং সেশন, যেখান শেফ ঋতুপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমার তত্ত্বাবধানে প্রাচীন সময় থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের আধুনিক ফিউশন মিষ্টির বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছিল রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা এবং বাড়িতে তৈরি করা বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া এবং বিরল মিষ্টির মাধ্যমে।

Sweets Sweets and Literature
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy