Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Colon Cancer

তারুণ্যে থাবা বসাচ্ছে কোলন ক্যানসার

তরুণদের মধ্যে ক্রমশ কোলন ক্যানসারের হার বাড়ার পিছনে দায়ী কি অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা?

—প্রতীকী চিত্র।

কোয়েনা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৫২
Share: Save:

অল্প বয়স থেকেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগছে বছর তিরিশের রাজা। মাঝেমধ্যেই মলের সঙ্গে হয় রক্তপাত। অর্শ ভেবে এড়িয়েও গিয়েছেন এতকাল। তবে হঠাৎই ওজন কমে গিয়েছে খানিক। কিছু খেলেই গুলিয়ে আসে গা। সঙ্গে মাথা ঘোরা, দুর্বলতাও রয়েছে। চিকিৎসকের আশঙ্কা কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত রাজা।

রাজার মতো শৌচালয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটে অনেকেরই। এ নিয়ে কখনও অন্যের হাসি-ঠাট্টা, অভিযোগ মুখ বুজে শুনতে হয়। তবে মলের সঙ্গে যদি প্রায়ই রক্তপাত হয়, তবে কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা ভেবে অবহেলা না করে সচেতন হওয়ার কথাই বলছেন চিকিৎসকেরা। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান হলিউডের ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করা চ্যাডউইক বোসম্যান। কারণ এই কোলন বা মলাশয়ের ক্যানসার। মধ্যবয়সি বা তার চেয়ে বেশি বয়সিদের মধ্যে এই ক্যানসার সাধারণ ব্যাপার হলেও, চিকিৎসকদের কথায়, সাম্প্রতিক সময়ে এ রোগে আক্রান্ত তরুণ রোগীর সংখ্যা নেহাত কম না। বরং উদ্বেগজনক ভাবে সে সংখ্যার সূচক ঊর্ধ্বমুখী।

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

তরুণদের আক্রান্ত হওয়ার কারণ

প্রাথমিক ভাবে অনেকেরই কোলন বা মলাশয়ের ভিতর উপবৃদ্ধি বা পলিপ দেখা দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পলিপগুলি ক্যানসারে রূপান্তরিত হতে পারে। ফলস্বরূপ মলদ্বারে প্রদাহ, মলত্যাগের সময় তীব্র যন্ত্রণা কিংবা রক্তপাতের মতো সমস্যা দেখা দেয়। ডা. গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, “মধ্যবয়সি বা বয়স্কদের সঙ্গে অল্পবয়সিদের এ ক্ষেত্রে কারণে বিশেষ কিছু তফাত নেই। তবে তরুণদের মধ্যে ক্রমশ কোলন ক্যানসারের হার বাড়ার পিছনে দায়ী তাঁদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা ও কিছু ভুল অভ্যেস।”

  • খাদ্যাভ্যাস: খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম হওয়া হল এর মূল কারণ। নিয়মিত তেলমশলা যুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড তো বটেই সঙ্গে অতিরিক্ত মাংস খাওয়া এবং খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের অভাবও এর কারণ হতে পারে। পাশাপাশি, ঘরে বানানো টাটকা খাবারের পরিবর্তে প্রক্রিয়াজাত খাবারদাবার খাওয়ার চল ইদানীং বেড়েছে। অস্বাস্থ্যকর সে খাবার কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। সঙ্গে নিয়মিত মদ্যপান ও ধূমপানে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
  • ওজন: ডা. গৌতম বলছেন, এখন ব্যস্ত জীবনে শারীরচর্চা করেন না অনেকেই। সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়ায় অল্প বয়সেই বেড়ে যায় ওজন। এই বাড়তি ওজনও অনেকাংশে কোলন ক্যানসারের কারণ।
  • জিনগত: এ রোগ বংশগতও। পরিবারে কারও কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকলে, অল্প বয়স থেকেই সতর্কতা প্রয়োজন। উপসর্গ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
  • অন্যান্য কারণের সঙ্গে অতিরিক্ত মানসিক চাপও কিন্তু অল্প বয়সে কোলন ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
  • অ্যানিমিয়া থাকলেও অল্প বয়সে কোলন ক্যানসার হতে পারে।

আরও কিছু

সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে এক সমীক্ষা। বিজ্ঞানীদের এক অংশ দাবি করছেন জীবনযাত্রা ও জিনগত সমস্যা ছাড়াও, কোলন ক্যানসারের পিছনে রয়েছে এক ধরনের ব্যাক্টিরিয়াও। কিছু রোগীর মুখে এক ধরনের ব্যাক্টিরিয়া পাওয়া যায়। সে ব্যাক্টিরিয়া পরে পাকস্থলী হয়ে মলাশয়ে পৌঁছয় এবং ক্যানসারের কারণ হয়ে ওঠে। কোলন ক্যানসারে ইতিমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এ ব্যাক্টিরিয়া প্রবেশ করলে তার ফল ভয়ানক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগীর সুস্থ হওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

বুঝবেন কী ভাবে?

দিনে কত বার মল ত্যাগের প্রয়োজন অনুভূত হয়, আচমকা তার তারতম্য ঘটা কোলন ক্যানসারের অন্যতম লক্ষণ। পাশাপাশি ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা যদি দীর্ঘ সময় যাবৎ কিছুতেই সারতে না চায়, তবে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এর সঙ্গে যদি হঠাৎ অতিরিক্ত ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, রক্তাল্পতা, হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়, তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। পাশাপাশি কোলন ক্যানসারে রোগীর মলত্যাগের সময় ব্যথা ও যন্ত্রণা অনুভূত হতে পারে। রক্তও পড়ে অনেক সময়েই। প্রাথমিক ভাবে বেশির ভাগ মানুষই তা পাইল্‌স বলে অবহেলা করেন। তাই সতর্ক থাকুন। তা ছাড়া, কোলন ক্যানসারের উপসর্গ হিসেবে পেটে ব্যথাও হয়।

এড়ানোর উপায়

চিকিৎসকদের মতে, অল্প বয়স থেকে সময় মেনে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। মদ্যপান ও ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ, রেড মিট খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি মেনে চললেই এই অসুখ অনেকাংশে এড়িয়ে চলা সম্ভব। রোজকার খাবারে রাখুন টাটকা ফলমূল, শাকসব্জি। ভুষি-সহ আটার রুটি, ওটস ইত্যাদি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত রাখুন খাদ্যতালিকায়। এতে অল্প বয়সে কোলন ক্যানসারের সম্ভাবনা যেমন কমবে, তেমনই এই ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের বাঁচার মেয়াদও বাড়বে।

সতর্কতা

আমাদের দেশে পাইলস অথবা পেট খারাপ বা আমাশয় আক্রান্ত হওয়া বেশ সাধারণ ব্যাপার। ভেজাল, নষ্ট হওয়া খাবারদাবার অথবা রেস্তরাঁয় খেয়ে পেট খারাপ বা মলত্যাগের অভ্যাসের হঠাৎ পরিবর্তন কিছু ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। সে কারণে পায়ুপথে রক্তক্ষরণ, ডায়রিয়া যে ক্যানসারেরও উপসর্গ তা বুঝতে রোগীর অনেক দেরি হয়ে যায়। ফলে ক্যানসার মলাশয় থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। মনে রাখা দরকার, সাধারণ মানুষের পক্ষে কোলন ক্যানসারের লক্ষণ বুঝে ওঠা কঠিন। কাজেই এই ধরনের যে কোনও উপসর্গ দেখা গেলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভাল।

চিকিৎসা

সাধারণত এ ক্ষেত্রে মল পরীক্ষা, কোলনোস্কপি করা হয়ে থাকে। কোলনোস্কপিতে পলিপস ধরা পড়লে বায়প্সি করা হয়। ডা. মুখোপাধ্যায় বলছেন, “রোগীদের মধ্যে বায়প্সি ঘিরে নানা রকম ভয় থাকে। বিশেষত পলিপসের বায়প্সি করার পরামর্শ দিলে অনেকেরই মনে হয় তা আরও ক্যানসারের দিকে এগিয়ে দেবে। তবে এ ধারণা কিন্তু একেবারেই ভ্রান্ত। এ ছাড়া রক্ত পরীক্ষাতেও কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা অনেক সময়ে অপারেশন করে প্রয়োজন অনুযায়ী কোলনের অংশ বা সম্পূর্ণ কোলন বাদ দিয়ে দেন। মলাশয় থেকে ক্যানসার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে তখন কেমোথেরাপি করা হয়।”

ভয়ের কারণ

আপাত ভাবে কোলন ক্যানসার প্রাণঘাতী নয়। তবে অল্প বয়সে এ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে অন্য সমস্যা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসারের চিকিৎসা চলায়, নানা ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে কোলন ক্যানসার থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তাই অল্প বয়স থেকেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বংশে কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে, অল্প বয়স থেকেই জীবনযাত্রার দিকে নজর দিতে হবে। প্রাথমিক উপসর্গ দেখা গেলে ঘরোয়া টোটকার উপরে ভরসা না করে এক জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE