Advertisement
E-Paper

একা শহরে আরও একাকী শৈশব

কমিশনের এক সদস্যের কথায়, ‘‘নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরীর কথা বলার মতো কেউ ছিল না। নিজের বিপন্নতার কথাও সে কাউকে বলতে পারেনি। তাই লজেন্স কিংবা যে কোনও খাবারের প্রতিই তার প্রবল টান।’’

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:৪৪
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

বলার মতো কেউ ছিল না। কেউ নেই আশপাশে যাকে বলা যায়। রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের সদস্যেরা যখন মানসিক অবসাদের শিকার হওয়া ওই কিশোরীর কাউন্সেলিং শুরু করেছিলেন তখন তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, গভীর অবসাদে ভুগছে কাউকে নিজের কথা বলতে না-পারা কিশোরীটি। হাতের সামনে যাকে পাচ্ছে, যা পাচ্ছে, তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে সে। হোক না লজেন্স। সেই লজেন্সই যেন তার বেঁচে-থাকা! কমিশনের এক সদস্যের কথায়, ‘‘নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরীর কথা বলার মতো কেউ ছিল না। নিজের বিপন্নতার কথাও সে কাউকে বলতে পারেনি। তাই লজেন্স কিংবা যে কোনও খাবারের প্রতিই তার প্রবল টান।’’

কিশোরীর ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। তার ঘটনার প্রেক্ষিত হয়তো আলাদা, অভিঘাত আলাদা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হল, তার একাকিত্ব এবং কাউকে বলতে না-পারার প্রবল অসহায়তা, সর্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বন্ধুত্বের জালের মধ্যেও তার কী বিপন্ন ‘বন্ধুহীনতা’! ‘‘শহরের শিশু-কিশোরেরা এমন একটা রুটিনে বড় হয়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে যে, তাদের সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে। ফলে একা, আরও একা হয়ে যাচ্ছে তারা।’’— বলছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম।

অনেকের মতে, এই একা হওয়ার যাত্রাটা আসলে বহুমাত্রিক ও নিঃশব্দ। আশপাশের অনেক শৃঙ্খল, অনেক গণ্ডি ডিঙিয়ে অল্পবয়সিরা এই শহরে ধীরে-ধীরে একা হয়ে যাচ্ছে। আর একা হওয়ার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আওয়াজ নেই, ঘটনার প্রাবল্য নেই। শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো আলাদা হয়ে যাওয়াটুকুই রয়েছে। তবে নির্জনতা আর এই একাকিত্ব এক জিনিস নয়, বলছেন কবি জয় গোস্বামী।

নির্জন থেকেও শৈশব সৃষ্টিশীল হতে পারে, বরং সৃষ্টি নির্জনতাই দাবি করে। কিন্তু একাকিত্ব এমন এক বিষণ্ণবৃত্ত যা থেকে সহজে বেরোতে পারে না শৈশব-কৈশোর! জয় বলছেন, ‘‘অনেক সময়ে অনেক শিশু নিজে থেকেই নির্জনতা চায়। অনেকে একা-একাই আঁকতে ভালবাসে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখি, সবকিছুতে সেরা করার জন্য অভিভাবকদের প্রবল চাপই শিশু-কিশোর মনকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’’

কিন্তু একাকিত্ব তো পরিণত অনুভূতি, অল্পবয়সিরা কি সেটা আদৌ বুঝতে পারছে? সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু জানাচ্ছেন, পারছে! ভীষণ ভাবেই পারছে। তাঁর কথায়, ‘‘অনুভূতির নামটা হয়তো অল্পবয়সিরা জানে না। কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়ে চুপ করে বসে আছে, তার বাবা-মা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কী রে, চুপ করে বসে কেন? কী হয়েছে?’ তখন সে বলছে, ‘ভাল লাগছে না!’ এই যে ভাল না-লাগাটা কিন্তু একাকিত্বের কারণে আসছে।’’

প্রজন্মগত ব্যবধানে বড় হয়ে ওঠার মধ্যে যে পার্থক্য থাকবে, তা মেনে নিচ্ছেন সকলেই। তাই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের উপস্থিতি থাকবে, যেমন ভাবে পাড়ার মোড়ে আড্ডার জায়গায় থাকবে শপিং মলে আড্ডার সংস্কৃতি। কিন্তু শহরের মানচিত্রে মাঠ না থাকাটা কিশোর-মনের উপরে আলাদা প্রভাব ফেলছে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘টেলিভিশনের সামনে বসে ফুটবল-ক্রিকেট দেখছে বাচ্চারা। অথচ তাদের খেলার কোনও মাঠ নেই। শহরে সবুজের পরিমাণ উদ্বেগজনক ভাবে কমে আসছে। ফলে অল্পবয়সিরা এ শহরে যে একাকিত্বে ভুগবে, তা আর আশ্চর্যের কী!’’

শুধু কি সবুজ! মনের ভিতর থেকে পূজাবার্ষিকী, মহালয়ার মতো বহমান সংস্কৃতির থেকে বিযুক্ত হওয়াটাও কিশোর মনকে একলা করে তুলছে বলে জানাচ্ছেন লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে শুধু অন্যদের থেকে নয়, অল্পবয়সিরা একলা হয়ে যাচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকেও। কিন্তু আমার মনে হয়, এই একাকিত্ব অনেকটাই আরোপিত। আড্ডা দিতে-দিতেই অল্পবয়সিরা ডুবে যাচ্ছে যে যার মোবাইলে। সোশ্যাল মিডিয়ার নেশা কিন্তু স্লিপার সেলের মতো কাজ করছে, যা আরও একা করে তুলছে পরবর্তী প্রজন্মকে।’’ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ কর বলছেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় সহজে বন্ধুত্ব করে ফেলছে অল্পবয়সিরা। কিন্তু সে বন্ধুত্বে বিশ্বাস তেমন থাকছে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। ফলে ফ্রেন্ড লিস্টে হাজার জন বন্ধু থেকেও অনেকে মনে-মনে একলাই থেকে যাচ্ছে।’’

আর সেই সমস্ত অবিশ্বাসের জায়গায়, অসহায় একাকিত্বের জায়গায় হয়তো অবশ্যম্ভাবী, অমোঘ হয়ে উঠছে ‘সুধা তোমাকে ভোলেনি’র আশ্বাস! কেউ তো আছে যে মনে রাখছে, কেউ তো আছে যে ভোলেনি, জানাচ্ছেন অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য। সৌরীনবাবু বলছেন, ‘‘আসলে এটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা। বিশ্বাসের কথা, ভরসার কথা। কেউ মনে রাখছে, বয়সের গণ্ডি ডিঙিয়ে সকলের ক্ষেত্রেই যেন এই কথাটা খাটে।’’

তাই সমস্ত একাকিত্বেই ‘সুধা তোমাকে ভোলেনি’ কথাটা যেন অমোঘ! শহুরে একাকিত্বে ওই কথাটুকু যেন সেই লাইটহাউস, যাকে অনেক দূর থেকে দেখে বিশ্বাস করা যায়, ভরসা করা যায় এই ভেবে যে, ওই না-ভোলা, পাশে থাকার কাছাকাছি কোথাও যেন একটা বসতি রয়েছে— বন্ধুত্বের বসতি, একাকিত্ব থেকে উত্তরণের বসতি!

Childhood Depression
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy