Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিশুমনে দিশাহীনতাই কি জন্ম দিচ্ছে অসহিষ্ণুতার

অল্পবয়সিদের মধ্যে দিশাহীনতা এবং মানবিক বোধের অভাবকে এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন মহামায়াপুর আদর্শ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ্ত মণ্ডল এবং বিদ্যা ভারতী গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা সম্পূর্ণা ভট্টাচার্য।

আলোচনাচক্রে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। নিজস্ব চিত্র

আলোচনাচক্রে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। নিজস্ব চিত্র

স্বাতী মল্লিক
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৫:০০
Share: Save:

কখনও দমদম স্টেশনে যুগলকে সকলে মিলে মারধর। কখনও হাওড়ার অলিগলি বা লেক টাউনের বড় রাস্তায় মানসিক ভাবে অসুস্থকে হাত-পা বেঁধে গণপিটুনি। আবার কখনও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে ১৬টি কুকুরছানাকে পিটিয়ে হত্যা। গত কয়েক মাসে কলকাতার বুকে পরপর এমন ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, কেন এতটা অমানবিক হয়ে পড়ছি আমরা? তবে কি দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছি সামাজিক মূল্যবোধ? আরও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি? আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত এক আলোচনাচক্রে এই প্রশ্নই রাখা হয়েছিল শহর ও শহরতলির কয়েক জন শিক্ষক-শিক্ষিকার সামনে।

অল্পবয়সিদের মধ্যে দিশাহীনতা এবং মানবিক বোধের অভাবকে এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন মহামায়াপুর আদর্শ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ্ত মণ্ডল এবং বিদ্যা ভারতী গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা সম্পূর্ণা ভট্টাচার্য। সম্পূর্ণা বলছেন, ‘‘কমবয়সিরা আজ বড় বিক্ষুব্ধ, সব সময়েই আক্রমণাত্মক। তবে দোষটা ওদের নয়, আমাদের। বাবা-মা বা সমাজ, কেউই ওদের কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।’’ স্টুডেন্টস অ্যাকাডেমির শিক্ষিকা শুভ্রা দাস আবার বলছেন, ‘ভাল থাকা’র সংজ্ঞা বদলে যাওয়ার কথা। যার ফলে ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে নবীন প্রজন্ম। তাঁর কথায়, ‘‘ভোগবাদ বেড়েছে। তাই সকলকে নিয়ে একসঙ্গে ভাল থাকার বদলে আজ ওরা বোঝে যে, শুধু আমিই ভাল থাকব।’’ তবে নিমতা হাইস্কুল (বয়েজ)-এর প্রধান শিক্ষক নারায়ণচন্দ্র কামিলার মতে, দুর্বলের উপরে সবলের এই আস্ফালন যাঁরা দেখাচ্ছেন, অবক্ষয় শুধু তাঁদের মধ্যে নয়, ছড়িয়ে গিয়েছে আর পাঁচটা মানুষের মধ্যেও। আইন ও পুলিশের উপরে অনাস্থা এবং সচেতনতার অভাবের কারণেই মানুষ এ ভাবে হাতের সুখ করে নিচ্ছেন— এমনটাই মত বড়িশা জনকল্যাণ বিদ্যাপীঠ ফর গার্লসের সহ-প্রধান শিক্ষিকা সুচন্দ্রা দত্ত এবং আইআইএমসি শিক্ষাঙ্গন হোগলকুড়িয়া স্কুলে শিক্ষক কিঙ্কর মণ্ডলের।

কিন্তু পড়ুয়া-মনে কেন তৈরি হচ্ছে না সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা? এ জন্য বাড়ির বড়দের দিকেই আঙুল তুলছেন উষুমপুর আদর্শ বিদ্যালয় (বয়েজ)-এর প্রধান শিক্ষক সৌমিক ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, ‘‘স্কুলে স্বচ্ছ অভিযান করতে গেলে বাধা দিচ্ছেন অভিভাবকেরা। তাঁদের দাবি, এতে না কি সংক্রমণ ছড়াবে! সেটাই শিখল পড়ুয়ারা।’’ তাই তো ২৫ টাকা দিয়ে আইসক্রিম খাওয়ার সামর্থ থাকলেও স্কুলের দুঃস্থ ফান্ডে মাসে ৫ টাকা করে দেওয়ার ‘মন’টুকু তৈরি হচ্ছে না তাদের।

গ্রাম্য একান্নবর্তী পরিবারের বদলে শহুরে ফ্ল্যাটবন্দি অণু পরিবার নবীনদের এই মূল্যবোধের শিক্ষা চারিয়ে দিতে পারছে না বলে অভিমত আইআইএমসি শিক্ষাঙ্গন হোগলকুড়িয়ার উমরেশ মিশ্রের। বুড়ুল হাইস্কুলের শিক্ষক জয়দেব মুখোপাধ্যায় আবার বলছেন স্কুলে নীতিকথা শিক্ষার পাঠ্যক্রমের প্রয়োজনীয়তার কথা। উল্টো দিকে, এ বিষয়ে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে আর্যপাড়া হাইস্কুলের সহ-প্রধান শিক্ষক অমিত কয়ালের উপলব্ধি, ‘‘শিক্ষা আর মূল্যবোধ যে হাত ধরাধরি করে চলবেই, এমনটা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই বিপদের সময়ে এগিয়ে আসতে দেখেছি তথাকথিত অশিক্ষিত যুবকদের। আর পাঁচ জন শিক্ষিত মানুষের তুলনায় তাঁরাই যেন মানুষের প্রয়োজনের সময়ে বেশি তৎপর।’’

তবে সমাজের ভাল দিকটা যে পুরোপুরি অবলুপ্তির পথে, এ কথা মানতে নারাজ স্টুডেন্টস অ্যাকাডেমির মিলন গিরি বা বড়িশা জনকল্যাণ বিদ্যাপীঠের স্বাতী চক্রবর্তী। তাঁদের কথায়, ‘‘এনআরএস-কাণ্ড দিয়ে আমার শহরকে বিচার করব না। এই শহরেই বাপি সেনের মতো মানুষ ছিলেন, যিনি নারীর সম্মানরক্ষায় প্রাণ দিতে পারেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Youth Dysfunction Inhuman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE