Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

যন্ত্রণা হলেই পেনকিলার নয়

বরং মাসের ওই বিশেষ দিনগুলি নিয়ে সচেতন হোন। যন্ত্রণার আড়ালে থাবা বসাতে পারে এনডোমেট্রিয়োসিস পেনকিলার খাওয়ানোর আগে প্রশ্ন করুন নিজেকে। তারও আগে সচেতন হোন রোগটি সম্পর্কে।

রূম্পা দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

মাসের ওই বিশেষ ক’টা দিন শরীরটা এমনিতেই ভাল লাগে না হৈমন্তীর। তার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। রীতিমতো কঁকিয়ে ওঠা বেদনায় ক্লান্ত মেয়ে বাড়ি ফেরে স্কুল থেকে। ‘ও সব লক্ষণ তো স্বাভাবিক’— এই ভেবে মেয়েকে গরম দুধ খাইয়ে পড়তে বসান মা। যন্ত্রণা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হলে হয়তো বা একটা পেনকিলার দিয়ে দেন। পিরিয়ড শেষ হলে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যথা কমে। মা-মেয়ে দু’জনেই নিশ্চিন্ত। কিন্তু যে ব্যথাকে নেহাতই মেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোমের স্বাভাবিক লক্ষণ ভেবে এড়িয়ে গেলেন হৈমন্তীর মা, তার পিছনে সত্যিই ভয়ের কারণ বাসা বাঁধছে না তো? সচেতনতার অভাবে এন্ডোমেট্রিয়োসিসের মতো ভয়ঙ্কর রোগ ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসছে না তো মেয়ের শরীরে? পেনকিলার খাওয়ানোর আগে প্রশ্ন করুন নিজেকে। তারও আগে সচেতন হোন রোগটি সম্পর্কে।

এন্ডোমেট্রিয়োসিস কী?

নিয়মিত দিনের ব্যবধানে মাসের বিশেষ সময়ে মেয়েদের ইউটেরাসে জমে থাকা রক্ত বেরিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। ইউটেরাসের ভিতরে এক ধরনের লাইনিং থাকে যা পরিচিত এন্ডোমেট্রিয়াম নামে। ঋতুচক্রের সময়ে সেই লাইনিং খসে পড়ে যায়। তাতে থাকে নানা ইনফ্ল্যামেটরি কোষও। ইউটেরাস থেকে সেই সমস্ত কিছু মিশে বেরিয়ে আসে যোনিপথ দিয়ে। কিন্তু যোনিপথ দিয়ে বেরিয়ে না এসে সেই সব কোষ-রক্ত যদি শরীরের মধ্যেই, বিশেষত ওভারি, ফ্যালোপিয়ান টিউব, পেলভিসের আশপাশে জমা হতে থাকে, তখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি ব্যাহত হয়। সেই বর্জ্যগুলি জমতে জমতে ধীরে ধীরে সিস্ট, চকলেট সিস্টের আকার নেয়। এই অবস্থাটিই চিকিৎসার ভাষায় পরিচিত এন্ডোমেট্রিয়োসিস নামে। এই রোগ হলে পিরিয়ডসের সময়ে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়।

যন্ত্রণাই শেষ কথা নয়

এন্ডোমেট্রিয়োসিসের প্রাথমিক লক্ষণই হল অসহ্য যন্ত্রণা। তলপেট জুড়ে সেই যন্ত্রণা শুধু সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। কনসালট্যান্ট গাইনিকলজিস্ট, ইনফার্টিলিটি স্পেশ্যালিস্ট এবং অ্যাডভান্স ল্যাপ্রোস্কোপিক সার্জন ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘যোনিপথ দিয়ে বেরিয়ে না এসে শরীরের অন্যত্র জমতে থাকা কোষ-রক্ত একটা সময়ের পরে সিস্ট তৈরি করে। ফলে অনেক সময়ে যন্ত্রণার পাশাপাশি মূত্রের সঙ্গেও রক্ত বার হয়। মলত্যাগের সময়ে অসহনীয় যন্ত্রণা হয়। ফলে মল-মূত্র ত্যাগ করার সময়ে ভীতি জন্মায়।’’ এমনকি এন্ডোমেট্রিয়োসিসের সমস্যা বন্ধ্যত্ব ডেকে আনার অন্যতম কারণ।

ধরা পড়ে কী ভাবে?

যাঁদেরই এন্ডোমেট্রিয়োসিস রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের সমস্যা সমান হবে, এমনটা নয়। বরং কারও হয়তো তেমন কোনও লক্ষণ দেখাই দেয় না। তবে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা হয়। অনেক সময়ে আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম কিংবা পিআইডি বা পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ়ের লক্ষণও প্রকট হয়ে ওঠে এই রোগের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি ইন্টারকোর্সের সময়েও অসহ্য যন্ত্রণা হয়। এন্ডোমেট্রিয়োসিস অনেক ক্ষেত্রেই আবার জেনেটিক। মা, দিদি, পরিবারের কারও এই সমস্যা থাকলে আর একজনেরও এন্ডোমেট্রিয়োসিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সে ক্ষেত্রে যখনই বাড়ির মেয়ে সন্তানটি বড় হবে এবং অনিয়মিত ও ব্যথা-সহ ঋতুচক্রের মধ্যে পড়বে, তখন থেকেই বছরে অন্তত একবার করে আলট্রাসোনোগ্রাফি করানো উচিত।

কী ধরনের পরীক্ষা?

পেলভিক আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান করার পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক। এতে চকলেট সিস্ট বা এন্ডোমেট্রিয়োটিক সিস্ট ওভারি না কি ভ্যাজাইনা এবং রেকটামের মাঝে আছে, তা নির্ণয় করা যায়। সিস্ট গুরুতর হলে এমআরআই স্ক্যান করানোও হতে পারে।

চিকিৎসা

এন্ডোমেট্রিয়োসিসের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ। চিকিৎসকেরা রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসা করেন।

• প্রথমেই অসহনীয় যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধের মাধ্যমে যন্ত্রণা কমানো আসলে রোগের লক্ষণকে প্রশমিত করা। এতে রোগমুক্তি ঘটে না। তাই চিকিৎসকেরা হরমোনের চিকিৎসা করে এন্ডোমেট্রিয়োসিসকে মোকাবিলা করেন। সিওসি বা কম্বাইন্ড ওরাল কনট্রাসেপটিভ দেওয়া হতে পারে। এতে ওভিউলেশন কমে। ফলে সাময়িক ভাবে পিরিয়ড বন্ধ হয়। অথবা তা হলেও যন্ত্রণা বা রক্তক্ষরণের পরিমাণ কমে।

• অনেক সময়ে ইনট্রাইউটেরাইন সিস্টেম কিংবা মিরেনা বসিয়ে পিরিয়ড বন্ধ করানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রেও পিরিয়ড যদি বা হয়, তার পরিমাণ কম।

• প্রোজেস্টেরনের ট্যাবলেট দেওয়া যেতে পারে রোগীকে।

• এ ছাড়া অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা তো রয়েছেই। ল্যাপ্রোস্কোপিক সার্জারির মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়োসিস ধ্বংস করা যায়, সরিয়ে ফেলা যায়। তবে রোগীর এন্ডোমেট্রিয়োসিসের সমস্যা বাড়লে ল্যাপ্যারোটোমি সার্জারিও করতে হতে পারে। তার সিদ্ধান্ত অবশ্যই চিকিৎসক নেন।

ফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট

এন্ডোমেট্রিয়োসিস হলে কি মা হওয়া সম্ভব? এ প্রশ্ন অনেকেরই। ডা. চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘একেবারেই তা সম্ভব। যাঁরা সন্তান চাইছেন, অথচ এন্ডোমেট্রিয়োসিসের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের অনেক সময়ে হয়তো হরমোনের চিকিৎসা করা যায় না। সে ক্ষেত্রে সার্জারি করানোই শ্রেয়। এন্ডোমেট্রিয়োসিসের সার্জারি হয়ে গেলে সন্তানধারণ করা তাই সম্ভব। আবার এ-ও দেখা গিয়েছে যে, কনসিভ করার পরে এই রোগের সমস্যা মিটে গিয়েছে। সন্তানের জন্ম হয়ে গেলে আবার অনেকেই যাঁরা এন্ডোমেট্রিয়োসিসে ভুগতেন, তাঁদের যন্ত্রণা কমেছে। ভাল আছেন তাঁরা।’’

ভাল থাকার উপায়

পরিবারে এন্ডোমেট্রিয়োসিস থাকলে আগেভাগে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। পিরিয়ডে যন্ত্রণা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, ক্লট ডিসবার্স ইত্যাদি হতেই থাকলে আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান, আলট্রাসোনোগ্রাফি করানো জরুরি। প্রয়োজনে প্রত্যেক বছর একবার করে পরীক্ষা করা দরকার।

• চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাদ্যতালিকা থেকে দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং গম থেকে তৈরি নানা খাবার বাদ দিতে হতে পারে।

• নিয়মিত শারীরচর্চা করাও অত্যন্ত জরুরি।

• এন্ডোমেট্রিয়োসিসের সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই যন্ত্রণার সঙ্গে লড়তে লড়তে রোগী মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। সে ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন।

• চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধপত্র খেয়ে চললে এন্ডোমেট্রিয়োসিসকে মোকাবিলা করা সম্ভব।

এন্ডোমেট্রিয়োসিস হলে তার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেক রোগী হিস্টেরেকটোমির কথা ভাবেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ইউটেরাস বাদ দিয়ে দেওয়াই সমাধান নয়। রোগ ধরা পড়লেও ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় তার মোকাবিলা করুন। রোগ সম্পর্কে সচেতন হোন। অবিলম্বে পরামর্শ নিন চিকিৎসকের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Endometriosis Pain Killer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE