E-Paper

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব — এই ধারণা কি ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে? একা থাকতে থাকতে হয়তো ভুলে যাচ্ছি, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল বেঁধে বেঁধে থাকা।

দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:১২
ছবি: অমিত দাস।

ছবি: অমিত দাস।

একা চলা, একা থাকা। কারও সঙ্গে পোষাচ্ছে না, তা হলে তাকে দরকার নেই। একা দিব্যি আছি। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব— এই ধারণা কি ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে? কাউকে দরকার নেই, এটাও কি খুব সুস্থ ভাবনা?

একটা সময় ছিল, যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়ার প্রণাম, শুভেচ্ছা বিনিময় খুব স্বাভাবিক ছিল। সেটা এখন মুঠোফোনের বার্তায় সীমাবদ্ধ। ঘনিষ্ঠ কারও বাড়ি যাওয়ার আগে আমরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিই। একা থাকাকে নিজেরাই প্রাধান্য দিই। দশ জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাই না। একা থাকতে চাওয়া মোটেই খারাপ নয়। নিজস্ব পরিধি, স্বাধীনতা সকলের প্রয়োজন। এর ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে একাকিত্ব। বিশ্ব জুড়ে মহামারির আকার নিচ্ছে নাগরিক বিচ্ছিন্নতা।

সলিটিউড বনাম একাকিত্ব

একা থাকার ইচ্ছে ও একাকিত্বের মধ্যে তফাত আছে। বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন কনসালট্যান্ট ওল্ড এজ সায়কায়াট্রিস্ট দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। “একাকিত্ব এবং একান্তে থাকা দুটো আলাদা বিষয়। একা থাকা আমি উপভোগ করতে পারি। আবার অনেকের মধ্যে থেকেও কেউ একা থাকতে পারেন। এক্সপিরিয়েন্স অব সোশ্যাল অ্যান্ড ইমোশনাল ডিসকানেকশনকেই বলা হয় আরবান লোনলিনেস।” একই বাড়ির বিভিন্ন মানুষ মোবাইল, টিভিতে নিজের মতো মগ্ন হয়ে আছেন, নিজের দুনিয়ায় সকলে একা অথচ একসঙ্গে থাকেন। “একা থাকাটা যখন সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় পরিণত হয়, তখন সমস্যা তৈরি হয়,” মন্তব্য ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

যৌথ পরিবার থেকে অণু পরিবার। পাড়ার আড্ডা থেকে ভার্চুয়াল গ্রুপ... সকলেরই আলাদা প্রকোষ্ঠে বাস। যাঁরা কমবয়সি, কর্মজীবী তাঁদের ব্যস্ততা অনেক। সেখানে নানা জনের মন জুগিয়ে চলা, কাউকে জবাবদিহি করায় অনীহা স্পষ্ট। এ ভাবেই কাছের জনের তালিকা থেকে মামা, পিসি, কাকিমারা ক্রমশ বাদ পড়তে থাকেন। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিলে একাকী দ্বীপে নিশ্ছিদ্র শান্তি। সমাজতত্ত্ববিদ অধ্যাপক অনিরুদ্ধ চৌধুরী বলছিলেন, “মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে, মানুষ ছাড়া থাকতে পারে না। বাধ্যবাধকতার জন্য অনেক সময়ে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায় না। কিন্তু সমষ্টিগত যাপনটা আমাদের সংস্কৃতি। পাশ্চাত্যের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে একাকিত্বের আমদানি, নগরায়নের ফসল।” গ্রামের দিকে এখনও সমষ্টিগত সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায়, যা শহরে প্রায় বিলুপ্ত।

ব্যস্ততা অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়

যৌবনের ব্যস্ততা, কাজ, বন্ধুবান্ধব একাকিত্বকে আড়াল করে দেয়। তখন আত্মবিশ্বাস বেশি থাকে। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “এই সময়ে নিজের স্পেসটাকে খুব আগলে রাখে মানুষ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন শারীরিক জোর কমতে থাকে, মানসিক ভাবেও আমরা অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। অবসর, সন্তানের দূরে থাকা, স্বামী বা স্ত্রীর কারও একজনের চলে যাওয়া... তখন কিন্তু একা থাকার অভ্যেস ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।” মানসিক অবসাদ, ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্সের মতো রোগের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কেয়ারগ্রুপের কথা বলা হয় বটে, সেখানে আবেগ থাকে না। মানসিক সংযোগ, কাছের মানুষের হাতে হাত রাখা... এটা পরিবারের মধ্যেই পাওয়া যায়। কখন যে সলিটিউড একাকিত্বের রূপ নেয়, বোঝা যায় না।

প্রয়োজন সামাজিকীকরণ

নিউক্লিয়ার পরিবারের দাদু-ঠাকুরমা, জেঠি, কাকিমাদের সাহচর্য পায় না এখনকার খুদেরা। বাবা-মা দু’জনেই কর্মরত হলে ক্রেশ নয়তো গৃহসহায়িকা ভরসা। ভার্চুয়াল জগৎটাই ওদের আপনজন। সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে এরা বড় হয় না। ফলে এদের মানসিক গড়ন, মনোবৃত্তি ভিন্ন প্রকৃতির। ছোটদের মধ্যে মানসিক রোগ, উদ্বেগের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। এর নেপথ্যে একা থাকা, নিজের জগতের বাইরে কোনও কিছু নিয়ে তাপ-উত্তাপ না থাকার মতো কারণ রয়েছে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছিলেন, “বাচ্চারা বাড়িতে বাবা-মাকে বলতে শোনে ‘একটু স্পেস লাগবে। আমাকে নিজের মতো থাকতে দাও।’ এটা থেকে ওরাও স্বাধীনতার স্বাদ পায়। ১১-১২ বছরের ছেলেমেয়ের উপরে এর প্রভাব খুব বেশি। এরা ক্রমশ ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাধা দিলে উত্তর, তার স্পেস দরকার। এতে বাবা-মায়েরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এখানে প্রয়োজন ব্যালান্সিং।”

ছোটদেরও স্বাধীনতা জরুরি, কিন্তু এতে তারা যেন বহির্জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। জাপানের সরকার নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে হিকিকোমারির প্রভাব থেকে নতুন প্রজন্মকে আটকাতে। কী এই হিকিকোমোরি? কমবয়সিরা সমাজ থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিচ্ছে। একটা ঘরের মধ্যে মাসাধিক সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। এতটা জটিল না হলেও এ দেশে কমবয়সিদের মধ্যে ঘরকুনো হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। একা থাকা অভ্যেস করতে করতে বাচ্চারা নিজের সমস্যা, স্কুলের ঘটনা, বন্ধুর হাতে বুলি হওয়া, বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়া... কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারছে না। ইন্টারনেট দেখে সমস্যার সমাধান করছে। “এরা বাবা-মাকে সমস্যাগুলোর কথা জানাচ্ছে না। নেটের বিভিন্ন লেখা পড়ে আরও বিভ্রান্ত হচ্ছে। ভাবছে, ‘আমি কি ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি?’ ছোটদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো নষ্ট হচ্ছে।”

বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে বন্ধন

সমাজতত্ত্ববিদ থেকে মনোবিদ সকলেই ইন্টারজেনারেশনাল বন্ডকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক-মানসিক সংযোগ থাকতে হবে। দাদু-দিদার যেমন নাতি-নাতনির সাহচর্য প্রয়োজন, উল্টোটাও সত্যি। অনেক সময়েই দুই প্রজন্মের মধ্যে চিন্তাধারার মিল হয় না। সেটাকে জেনারেশন গ্যাপ বলে উড়িয়ে না দিয়ে, সেতুবন্ধনের দায়িত্ব নিতে হবে। দাদু তার নাতিকে সাইকেল চালাতে শেখাবেন। নাতনি তার ঠাকুরমাকে ইউটিউব ব্যবহার শেখাবে। এই উদ্যোগ নিতে হবে মাঝের প্রজন্মকেই। পায়েল বলছিলেন, “বাবা-মাকে বোঝাতে হবে যে দাদু-ঠাকুরমার প্রতি ছোটদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। ১২-১৩ বছরের বাচ্চাকে দাদু-দিদার জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী আয়োজনের দায়িত্ব দিন। এতে ওরা সকলের মধ্যে শামিল হবে।” ছোটদের স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতা আর একা হওয়ার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। একা বড় হওয়া বাচ্চারা বাইরে পড়তে গেলে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। অন্য রাজ্য থেকে আসা বাচ্চাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। এই সমস্যা পেশাগত জগতে প্রবেশের পরেও থেকে যায়। সাংগঠনিক ক্ষমতা, টিমওয়ার্কের দক্ষতা তৈরি হয় না।

ডা. দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক তুলে ধরলেন— বয়স্কদের জীবনযাপন সম্পর্কে ছোটরা যদি না জানে, সেটা তাদের মধ্যে এজিজ়মের জন্ম দিতে পারে। হু-র মতে, পৃথিবীর দু’জন মানুষের মধ্যে অন্তত একজন এজিস্ট আইডিয়াতে ভোগেন। বয়স খারাপ, বয়স হলে দেখতে বাজে হয়ে যায়... এগুলো থেকেই এজিজ়মের সৃষ্টি। এর থেকেই বয়স্ক নিগ্রহের ঘটনা বাড়ে। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “ছোট থেকে একটা দ্বীপের মধ্যে বড় হলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। আমি আমারটা বুঝব, তুমি তোমারটা। কিন্তু যদি কখনও আমার তোমাকে দরকার পড়ে? প্রশ্নটা ততক্ষণ আসে না, যতক্ষণ না আমাদের বয়স হয়। শিশুদের বৌদ্ধিক বিকাশ তখনই ঘটে যদি বিভিন্ন প্রজন্ম একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারে।”

সম্প্রতি কিছু সপরিবার আত্মহত্যার ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন অধ্যাপক অনিরুদ্ধ চৌধুরী। “এমন ঘটনা আগে দেখা যেত না। ওই পরিবারগুলোর কী সমস্যা ছিল তাঁদের আত্মীয়রাও জানতেন না। সবাই সুখী মুহূর্ত ফেসবুকে দেন, সমস্যা চেপে যান। আত্মীয়দের সঙ্গে সমস্যা ভাগ করে নিলে হয়তো সুরাহা বেরিয়ে আসত।”

আগে প্রত্যেক পরিবারেই এমন একজন থাকতেন, যিনি সকলের খোঁজখবর নিতেন, সব আত্মীয়ের বাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল। সেই রকম মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। চেষ্টা করলে আপনিও কিন্তু সেই মানুষটা হয়ে উঠতে পারেন।

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে... একা চলাই যায়। এক বার ডাক দিয়ে দেখতে তো ক্ষতি নেই।


মডেল: নিকুঞ্জবিহারী পাল, দীপান্বিতা হাজারি, রেজ়ওয়ান রব্বানি শেখ, অলিভিয়া সরকার, রাইমা গুপ্ত;

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Solitary

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy