বেশ কিছু গবেষণায়র তথ্য ভুল বলে মত প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। —প্রতীকী ছবি
বিতর্কিত ফরাসি গবেষণা
এই গবেষণার ফলাফল ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টস-এ প্রকাশিত হওয়ার পরই আসল বাড়াবাড়িটা শুরু হয়। কারণ এক দল বিজ্ঞানী দাবি করেন, এইচসিকিউ ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কোভিড রোগীর চিকিৎসা করে তাঁরা দেখেছেন খুব দ্রুত ভাইরাসের পরিমাণ কমছে। তাঁদের সেই দাবি বিশেষজ্ঞদল যাচাইও করে নেন।
তা হলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল, কারণ যে ভাবে গবেষণার কাজ সাজানো হয়েছিল ও যে ভাবে তার ফলাফল ব্যাখ্যা করা হয়, তাতে গলদ ছিল। অনেক কিছু খোলসা করে বলা হয়নি। ওষুধ দেওয়ায় কত জন রোগীর উপসর্গ কমেছে, কত জনের বেড়েছে, কত জন মারা গিয়েছেন, সে সব তথ্য না দিয়ে তাঁরা শুধু শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কতটা কমেছে, সেটা জানিয়েছিলেন। আসল ঘটনা হল এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করার পর ৫ জন রোগীর মধ্যে ৪ জনের অবস্থাই খারাপ হয়ে যায়। ৩ জনকে আইসিইউ-তে পাঠাতে হয়। এক জন মারা যান। আর এক জনের শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমে। তার ভিত্তিতেই তাঁরা বলেন, এইচসিকিউ খেলে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমে ও রোগী সেরে যান।
পরবর্তী কালে তাঁরা আরও যে সব পরীক্ষা করেন, সেখানেও নিয়ম মেনে কাজ হয়নি। ক্লিনিকাল ট্রায়ালের নিয়ম হল দুই দল এমন রোগীকে নিয়ে কাজ করতে হয়, যাঁদের সমস্যা, বয়স ইত্যাদি সব এক। তার মধ্যে একদলকে ওষুধ দিয়ে অন্য দলকে না দিয়ে দেখা হয় উপসর্গ কার ক্ষেত্রে কতটা কমল বা বাড়ল। যে দলকে ওষুধ দেওয়া হয় না তাঁদের বলে কন্টেরাল গ্রুপ। এই গবেষণায় কন্টেরাল গ্রুপ রাখাই হয়নি।
চাইনিজ ক্লিনিকাল ট্রায়াল
এপ্রিলের গোড়ায় ৬২ জন মৃদু কোভিড রোগীকে স্টাডি করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন চিনা বিজ্ঞানীরা। তাতে জানানো হয়, যাঁদের এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে তাঁদের জ্বর-সর্দি-কাশি কমেছে অনেক তাড়াতাড়ি।
সমস্যা হল, এত কম রোগীর উপর পরীক্ষা করে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব নয়। ট্রায়ালে কোনও জটিল রোগী ছিলেন না। কাজেই তাঁদের উপর এই ওষুধের প্রভাব কতটা তা জানা যায়নি। প্রবন্ধ প্রকাশের আগে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তার ভাল-মন্দ যাচাই করা হয়নি। তার উপর গবেষকরা নিজেরাই বলেছেন, সঠিক চিত্র পেতে গেলে আরও বড় করে পরীক্ষা করা দরকার। এইচসিকিউ কী ভাবে মানবদেহে কাজ করে, তা জানতেও আলাদা করে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
ফ্রান্সে পুরোনো তথ্যের বিশ্লেষণ
পুরোনো তথ্যের বিশ্লেষণ অর্থাৎ রেট্রোস্পেকটিভ অ্যানালিসিসের জন্য ফ্রান্সের গবেষকরা দু’দল কোভিড রোগীকে বেছে নেন। যাঁদের মধ্যে ৮৪ জনের চিকিৎসা হয়েছিল এইচসিকিউ দিয়ে। বাকি ৯৭ জনের অন্য ওষুধ দিয়ে। এঁদের চিকিৎসার নথি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানান যে, এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করলেই যে সব সময় ভাল ফল হবে এমন নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে রেট্রোস্পেকটিভ অ্যানালিসিস করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব নয়। যার প্রধান কারণ, কিসের ভিত্তিতে চিকিৎসক কাউকে এইচসিকিউ দিয়েছিলেন আর কাউকে দেননি তা এই এই পরীক্ষা থেকে জানা সম্ভব নয়। একমাত্র রেন্ডমাইজ কন্টেরাল ট্রায়াল করলেই এই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়।
ব্রাজিলীয় গবেষণায় এইচসিকিউ বাতিল
ব্রাজিলের গবেষকদের দাবি, এইচসিকিউ খুব জরুরি ওষুধ। তবে যেহেতু এর বেশ ভাল রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, তাই অ্যারিদমিয়া নামে হৃদরোগে রোগী মারাও যেতে পারেন। তাই খুব প্রয়োজন না হলে এই ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ছাড়া তো একেবারেই নয়।
সমস্যা হল এই গবেষণায় দু’টি বিভিন্ন মাত্রায় এইচসিকিউ দিয়ে রোগীর ভাল-মন্দের বিচার করেছিলেন গবেষকরা। ওষুধ না দিলে কী হয়, তা তাঁরা দেখেননি। তা ছাড়া এই গবেষণাপত্রের বিচার-বিশ্লেষণও করেনি বিশেষজ্ঞ কমিটি।