কথাতেই আছে বাঙালির দ্বারা নাকি ব্যবসা হয় না। কিন্তু কিছু কিছু বাঙালি সে কথা ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছেন। যেমন রোমিতা মজুমদার। তিনি একটি সংস্থার গোড়াপত্তন করেছেন এবং কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। দেশের নামী প্রসাধনী ব্র্যান্ড ফক্সটেল-এর কর্ণধার রোমিতা। ফোর্বস এশিয়ার সেরা একশোজন উদ্যোগপতির তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে।
কোভিডের মধ্যে নিজের সংস্থা শুরু করেছিলেন রোমিতা। তিনি কিন্তু কলকাতা নয়, রাঁচীর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মেয়ে। নিজের বাঙালিয়ানার প্রমাণ দিতে গিয়ে মজা করে বললেন, “চাউমিনে আলু দেওয়া বাঙালি পরিবারের মেয়ে আমি, এ বার বুঝলেন তো কতটা খাঁটি।” তাঁর ছোটবেলা কেটেছে রাঁচী, ধানবাদ আর কলকাতায়। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন। বলছিলেন, “আমার জ্যাঠা, পিসি থাকতেন কলকাতায়। ছুটি পড়লেই ওখানে যেতাম। কলকাতার দুর্গাপুজো আমাদের কাছে বড় আকর্ষণ ছিল। রাঁচীতেও বড় করে পুজো হয়। তুতো ভাই-বোনদের সঙ্গে প্যান্ডেলে ঘুরতাম। দশ টাকা দিত বাড়ি থেকে, ফুচকা, চিকেন রোল খেতাম। কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখের সামনে দিনগুলো ভেসে উঠছে।” এখনও সুযোগ পেলে পুজোর সময়টা মুম্বই থেকে কলকাতায় চলে আসেন।
রোমিতার বাবা-মা দু’জনেই রাঁচী হাই কোর্টের আইনজীবী। পরিবারের কারও ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। বিয়ে করেছেন মারোয়াড়ি পরিবারে, কিন্তু সেখানেও ব্যবসার সঙ্গে যোগ নেই। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন, পড়াশোনা করে ভাল চাকরি করবেন, সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। চলছিলও তেমনটাই। ইউসিএল-এ থেকে পড়াশোনা করে আমেরিকাতে চাকরি করছিলেন। কিন্তু রোমিতার ভাষাতেই, “মাথায় ঢুকে গেল নিজের কোম্পানি খুলতে হবে।” ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের যাবতীয় অভিজ্ঞতা বিনিয়োগ করলেন নিজের সংস্থার পিছনে।
বাঙালি চাকরি করবে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে চর্চা করবে কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করবে না। এই প্রথাগত ধারণা থেকে বেরোলেন কী করে? “বাঙালিরা যে ইন্টালেকচুয়াল, এটা কিন্তু সকলেই স্বীকার করবেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, জ্ঞান বাঙালিদের আছে। ব্যবসার জন্য সেটাই দরকার। আমি যখন ব্যবসা করতে শুরু করেছি, তখনও মা বলছে, ‘এক বছর চেষ্টা করে নাও, তার পর এমবিএ করো।’ মায়ের মতে, ব্যবসা করতে গেলে নির্মম হতে হয়, আমি অনেক নরমসরম।”
ক্ষেত্রবিশেষে রোমিতাকেও নির্মম হতে হয়েছে। ব্যবসার জগৎটা পুরোপুরি পুরুষশাসিত। সেখানে তাঁকে কতটা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে? “আমাদের বাড়িতে ছেলে-মেয়ের মধ্যে তফাত করা হত না। ব্যাঙ্কিং, ইনভেস্টমেন্ট সেক্টরে ছেলের সংখ্যা বেশি, কিন্তু সেখানেও তফাত বুঝিনি। আমার কাজ, মেধা গুরুত্ব পেয়েছে। ধাক্কা খেলাম ব্যবসা করতে গিয়ে। মেয়ে বলে ম্যানুফ্যাকচারাররা দেখাই করত না। অনেকে ভাবত, এটা আমার শখ। মেয়েদেরও যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, এটা ভাবত না,” বললেন রোমিতা।
আজ তিনি গর্বিত অন্ত্রপ্রনর। কিন্তু যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। “পেশাগত পরিচিতি তৈরি করাটাই আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি ছিল। নিজেকে একটা উচ্চতায় দেখতে চাইতাম।” একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা হলেও, নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চান না। মনে করেন, তাতে ফোকাস নড়ে যেতে পারে। বাজারে অসংখ্য স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড। তার পরেও নতুন পণ্যের পরিসর এবং প্রয়োজনীয়তা কি ছিল? “ইউএসএ-তে পড়ার সময়ে অল্প দামের কিছু স্কিনকেয়ার ব্যবহার করতাম। স্টুডেন্টদের কাছে আর কত টাকাই বা থাকে! কিন্তু জিনিসগুলো এত ভাল ছিল যে, যখন রোজগার করছি, তখনও ওগুলোই ব্যবহার করতাম। আমাদের দেশের প্রডাক্টগুলোর গুণগত মান আমাকে ক্রেতা হিসেবে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। একটা পর একটা প্রডাক্ট কিনে কিছুটা ব্যবহার করে ফেলে রেখেছি। এই জায়গাটাই আমি ধরতে চাইছিলাম। আমার তৈরি পণ্য যেন সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকে এবং তারা আমার ব্র্যান্ডের চিরস্থায়ী ক্রেতা হয়। এই কাজটা আমি গত তিন বছরে করতে পেরেছি।”
নতুন পণ্য নিয়ে আসার পিছনে দীর্ঘ গবেষণা, সমীক্ষা ছিল। “আমি নিজে নানা জায়গা ঘুরে তিন হাজার মহিলার সঙ্গে কথা বলেছি। ৪০০ ধরনের স্কিন টাইপ আছে আমাদের দেশে। তৈলাক্ত, শুষ্ক আর কম্বিনেশন— এই ক’টা ভাগ নয়। আমিষ, নিরামিষাশীদের ত্বকে তারতম্য আছে। সদ্য মা হয়েছে এমন আর মেনোপজ়ে পৌঁছে যাওয়া মহিলার ত্বকে তফাত আছে। যে বেশি রোদে পোড়ে তার ত্বক অন্য রকম,” ব্যাখ্যা করে বললেন রোমিতা। এই কাজে পাশে পেয়েছিলেন ডা. রমেশ সূর্যনারায়ণকে, যিনি সৌন্দর্যের দুনিয়ায় চমকপ্রদ পণ্য নিয়ে আসার জন্য খ্যাত।
তাঁর পণ্যের নামের নেপথ্য ব্যাখ্যাটাও সুন্দর বুঝিয়ে দিলেন রোমিতা। কর্নাটকের চিকমাগালুরের এক কফি প্ল্যান্টেশনে গিয়ে সারি সারি ফক্সটেল গাছ দেখেছিলেন। যে গাছের আসল কাজ হল তার গভীর শিকড় দিয়ে মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখা। অন্য দিকে, শেয়ালকে ধূর্ত বলা হয়, কিন্তু মা হিসেবে শেয়াল ভীষণ যত্নশীল। এই দুটো বিষয়কেই নিজের পণ্যের অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন রোমিতা। এখন তাঁর লক্ষ্য, নিজের ব্র্যান্ডকে ১০০০ কোটি টাকার সংস্থায় পরিণত করা।
ব্যবসা করতে গেলে কী কী গুণ প্রয়োজন? “দেখুন, আমি আজ যে কথাগুলো বলছি, সেগুলো সুন্দর, ইতিবাচক। কিন্তু জার্নিটা তেমন নয়। আমি ভীষণ জেদি। আমার ধাঁচটা হল একবার ভেবে নিয়েছি যখন, করেই ছাড়ব। তাতে যত দিন, বছর লাগে লেগে যাক। নাছোড়বান্দা মানসিকতা খুব প্রয়োজন। তবে শুরুতে মোটেই এত আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। ব্যবসা করতে গেলে অনেক কিছু ছাড়তে হয়। পরিবার-পরিজনকে বেশি সময় দেওয়া যায় না। দু’বছর আগে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি ছিল, কিন্তু আমি সে ভাবে তাকে দেখতে পারিনি। আমাকে একটা কোম্পানি চালাতে হয়, আমার উপরে অনেক মানুষের রুজিরুটি নির্ভর করে। এই দায়িত্বটা বিরাট।” ত্যাগ, পরিশ্রম, ব্যর্থতা... সবটা মেনে নিয়েই এ পথে এগোতে হবে— আগামী দিনের উদ্যোগপতিদের জন্য পরামর্শ রোমিতার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)