Advertisement
E-Paper

মরণাপন্নকে জীবন ফিরিয়ে দেয় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন

চিকিৎসা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করার ফলে সুস্থ জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব। কী ভাবে? জেনে নিন বিশদে।

ঊর্মি নাথ 

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২১ ১৩:৩০

ব্লাড ক্যানসার বা লিউকিমিয়া, লিমফোমা, মায়েলোমা, অ্যাপ্ল্যাসটিক অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া ইত্যাদি রোগের কথায় সাধারণ মানুষ মাত্রই ভয় পান, বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এই সব রোগে আক্রান্ত মানুষটি ফিরে আসেন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে। কোনও ম্যাজিক নয়, তা সম্ভব হয় বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (বিএমটি) বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। ভারতের বিভিন্ন বড় হাসপাতালের পাশাপাশি এই প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা আমাদের রাজ্যের হাসপাতালগুলিতেও রয়েছে।

অস্থিমজ্জা আসলে কী?

শরীরের হাড়ের ভিতরে এক রকম নরম পদার্থ থাকে, যাকে ম্যারো বা মজ্জা বলে। এই মজ্জাই হল রক্ত তৈরির কারখানা। সহজ করে বললে, মজ্জার মধ্যে থাকে স্টেম সেল, যার থেকে লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকা এবং অনুচক্রিকা বা প্লেটলেট তৈরি হয়। লোহিত রক্তকণিকার উপরে আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস নির্ভর করে। শ্বেত রক্তকণিকা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখে। অনুচক্রিকা ঠিক মতো তৈরি না হলে রক্ত জমাট বাঁধে না। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন মানে ডোনরের কাছ থেকে সুস্থ স্টেম সেল নিয়ে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা। এই জন্য একে স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টও (এসসিটি) বলে। এই বিষয়ে হেমাটো-অঙ্কোলজিস্ট ডা. শর্মিলা চন্দ্র বললেন, ‘‘বেশ কিছু ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য রোগীকে উচ্চমাত্রায় কেমোথেরাপি এবং রেডিয়োথেরাপি দেওয়া হয়। যার প্রভাবে খারাপের সঙ্গে ভাল অস্থিমজ্জাও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে দাঁড়ায়। আর এখানেই দরকার হয় এসসিটি। নষ্ট হয়ে যাওয়া অস্থিমজ্জা বাতিল করে সুস্থ স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায়।’’

প্রতিস্থাপনের পদ্ধতি

রক্তের যেমন একাধিক গ্রুপ থাকে, তেমন স্টেম সেলের মধ্যেও একাধিক টিসু গ্রুপ থাকে, যাকে এইচএলএ (হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেনস) বলে। এই প্রতিস্থাপনে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে এইচএলএ ম্যাচ হওয়া জরুরি।

অটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্ট

এক্ষেত্রে রোগী নিজেই দাতা। কোনও কোনও ক্যানসারের চিকিৎসায় রোগীকে হাই ডোজ় কেমো বা রেডিয়েশন দেওয়ার আগে তাঁর শরীর থেকে ভাল স্টেম সেল সংগ্রহ করে রাখা হয়। কেমো দিয়ে হাড়ের মধ্যে থাকা অস্থিমজ্জা সম্পূর্ণ ফাঁকা করে দেওয়ার দু’দিন পরে সঞ্চয় করে রাখা সেল প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে রোগী যেহেতু নিজেই দাতা, তাই এইচএলএ ম্যাচের প্রসঙ্গ আসে না।

অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্ট

এ ক্ষেত্রে দাতা হবেন অন্য ব্যক্তি। এই প্রতিস্থাপনের কয়েকটি প্রকারভেদ আছে—

ম্যাচড সিবলিং ট্রান্সপ্লান্ট: আমরা জন্মসূত্রে মা-বাবার কাছ থেকে এইচএলএ পাই। তাই ভাই-বোনের মধ্যে এইচএলএ ১০০ শতাংশ ম্যাচ হওয়া সম্ভব। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। সংখ্যায় কম হলেও কিছু ক্ষেত্রে ভাই-বোনের মধ্যে এইচএলএ ম্যাচ হয় না।

হ্যাপলোটাইপ মিসম্যাচড ট্রান্সপ্লান্ট: এক্ষেত্রে দাতা হন বাবা–মার মধ্যে যে কোনও একজন। মা এবং বাবা যেহেতু দুটো আলাদা পরিবার থেকে আসেন, তাই তাঁদের যে কোনও একজনের সঙ্গে সন্তানের ৫০ শতাংশ অবধি এইচএলএ ম্যাচ করানো সম্ভব হয়।

ম্যাচড আনরিলেটেড ট্রান্সপ্লান্ট: এক্ষেত্রে দাতা পরিবারের বাইরের অজানা ব্যক্তি। কম্পিউটারের মাধ্যমে গ্রহীতার টিসু গ্রুপের সঙ্গে মিল আছে এমন কাউকে দাতা হিসেবে খুঁজে নেওয়া হয়। তবে এ পদ্ধতি বেশ সময়সাপেক্ষ ও খরচসাপেক্ষ। কিন্তু ম্যাচড সিবলিং ট্রান্সপ্লান্টের বাইরে সম্পূর্ণ সফল প্রতিস্থাপনের একমাত্র উপায় এটিই।

আমবিলিক্যাল কর্ড ব্লাড ট্রান্সপ্লান্ট: এ ক্ষেত্রে নবজাতকের আমবিলিক্যাল কর্ড থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে, প্রতিস্থাপন করা হয়।

প্রতিস্থাপনের আগে পরে

প্রতিস্থাপনের আগে ডোনারকে গ্রোথ ফ্যাক্টর ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এই ইঞ্জেকশন রক্তকে স্টিমুলেট করে স্টেম সেলকে রক্তের মধ্যে নিয়ে আসে। সেটা সংগ্রহ করে শিরার মধ্য দিয়ে রোগীর রক্তে স্টেম সেল প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়, যা রক্ত সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে চলে যায় দেহের সব হাড়ের ভিতরে। সেখানে প্রতিস্থাপিত হয়ে শুরু করে দেয় স্বাভাবিক রক্তকণিকার উৎপাদন। একে বলা হয় এনগ্র‌াফ্টমেন্ট। কেমোথেরাপির মাধ্যমে রোগীর হাড়ের ভিতরে সমস্ত মজ্জা খালি করে ফেলার দু’দিন পরে স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করা হয়। এই খালি করার সময়টা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়ে শরীরে একেবারেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকায় বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। অ্যালোজেনিক প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ডোনরের স্টেম সেল রোগীর নিজের সেলে পরিণত হতে প্রায় দু’-তিন সপ্তাহ লাগে। ‘ফরেন বডি’ অর্থাৎ দাতার সেল গ্রহীতার শরীরে খাপ খাওয়ানোর সময়েও শরীরে বিভিন্ন সংক্রমণ হতে পারে, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে গ্রাফ্ট ভার্সাস হোস্ট ডিজ়িজ় বা জিভিএইচডি। তবে অটোলোগ্যাস প্রতিস্থাপনে রোগী নিজেই দাতা, তাই এ ক্ষেত্রে জিভিএইচডি-র সমস্যা থাকে না। প্রতিস্থাপনের আগে ও পরে মিলিয়ে বেশ অনেক দিন মেডিক্যাল সার্পোট দিয়ে এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রোগীকে হাসপাতালে রাখা হয়। ‘‘হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে এক বছর ভীষণ জরুরি সময়। এই সময়ে রোগীকে বেশ সাবধানে থাকতে হয়। এমন কেউ থাকবেন, যিনি সর্বক্ষণ রোগীর দেখভাল করবেন। ঠিকমতো বিশ্রাম নেওয়া এবং অতিরিক্ত চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার পাশাপাশি এক বছর উপযুক্ত ডায়েট ফলো করতে হবে রোগীকে। জল ফুটিয়ে খেতে হবে, বাইরের খাবার খাওয়া চলবে না। বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সামান্য হাঁচি-কাশি হলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এক বছর নিয়ম মেনে চললে, জীবন ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এমনকি বৈবাহিক জীবনযাপনেও কোনও অসুবিধে হয় না,’’ জানালেন ডা. শর্মিলা চন্দ্র।

প্রতিস্থাপনের জন্য উপযুক্ত বয়স খরচ

ভারতীয় চিকিৎসকেরা সাধারণত চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে বিএমটি করানোর কথা ভাবেন, খুব বেশি হলে পঞ্চাশ বছর। আসলে এই চিকিৎসায় শরীর কো-মর্বিডিটি শূন্য হলেই ভাল। যত বয়স বাড়বে, তত কো-মর্বিডিটি বাড়বে। ফলে প্রতিস্থাপনের সাফল্যের হার কমে যেতে পারে। ‘‘নিজের ভাই কিংবা বোন ডোনর হলে সব মিলিয়ে চিকিৎসার খরচ মোটামুটি দাঁড়ায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ। কিন্তু ডোনরের কাছ থেকে কিনতে হলে খরচটা গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৪০ থেকে ৫০ লাখে! সুতরাং এত টাকা যখন খরচ করা হয়, তখন আমরা চাইব রোগী দীর্ঘজীবী হোন। যদিও আমেরিকায় সত্তর বছর বয়সেও বিএমটি হয়। তাঁর কারণ সে দেশে স্বাস্থ্য বিমা পুরো খরচই বহন করে,’’ বললেন ডা. চন্দ্র।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। তবে মরণাপন্ন মানুষকে এই প্রতিস্থাপন জীবনদান করে, সেটাও ঠিক। তরুণ ও মাঝবয়সিদের সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন উপভোগ করতে সাহায্য করে।

treatment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy