Advertisement
E-Paper

শরতের এই-মেঘ এই-বৃষ্টির মতো প্যান্ডেলের পারিজাতকে ভাল লাগার শুরু

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৮ ১৩:২৪

আজ থেকে বছর তিরিশেক আগেও পুজোর সময় মায়ায় ভরা এই পৃথিবীতে যেমন শরতমেঘ আসত, কাশফুল আসত, ঝলমলে আকাশ আসত, ঠিক সে ভাবেই আসত পুজোর-প্রেম। এই প্রেমের বয়স ছিল অল্প। মন ছিল তরতাজা। দু’চোখে যা দেখত, তা-ই তার ভাল লেগে যেত। মা দুগ্‌গার ছানাপোনাদের মতো এই প্রেমগুলিও এই সময় মামার বাড়ি বা মাসির বাড়িতে পুজোর ছুটি কাটাতে আসত। এসে, মামারবাড়ির লাগোয়া পুজো প্যান্ডেলের কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারে এসে বসত।

তাদের কেউ হয়তো ফ্রক ছেড়ে সবে চুড়িদার। দুগ্‌গা অষ্টমীর দিনে কেউ আবার আর এক ধাপ প্রোমোশন পেয়ে মেজমামার দেওয়া নতুন শাড়ি। বহু দূর থেকে তাদের মনে হত বুঝি রূপকথার পরী। আমরা তখন হাফপ্যান্ট পেরিয়ে সবে ফুলপ্যান্ট। হাফশার্টের জায়গায় ভি-কলার টি-শার্ট। পুজোয় পাওয়া কালো শু-এর ভেতরে ঢিপলু-ফোস্কা নিয়ে হাল্কা ন্যাংচাচ্ছি। কাছে গিয়ে পাশের চেয়ারটিতে বসব বা আলগা করে দুটো কথা বলব, এমন সাহসে কুলোচ্ছে না।

তখনকার মেয়েরা বোধহয় এখনকার মেয়েদের থেকে একটু বেশিই লাজুক হত। ওদের চুল হত অনেকখানি লম্বা। কেমন যেন একটা স্নিগ্ধ ছায়াভরা পুকুর লুকিয়ে থাকত তাদের বড়-বড় চোখে। তাতে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউও যে থাকত না, তা আমি বলছি না। কিন্তু তার সংখ্যা ছিল বড়ই কম। কোনও এক অজানা কারণে উত্তাল সমুদ্রের বদলে টলটলে পুকুরই আমাদের বেশি পছন্দের ছিল। যদি কেউ এদের কারও সঙ্গে একটু ভাব জমিয়ে ফেলতে পারত, তবে বন্ধুদের কাছে সে হিরো হয়ে যেত। হয়ে উঠত ওই মেয়েটির জীবন্ত বায়োডেটা। আমরা যদি জিগ্যেস করতাম, ‘কোন ক্লাসে পড়ে রে?’ উত্তর আসত, ‘এ বার টেন-এ উঠল।’ আমরা গোয়েন্দার মতো ঘাড় নেড়ে, ‘হুমম। তা কোন স্কুল?’ ‘হোলি চাইল্ড।’

আরও পড়ুন: ভোরের শিউলি, রাতের ছাতিম নিয়ে পুজো আসছে​

আরও পড়ুন: প্যান্ডেল হপিংয়ের মাঝে ঝেঁপে বৃষ্টি, কী করবেন, কী করবেন না​

আমরা চোখ কপালে তুলে, ‘সে কী রে, ইংলিশ মিডিয়াম! সামলাবি কী করে!’ বিজ্ঞের হাসি হেসে, ‘অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে।’ আমরা কান চুলকে, ‘তা কী নাম রে মেয়েটার ?’ ‘বিষ্ণুপ্রিয়া।’ আমরা খুক করে হেসে, ‘সেকেলে নাম। বউ হলে কী বলে ডাকবি, বিষ্ণু?’ ও ঘাড় নেড়ে, ‘উঁহু। প্রিয়া। শুধু প্রিয়া!’ বলেই আমাদের অবাক করে দিয়ে হয়তো ফিচিক করে হাসত। ব্যস, তার পর থেকে যত বার মেয়েটাকে আমরা প্যান্ডেলে দেখতাম আমাদের কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে চলত, প্রিয়া...প্রিয়া...প্রিয়া...।

আমাদের সময়ে দক্ষিণ কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় জেগে ওঠা বনেদি পুজোমণ্ডপগুলো ছাড়াও হরিশ পার্ক, নর্দান পার্ক বা ম্যাডক্স স্কোয়ারের মতো মাঠে পাতা চেয়ারে চেয়ারে, সন্ধের মুখ থেকেই আড্ডার একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে যেত। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে সবাই সেজেগুজে চলে আসত সেখানে। মাঠের ভেতরে, ধার-ঘেঁষে বসা ফুচকা, ঝালমুড়ি, কোল্ডড্রিংক্স বা আইসক্রিম খেতে কোনও অসুবিধে ছিল না।

ওই সব স্টলেই কোনও কোনও কিশোর হঠাৎই তার নবীনা প্রেমিকার হাতে ভালবাসার উপহার তুলে দেওয়ারও সুযোগ পেয়ে যেত। গুঁজে দিতে পারত গোপন চিরকুট। উল্টোটাও হয়তো হত— আমরা সে ভাবে জানতে পারতাম না। কিন্তু এই যে পুজোর প্রেম, তা টিকে গেছে, স্থায়ী হয়েছে, এমন উদাহরণ একটি মাত্র ছাড়া আমি বড় একটা দেখিনি। আর টিকে যাওয়ার কারণ প্রতি বছর পুজোয় মেয়েটি তার ভবানীপুরের মামারবাড়িতে আসত, এক বারও মিস করত না। সাধারণত পুজোর প্যান্ডেলে আলাপ হওয়া সেই সব অপরূপ কিশোরী এক বার বাড়ি ফিরে গেলে, তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যেত না! পরের বছর পুজোর আগে সে হয়তো বার দু’য়েক এ-পাড়ায় আসবে, কিন্তু তখন তাকে নজর করবে কে! তার ফোন নম্বর জানা থাকলেও কোনও লাভ নেই। কারণ ফোন মানে তখন মোবাইল নয়, ল্যান্ড ফোন। আর সেই এবোনাইটের তৈরি কালো যন্ত্রটা রাখা থাকত বাবা-জ্যাঠাদের ঘরের কাজের টেবিলে।

আমরা এমনও দেখেছি, সপ্তমী-অষ্টমী কাটিয়ে একটি মেয়ে যেই নিজের বাড়িতে ফিরে গেল, কিংবা মামা-মাসিদের সঙ্গে বেড়াতে চলে গেল দার্জিলিং অথবা পুরীতে, অমনি তার প্রেমে দূর থেকে হাবুডুবু দিচ্ছিল আমাদের যে বন্ধু, তার প্যান্ডেলে বসা অন্য এক ফুটফুটে পারিজাতকে অন্য রকম ভাবে ভাল লাগতে শুরু করল। শরতের এই-মেঘ এই-বৃষ্টির মতো এই যে ভালবাসার দ্রুত রংবদল, ভিজে নেতিয়ে-পড়া প্রেমটুকুকে নীল আকাশের রোদ্দুরে কাশফুলের মতো আবার দুলিয়ে দেওয়া, এর একটা অদ্ভুত মজা ছিল, আনন্দ ছিল। এখনকার ছেলেমেয়েদের সহজ মেলামেশার জীবনে সেই রহস্যের ছিটেফোঁটা রেশ থাকলে বোধহয় খুব মন্দ হত না।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

Durga Puja Celebration 2018 Durga Puja Special Durga Puja Nostalgia Kolkata Durga Puja Durga Puja Preparations
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy