E-Paper

খুকি তোমার ভারী ছেলেমানুষ

বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে পরিণত না হলে সেই শিশুটি কি দলছুট হয়ে পড়ে? কম বয়সে পরিণতমনস্ক হওয়া মানেই কি ‘পাকা’? রইল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২৩ ০৬:১৭
Caring mother comforting her little crying son at home

কম বয়সে পরিণতমনস্ক হওয়া মানেই সে ‘পাকা’ নয়। — ফাইল চিত্র।

তিন্নির এ বার ক্লাস ফাইভ। এ দিকে এখনও তার খেলার সঙ্গী পুতুল। ক্লাসের অন্য বন্ধুদের কাছে সে দুধভাত। এতে দলছুট হয়ে পড়ছে সে। কাছের বন্ধুরা হঠাৎ কেন কাছছাড়া হয়ে পড়ছে সেটাও বুঝতে পারছে না।

আবার দিনকতক আগেই মেঘনার জন্মদিনে দেখা হল অমৃতার সঙ্গে। ছেলেকে নিয়েই এসেছিল সে। ছেলেকে দেখিয়ে সে শুধু বলে গেল, “আমার ছেলে ক্লাস সেভেন হলে কী হবে! এত ছেলেমানুষ। কিচ্ছু বোঝে না।”

চারপাশে এমন উদাহরণ প্রায় হরবখত দেখা যায়। ক্লাসের দশটা বাচ্চার মধ্যে দু’জন হয়তো একটু কম পরিণত। অনেক সময়ে দেখা যায়, ‘ছেলেমেয়ে কিচ্ছু বোঝে না’ বলে মা-বাবা গর্ব প্রকাশ করছেন। আবার একটু পরিণত শিশুটিকে ‘পাকা’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। এর কোনওটাই কিন্তু কাম্য নয়। ছেলেদের এখন বয়ঃসন্ধি শুরু বারো-চোদ্দোয় আর মেয়েদের সূচনা দশ থেকে বারোয়। ফলে বয়স অনুযায়ী তাদের মানসিক জগতে পরিবর্তন আসাটাও স্বাভাবিক।

পরিণত মানেই পাকা বলে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়

সাইকোথেরাপিস্ট জলি লাহা বলছেন, “প্রত্যেক বয়সের নিজস্ব অনুসন্ধিৎসা আছে, জিজ্ঞাস্য আছে, কৌতূহল আছে। সেগুলো কোনও শিশু প্রকাশ করছে মানেই সে পাকা নয়। বরং সে পরিণত। আর যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ম্যাচিয়োর হওয়ার দরকার আছে বইকি! মনে রাখতে হবে, পরিণত শিশুরা কিন্তু প্রয়োজনে নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অস্বস্তিকর বা বিপরীত পরিস্থিতিতে পড়লেও সে ঠিক সামলে বেরিয়ে আসতে পারে।” এতে তাকে ‘পাকা’ বলে দাগিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। বয়স অনুযায়ী পরিণত তো হতেই হবে। সব কিছু নিক্তিতে মেপে ‘ভাল ছেলে’ বা ‘ভাল মেয়ে’র নির্দিষ্ট সংজ্ঞার মধ্যে সন্তানকে পুরে ফেলার চেষ্টা মা-বাবাকে ত্যাগ করতে হবে। মানসিক একটা খাঁচার মধ্যে সন্তানকে বন্দি করে নয়, বরং পৃথিবীটাকে মুক্তমনে দেখতে শিখুক ওরা।

কিন্তু এখন অনেকাংশেই দেখা যায়, অতি রক্ষণশীল অভিভাবকত্বের জেরে বা বাবা-মায়ের যথাযথ সময় না দেওয়ার কারণে অপরিণত থেকে যাচ্ছে বহু বাচ্চা। জলি বললেন, “অনেক সময়ে মা-বাবারা একেবারে বেঁধে-বেঁধে বড় করেন সন্তানকে। সকালে উঠেই স্কুল, স্কুল থেকে ফিরেই খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। তার পর তুলেই টিচারের কাছে পড়তে বসিয়ে দিলেন। চারপাশের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এ ভাবে সন্তানকে মানুষ করলে সে কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানবে না। নিজে থেকে বন্ধু তৈরি করতে পারবে না। সব জায়গায় দলছুট হয়ে পড়বে। পরে এ রকম শিশুরাই দেখেছি, কলেজে গিয়ে বা বৃহত্তর জগতে মানিয়ে নিতে না পেরে মানসিক কষ্টে ভোগে। এমন উদাহরণও রয়েছে, যেখানে মা এসে বলছেন, কলেজে পাঠরত মেয়ে মাকে বলছে, তার সঙ্গে কারও বন্ধুত্ব করিয়ে দিতে। আসলে সে তো জানেই না কী ভাবে বন্ধুত্ব করতে হয়। কী গল্প করতে হয়।”

ফলে ক্রমশ সে একা হয়ে পড়ে। হয়তো দেখা গেল শিশুটি এমনিতে মেধাবী, কিন্তু এই ধরনের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে সে মানসিককষ্টে ভুগে পড়াশোনায়অবহেলা করছে। প্রত্যেকটি শিশুর বড় হওয়ার ক্ষেত্রেস্বাভাবিক প্রত্যেকটি পর্যায় জরুরি বলে মনে করছেন জলি।

বহির্জগতে মিশতে দিতে হবে

এই প্রসঙ্গে পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ আর একটি দিক উল্লেখ করলেন, “এখনকার বাচ্চাদের অভিভাবকরা একটা বৃত্তের মধ্যে রেখে বড় করেন। তাদের বহির্জগতে একা বেরোতে দেওয়া প্রায় হয়ই না। বিশেষ করে এখনকার অধিকাংশ শিশুদের বাজারদর, পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। এ দিকে তারা বেশির ভাগ সময়ে ফোন ও ল্যাপটপে যে জগৎটার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, সেটা চাকচিক্যে মোড়া। কিন্তু বাস্তব যে সব সময়ে অত উজ্জ্বল নয়, সেটা বোঝার মতো বোধ তৈরি হচ্ছে না।” এখন অধিকাংশ শিশুই চাকচিক্যে অভ্যস্ত, কিন্তু তা আয়ত্ত করা কতটা কষ্টসাধ্য, সে সম্পর্কে ধারণা নেই। তারা জানছে বেশি, বুঝছে কম।

যে বিষয়ে নজর রাখা জরুরি

  • সন্তানের বন্ধুমহলে মা-বাবার প্রবেশ নয়। অনেক সময়েই দেখা যায়, ‘বন্ধুকে নিয়ে খেলো’, বলে নিজের সন্তানকে অনেক মা এগিয়ে দেন। তিনিই মধ্যস্থতা করে দেন। সেটা একেবারেই উচিত নয়। পাড়ায় বা স্কুলে বাকি বন্ধুদের মাঝে নিজের জায়গা ওকে নিজেকেই করতে দিন। মা-বাবারা যদি ছোটবেলায় ফিরে তাকান, দেখবেন তাদের দলেও হয়তো কেউ দুধভাত ছিল। কিন্তু সে-ও ক্রমশ বন্ধুদলের অংশ হয়ে গিয়েছে।
  • ‘ওগুলো বড়দের কথা’ বলে সন্তানের কৌতূহল চাপা দেবেন না। বয়সের নিয়মেই সে বহির্জগতে যা দেখছে, সেই সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হচ্ছে। “তার বয়সোচিত যুক্তি দিয়ে তাকে সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে,” বলে পরামর্শ দিলেন জলি।
  • স্কুলের স্পোর্টস বা অ্যানুয়াল ডে-তে সে কী করবে, কোন বিভাগে নাম দেবে... এই সিদ্ধান্তগুলো ওকে নিজেকেই নিতে দিন।
  • বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তানকে একটু অভাবে বড় করা ভাল। অল্পের মধ্যেই কী ভাবে চলতে হয়, সেটা শিখতে-শিখতেই অনেক বোধ তৈরি হয়ে যায়।

সন্তানকে খোলসের মধ্যে রেখে বড় করলে তার কিন্তু মানসিক বাড়বৃদ্ধি হবে না। একদিন তার খোলস ছেড়ে বাস্তবের কড়া জগতে কিন্তু তাকে পা রাখতেই হবে। তাই একটু-একটু করে খোলসের বাইরেও তাকে ছাড়তে হবে। সন্তান নিজের পরিণত বুদ্ধির জোরে জগতে প্রতিষ্ঠিত হলে, সেটাই তো গর্বের।

নবনীতা দত্ত

ছবি: অমিত দাস

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Maturity

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy