Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হারলে চলবে না, বার্তা অনির্বাণ-অঞ্জলির

দ্রুত প্যাডেল চলছে সাইকেলের। ভিড়ে ঠাসা শহুরে রাস্তা, গ্রামের মেঠো আলপথ, পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে ছুটছে এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে। সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে দৈনন্দিন ব্যবহারের সামান্য টুকিটাকি। কিছু কাগজপত্র আর ছবি। কখনও কোনও চায়ের দোকান, কখনও বাড়ির দাওয়া, আবার কখনও বা বিকেলে পার্কের জমায়েতে সেই কাগজ আর ছবির ঝোলা খুলে সাইকেল আরোহী ৩০ ছুঁই ছুঁই এক যুবক বলে চলেছেন তাঁর ওই ছুটে চলার উদ্দেশ্য।

সম্বল একটি পা। তাতেও থেমে নেই নাচের মহড়া। সুভাষগ্রামের বাড়িতে অঞ্জলি। ডান দিকে অনির্বাণ।

সম্বল একটি পা। তাতেও থেমে নেই নাচের মহড়া। সুভাষগ্রামের বাড়িতে অঞ্জলি। ডান দিকে অনির্বাণ।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০১
Share: Save:

দ্রুত প্যাডেল চলছে সাইকেলের। ভিড়ে ঠাসা শহুরে রাস্তা, গ্রামের মেঠো আলপথ, পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে ছুটছে এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে। সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে দৈনন্দিন ব্যবহারের সামান্য টুকিটাকি। কিছু কাগজপত্র আর ছবি। কখনও কোনও চায়ের দোকান, কখনও বাড়ির দাওয়া, আবার কখনও বা বিকেলে পার্কের জমায়েতে সেই কাগজ আর ছবির ঝোলা খুলে সাইকেল আরোহী ৩০ ছুঁই ছুঁই এক যুবক বলে চলেছেন তাঁর ওই ছুটে চলার উদ্দেশ্য।

অন্য জনের বয়স মেরেকেটে ১৪। একটা পা আসল। অন্যটা কাঠের। বাড়িতে নিত্য অভাব। রয়েছে নিজের রুগ্ণ শরীরের নানা বাধাও। তবু সে সব উপেক্ষা করে সেই কিশোরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন মঞ্চ। একটা মাত্র পা-কে সম্বল করেই চলছে তার নাচের অনুষ্ঠান। চলছে পড়াশোনাও।

এই খবরের মূল চরিত্র এঁরা দু’জনেই। সাইকেল নিয়ে যিনি চষে বেড়াচ্ছেন গোটা দুনিয়া আর মাত্র একটা পায়ের ভরসাতেই যে মাতিয়ে চলেছে একের পর এক নাচের অনুষ্ঠান। দু’জনে আসলে একটাই বার্তা পৌঁছে দিতে চান সর্বত্র। ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু!’ মারণ রোগ বলে পরিচিত ক্যানসারকে হারিয়ে যাঁরা জীবনের মূল স্রোতে ফিরেছেন, তাঁদের গল্প অন্যদের শোনানোই এখন এঁদের জীবনের ব্রত।

ছোট থেকেই সাইকেল চালানো এবং নানা অ্যা়ডভেঞ্চার স্পোর্টসের নেশা ঢাকুরিয়ার অনির্বাণ আচার্যের। বাড়িতে ক্যানসার আক্রান্ত কেউ ছিলেন না। কিন্তু ছোট থেকেই চারপাশে, আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেককে দেখেছেন যাঁরা এই রোগের শিকার। খুব কাছ থেকে সমস্যাগুলো দেখতে দেখতে বুঝতে পারতেন, রোগটার কাছে মানুষ কতটা অসহায়। অনির্বাণের কথায়, ‘‘লড়াইটা শুরুর আগেই হেরে বসে থাকতে দেখতাম সকলকে। রাগ হতো। মনে হতো, লড়াই শুরু না করেই জমি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? যাঁরা রোগটার সঙ্গে যুদ্ধ করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, কেন তাঁদের কথা কেউ বলছে না?’’

এই মনে হওয়া থেকেই নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের ছবিটা এঁকে ফেলেন তিনি। ক্যানসার নিয়ে কাজ করা কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসে। দিল্লিতে গিয়ে ইন্ডিয়ান ক্যানসার সোসাইটিতে প্রশিক্ষণও নিয়ে আসেন। গত পাঁচ বছরে এটাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ইতিমধ্যে দেশের অধিকাংশ জায়গায় ঘোরা হয়ে গিয়েছে। চলতি মাসেই ক্যানসার সচেতনতা এবং ক্যানসার রোগীদের মূল স্রোতে ফেরার বিভিন্ন ঘটনার প্রচারে বিশ্ব ভ্রমণে বেরোচ্ছেন বাণিজ্যে স্নাতক অনির্বাণ। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে বাবা-মা-দাদাকে বোঝাতে বছর চারেক সময় লেগেছে। বন্ধুরাও বলত, আমি নাকি পাগলামি করছি। এখন সকলেই আমার উদ্দেশ্যটা বোঝে। বরাবরই ইচ্ছা ছিল, এমন কিছু করব, যাতে অনেক মানুষের উপকার হয়। সেই স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ হচ্ছে।’’ এই স্বপ্ন পূরণের পথেই অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ হয় সুভাষগ্রামের অ়ঞ্জলি রায়ের। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে অঞ্জলি ছোট্টবেলা থেকেই খুব ভাল নাচত। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বহু পুরস্কারও পেয়েছে। একাধিক রিয়্যালিটি শো-তেও তার নাচ অনেকের নজর কেড়েছিল। তার পর একদিন পায়ে ক্যানসার ধরা পড়ল। চিকিত্‌সা পরিভাষায় যে ক্যানসারের নাম অস্টিওসার্কোমা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় ঠাকুরপুকুরের একটি ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি করা হলো অঞ্জলিকে। দীর্ঘ চিকিত্‌সায় রোগের হাত থেকে বাঁচল ঠিকই, কিন্তু বাদ গেল একটি পা।

এর পরের লড়াইটা আরও কঠিন। স্বাভাবিক জীবনযাপন বজায় রাখতে গেলে কাঠের পা দরকার। কিন্তু সেই পা কেনার টাকা আসবে কোথা থেকে? নিজের আঁকা দুর্গা ঠাকুরের ছবিওলা কার্ড বিক্রি করে পায়ের দাম জোগাড় করে ওই কিশোরী। অসম্ভব মনের জোরকে সঙ্গী করে ওই নকল পায়েই শুরু হয়েছে নতুন জীবনের পথে যাত্রা। শুধু নাচ নয়, সঙ্গে চলছে ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বা়ড়ানোর কাজও। অঞ্জলির কথায়, ‘‘হেরে যাওয়াটা সহজ। লড়াই করাটা কঠিন। আমি সকলকে লড়াই করার কথা বলি।’’

অনির্বাণও মানুষকে অঞ্জলির এই লড়াইয়ের গল্প শোনাচ্ছেন। আর শোনাচ্ছেন, দৈনন্দিন জীবনযাপন কী ভাবে ক্যানসারকে ঠেকাতে পারে, তার নানা তথ্য। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অঞ্জলি ও অনির্বাণের এই লড়াইয়ে শুরু থেকেই সহযোগিতা করেছে, সেটির তরফে পার্থ সরকার বললেন, ‘‘সচেতনতার অভাবের সমস্যাটা ক্রমশ অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। অথচ ঠিক সময়ে ধরা পড়লে এবং চিকিৎসা শুরু হলে যে রোগটাকে অনেকটাই জয় করা সম্ভব, অর্পণ সর্দার, শাহবাজ সরকার, সানি মাচুয়া, কাজল বাউরির মতো শিশুরা তারই প্রমাণ। দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে এরা এখন সুস্থ। দরকার শুধু সচেতনতা আর পুনর্বাসনের চেষ্টা।’’

যে ক্যানসার হাসপাতালে অঞ্জলির চিকিৎসা চলেছিল, সেখানকার অধিকর্তা অর্ণব গুপ্তও জোর দিয়েছেন সচেতনতার ওপরেই। তাঁর কথায়, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই ঠিক সময়ে হয়তো রোগটা ধরা পড়ল। চিকিৎসাও হলো। কিন্তু সেরে ওঠার পরে ফলোআপ হলো না। এটা খুব বিপজ্জনক। আমরা এখন সেরে ওঠাদের তথ্যপঞ্জি তৈরি করে নিজেরাই যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছি।’’

ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মুখের বিভিন্ন ক্যানসার এবং স্তন, জরায়ু, পাকস্থলী, অন্ত্র, জার্মসেল (যুবরাজ সিংহের যা হয়েছিল)-সহ বেশ কিছু ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সেরে যায়। শুধু এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং তিনি যে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন, সেই ডাক্তারের সচেতনতাটা জরুরি।

সেটা কেমন? ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘ধরা যাক, কারও বহু দিন ধরে চোঁয়া ঢেঁকুর উঠছে। কোনও ওষুধেই সারছে না। এ ক্ষেত্রে তাঁর একটা এন্ডোস্কোপি তো অবশ্যই করানো উচিত। দেরি করে ফেললে খেসারত দিতে হয়।’’

শুধু তো প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়া নয়, তারই পাশাপাশি জরুরি হলো রোগটাকে ঠেকানোর চেষ্টা করা। এ ব্যাপারে ‘লাইফস্টাইল’-এর উপরেই জোর দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘লাইফস্টাইলের মূলত তিনটি দিক। খাওয়াদাওয়া, নেশা এবং যৌন অভ্যাস। এ সবে রাশ টানলেই প্রতিরোধের অনেকগুলো ধাপ পেরোনো সম্ভব।’’ একই কথা বলেছেন ক্যানসার চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ও।

অনির্বাণের ঝোলায় এখন ঘুরছে এমন নানা তথ্য-সংক্রান্ত কাগজপত্র। আর ক্লাস সিক্সের ছাত্রী অঞ্জলির মুখে মুখে এখন এই হাল না ছাড়ারই মন্ত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cancer dancer anirban anjali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE