Advertisement
E-Paper

বহু বাধা পেরিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচারই জয়

হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ত্রুটি ছিল জন্ম থেকেই। ত্রুটি ছিল মস্তিষ্কেও। দু’কানেও ভাল করে শুনতে পেত না সে। আট বছরের তানডিন দোরজির ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়। তার মেরুদণ্ডটাও ছিল জন্ম থেকে বাঁকা। ফলে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সহজ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারত না তানডিন নানা ত্রুটিতে ভরা তার ছোট্ট শরীরকে স্বাভাবিক করা যাবে না, তা একপ্রকার স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন ভুটানের ডাক্তাররা।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৩৬
এক্স-রে প্লেটে বাঁকা মেরুদণ্ড। (ডান দিকে) অস্ত্রোপচারের পর।

এক্স-রে প্লেটে বাঁকা মেরুদণ্ড। (ডান দিকে) অস্ত্রোপচারের পর।

হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ত্রুটি ছিল জন্ম থেকেই। ত্রুটি ছিল মস্তিষ্কেও। দু’কানেও ভাল করে শুনতে পেত না সে। আট বছরের তানডিন দোরজির ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়। তার মেরুদণ্ডটাও ছিল জন্ম থেকে বাঁকা। ফলে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সহজ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারত না তানডিন।

নানা ত্রুটিতে ভরা তার ছোট্ট শরীরকে স্বাভাবিক করা যাবে না, তা একপ্রকার স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন ভুটানের ডাক্তাররা। থিম্পুর বাসিন্দা ন’বছরের তানডিনকে বাঁচাতে বাড়ির লোকেরা এর আগে তিন-তিন বার ভারতীয় ডাক্তারদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং কানে অস্ত্রোপচার করে তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন তাঁরাই। কিন্তু সাময়িক ভাবে প্রাণে বাঁচলেও বাঁকা মেরুদণ্ডের কারণে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হয়নি তানডিনের। ডাক্তাররা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ওই বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা না হলে তার হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়ে জীবনহানির আশঙ্কা ঘটাতে পারে। কিন্তু তাঁরা এ-ও বলেছিলেন, একের পর এক অস্ত্রোপচারে বিধ্বস্ত শরীর হয়তো মেরুদন্ডের অস্ত্রোপচারের ভার বইতে পারবে না। মনে সাময়িক দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও হাল ছাড়েননি তানডিনের বাড়ির লোকজন। আর ভুটানের ওই শিশুর বাড়ির লোকেদের মুখে শেষ পর্যন্ত হাসি ফোটাতে পেরেছেন দুর্গাপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।

মেরুদণ্ডের ওই গঠনগত সমস্যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে স্কোলিওসিস। এ ক্ষেত্রে মেরুদণ্ড সোজা হয়ে না বেড়ে বাঁকা হয়ে থাকে, নুয়ে পড়ে। জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক স্কোলিওসিস-এর চিকিৎসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকদের কাছেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ১০ বছর বয়সের পর থেকে মেরুদণ্ড দ্রুত বাড়তে থাকে। সাধারণ ভাবে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চতা বাড়ে। অস্ত্রোপচার করে মেরুদণ্ডটি রড লাগিয়ে সোজা করে দিলে উচ্চতা বাড়ে না। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়।


তানডিন দোরজি

সেই বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার পরে মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারটি করা যায় না? চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে প্রাণের বড়সড় ঝুঁকি তৈরি হয়। কারণ বাঁকা মেরুদণ্ড হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের বৃদ্ধিও ঠেকিয়ে দেয়। ছোট থেকেই মেরুগণ্ডের গঠনগত সমস্যা খুব বেশি মাত্রায় হলে হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুস তো বটেই, অন্য অঙ্গের ওপরেও প্রভাব পড়ে। তখন শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য অস্ত্রোপচার না করলেই নয়।

তা হলে বিকল্প উপায় কী? তানডিনের বাবার উচ্চতা ছ’ফুটেরও বেশি। তানডিনের বর্তমান উচ্চতা চার ফুট সাত ইঞ্চি। পরীক্ষা করে ডাক্তাররা বুঝেছিলেন, আরও অন্তত ৫২ সেন্টিমিটার উচ্চতা বাড়বে তার। এই পরিস্থিতিতে ‘গ্রোয়িং রড সার্জারি’র সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। অস্ত্রোপচারটি করেন দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালের স্পাইন সার্জন অভিষেক রায়।

কাকে বলে ‘গ্রোয়িং রড সার্জারি’? তিনি বলেন, ‘‘যদি মেরুদণ্ডের বৃদ্ধি আটকে যায়, তা হলে ফুসফুসও স্বাভাবিক ভাবে তৈরি হবে না। সে ক্ষেত্রে আয়ু কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই গ্রোয়িং রড অর্থাৎ যে রড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে নেওয়া যায়, তেমন সার্জারি করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর তানডিন এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। পরবর্তী ধাপে তানডিনের ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি ছ’মাস অন্তর স্ক্রু খুলে রডটা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। এটা ১৫ মিনিটের একটা ছোট ব্যাপার। এ জন্য হাসপাতালে ভর্তি থাকারও প্রয়োজন পড়বে না।’’

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মেরুদণ্ডের এমন গঠনগত সমস্যা যে চিকিৎসা করালে সেরে যায়, এই ধারণাটাই নেই অনেকের। আর তাই সুস্থ জীবন পায় না বহু শিশুই। এই ধরনের অস্ত্রোপচারকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্য চিকিৎসকেরাও। নিউরোসার্জন সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের উচ্চতাও বাড়ে। তাই ফিক্সড রড লাগানো সম্ভব নয়। গ্রোয়িং রড লাগালে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রু-এর সাহায্যে রডটিকে বাড়িয়ে তোলা যাবে। এই অস্ত্রোপচার না করলে মেরুদণ্ডের গঠনগত সমস্যা শিশুর হার্টের এবং ফুসফুসের বড়সড় ক্ষতি করতে পারে। এই অস্ত্রোপচার জটিল, কিন্তু সফল হলে একটি শিশু সম্পূর্ণ নতুন জীবন পেতে পারে।’’

মিশন হাসপাতালের চেয়ারম্যান সত্যজিৎ বসু বলেন, ‘‘তানডিন যখন এসেছিল তখন ওর ঝুঁকে থাকা একটা চেহারা। আর যখন হাসপাতাল থেকে বেরোল, তখন সোজা হাঁটছে। তৃপ্তির জায়গা এটাই।’’

— নিজস্ব চিত্র

Bhutan scoliosis heart doctor durgapur Soma Mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy