E-Paper

সুবর্ণজয়ন্তীতে ফ্যাশন সম্রাট

স্বল্পবাদী, কিন্তু রাজকীয় জীবনযাপনের ছবি এঁকে গিয়েছেন জর্জিয়ো আরমানি, তাঁর সৃষ্টিতে। সেই সাম্রাজ্যের সুবর্ণজয়ন্তীও যেন তাঁর ডিজ়াইন করা

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৩
জর্জিয়ো আরমানি।

জর্জিয়ো আরমানি। নিজস্ব চিত্র।

ওয়ার্ড্রোব থেকে পরপর ব্লেজ়ার বেছে নিচ্ছেন রিচার্ড গেয়ার। মানানসই শার্ট আর টাই বাছার পালা এ বার। ড্রয়ার খুলতেই বেরিয়ে এল নীলরঙা শার্ট, কলারের কাছে লেবেলে জর্জিয়ো আরমানি। দৃশ্যটা ‘আমেরিকান জিগোলো’ ছবির। কেতাদুরস্ত ফ্যাশন ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির এই মেলবন্ধনের নামই আরমানি। ছেলেদের জন্য আরামদায়ক মেনসওয়্যার, মহিলাদের পাওয়ারসুট, অ্যাকসেসরিজ়, ব্যাগ, স্পোর্টসওয়্যার... একটা গোটা লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড তৈরির পিছনে এই একটাই নাম। আর শুধুই কি ফ্যাশন, ধোপদুরস্ত জীবনযাপনের খোঁজও তিনিই দিয়ে গিয়েছেন পরবর্তী কালে হোটেল ও লাইফস্টাইল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত হয়ে।

কিন্তু আরমানির পথচলার শুরুতেই লেগে রয়েছে যুদ্ধের ধূসরতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁর ছোটবেলার মধ্যবিত্ত জীবনে আঘাত হানে। কঠিন জীবনে শৈশবের খেলনা হিসেবে হাতে ওঠে যুদ্ধের আর্টিলারি শেল। তা ফেটে যাওয়ায় এক বন্ধুকে হারান, নিজেও পুড়ে যান। এক সাক্ষাৎকারে আরমানি নিজেই বলেছেন, “যুদ্ধই শিখিয়েছিল, জীবনে সব কিছু গ্ল্যামারাস নয়।” সেই জন্যই হয়তো আরমানির প্রত্যেক পোশাকেই ধূসর, সাদা-কালোর ছোঁয়াচ বেশি চোখে পড়ে। একটা সময়ে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সেখানেও বেশি দিন থিতু হননি। বছর দুয়েক পরে মিলানের একটি স্টোরে উইন্ডো ড্রেসার হিসেবে কাজ শুরু। খরিদ্দারদের পছন্দমতো ফ্যাব্রিক কেনা, তা থেকে পোশাক তৈরি... সব সেখানেই শেখা।

এর পরে হতে কুতুর ডিজ়াইনার নিনো চেরুট্টির সঙ্গে জুড়ে গেলেন। সেখানে মেনসওয়্যার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হল তাঁর। সে সময়ে পুরুষদের পোশাক বলতে আঁটসাঁট কোট, প্যান্টস, টাই। সেখানেই আঘাত হানলেন আরমানি। প্রিসাইজ় কাট, নিট লুকে, আরামদায়ক ভাবে তৈরি করতে লাগলেন মেনসওয়্যার। ঢিলে প্যান্টস, সঙ্গে যে কোট দমবন্ধ করে চেপে বসে থাকত বুকের উপরে, তার বাটন খুলে দিলেন। ফ্যাশনজগতে যেন একটা দরজা খুলে গেল। ‘আমেরিকান জিগোলো’য় রিচার্ড গেয়ারের পোশাকের স্টাইলে চোখ রাখলেই সেই মুক্তমনের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৭৫-এ নিজের প্রথম মেনসওয়্যার লঞ্চ করলেন আরমানি আর তার সঙ্গেই তৈরি হল ছেলেদের পোশাকের নতুন সংজ্ঞা।

এর পর হাত দিলেন উইমেনসওয়্যারে। সে সময়ে কর্মক্ষেত্রে ঢুকছেন মহিলারা। পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অফিসে কাজ করছেন। আরমানি বুঝলেন, এটাই সময় মহিলাদের পোশাকে পরিবর্তন আনার। তাঁদের এমন পোশাক দরকার, যা তাঁদের ফেমিনিটি বজায় রাখবে আবার পুরুষদের সমান শক্তিশালী স্টেটমেন্টও তৈরি করবে। মহিলাদের জন্য তৈরি করলেন পাওয়ারসুট, আজও তা সমান প্রাসঙ্গিক। মেনসওয়্যারে কোমলতা আনলেন আর উইমেনসওয়্যারে পুরুষালি কাট ব্যবহার করলেন। পোশাকশিল্পের এই বিপ্লব সমাজে নারী ক্ষমতায়নেও সহায়ক হল।

পোশাকশিল্পও যে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে, তা প্রমাণ করলেন ফ্যাশনসম্রাট। তবে একবার নয়, বারবার তিনি আঘাত হেনেছেন প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণায়। সে সময়ে ফ্যাশন হাউসগুলোয় মডেল বাছা হত বডি মাস ইনডেক্স দেখে। প্রায় উপোসী থেকে অ্যানোরেক্সিয়ায় মৃত্যু ঘটে মডেল অ্যানা ক্যারোলিনা রেস্টনের। তখন আরমানিই বিএমআই দেখে মডেল নির্বাচন করা বন্ধ করলেন। এখনকার প্লাস সাইজ় মডেলের যুগের পথ তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন তখনই হয়ে গিয়েছিল।

একে একে এল আরমানি জিনস, আরমানি জুনিয়র, সুগন্ধি, সানগ্লাস, জুতো... একটা গোটা লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডই তৈরি হয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে এসে জুড়লেন সার্জিয়ো গ্যালিয়োটি, আরমানির দীর্ঘ দিনের পার্টনার। আরমানি ব্র্যান্ড তৈরিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সার্জিয়োর দামি গাড়ি বিক্রি করেই তৈরি হয়েছিল তাঁদের প্রথম স্টোর। ক্রমশ ফ্যাশনজগতে পরিচিত নাম হয়ে উঠলেন আরমানি। কিন্তু সার্জিয়ো মারা গেলেন। তার প্রায় বছর ১৫ পরে কেরিয়ারের মধ্যগগনে তখন আরমানি, এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে ‘নিজের পার্টনারের মৃত্যু আটকাতে না পারা’কে চিহ্নিত করলেন, এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন তিনি। তবে শুধু ফ্যাশনজগৎ নয়, হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতেও স্বাক্ষর রেখে যান আরমানি। আবার চেলসি ও ইংল্যান্ড ফুটবল স্কোয়াডের জন্যও সুট ডিজ়াইন করেছেন। ২০১২-র ইটালির অলিম্পিক দলের ইউনিফর্মও তাঁরই অবদান। মানুষ ভালবেসে তাঁর নাম দিল, ‘কিং আরমানি’। রাজকীয় জীবনযাপনের স্বপ্ন যে তাঁর হাতেই সাজানো।

এই সেপ্টেম্বরেই আরমানি ব্র্যান্ডের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই প্রয়াত হলেন জর্জিয়ো আরমানি। তাঁর ইচ্ছে অনুসারে শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাঁর পারিবারিক কবরস্থানের কাছে। ইটালির ছোট্ট গ্রাম রিভাল্টায় স্যান মার্টিনো চার্চে। ৩০০টি আলোকবর্তিকার মাঝে শায়িত ছিল আরমানির দেহ। এ-ও যেন এক অর্থে আরমানিরই ডিজ়াইন করা সুবর্ণজয়ন্তী। নিভৃতে শেষ হল একটা অধ্যায়, রয়ে গেল তাঁর সাজানো সাম্রাজ্য ‘ব্র্যান্ড আরমানি’।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Giorgio Armani

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy