Advertisement
E-Paper

কখনও আওয়াজ, কখনও বা ছায়ারূপ! কী বলতে চায় প্রেতলোক, জানালেন কলকাতার ভূত-সন্ধানীরা

বঙ্গেও ‘ভূত খুঁজিয়ে’রা রয়েছেন। এঁদের ‘গোস্ট হান্টার’ বললে বিষয়টাকে খানিক লঘু করে দেখা হবে। এঁরা নিজেদের ‘প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর’ হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৫৯
কিসের খোঁজ করেন কলকাতার প্রেতসন্ধানীরা?

কিসের খোঁজ করেন কলকাতার প্রেতসন্ধানীরা? ছবি: এআই প্রণীত

বছরে এই একটি দিন তেনাদের। মানে, যেনাদের নাম-টাম সন্ধের পরে করতে নেই আর কি! তবে এই একটি দিন তেনাদের সঙ্গে ইহলোকের বাসিন্দাদের মাঝখানের পর্দাখানি একটু সরে যায় বলেই বিশ্বাস বঙ্গজনের। হেমন্তের আগমনে গাছের পাতাদের হিলিবিলি আর শেষরাতের শিরশিরে ভাবের সঙ্গে মিশে যায় গা-ছমছম। জমাটি একখান হরর অমনিবাস খুলে বঙ্কিম চাটুজ্জে থেকে অনীশ দেব বা হাল আমলের সৈকত মুখুজ্জে পর্যন্ত গপ্পের ভাঁড়ার খুলে এমন দিনে একটু স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে। তবে সে সব নেহাতই সাদা পাতায় কালো অক্ষরের কারিকুরি। ঝপ করে যদি কেউ জিগ্যেস করে বসেন— “ভূত দেখেছেন?” তখন আমতা আমতা করে “ওই আমার দিদিশাশুড়ির মামাতো ভাইয়ের এক বার এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল…” গোছের জবাব দিয়ে পাশ কাটানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। তেনাগণ এমনই আজব বস্তু, যাদের ‘স্ব’-চক্ষে দেখা যায় না। দেখা গেলেও পরে তা চোখের ভুল বা মতিভ্রম হসেবে বিবেচিত হয়। আর যদি কড়া অবিশ্বাসীর পাল্লায় পড়েন তো তিনি আপনাকে নাকানি-চোবানি খাইয়ে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়বেন তেনাদের কোনও অস্তিত্ব নেই বলে। সেই সব দোটানায় না পড়ে বাড়ি বসে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বা স্টিফেন কিং সাহেবের লেখায় মন দেওয়া অনেক বেশি আরামের বলেই মনে হয়। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা সাদা কাগজে কালো আখরের বাইরে গিয়ে খোঁজ করেন তেনাদের। ইংরেজিতে যাঁদের বলে ‘গোস্ট হান্টার’। নিছক শখ নয়, অনেকে পেশা হিসেবেও নিয়ে বসেন গোস্ট হান্টিং বা সাদা বাংলায় ভূত খোঁজাকে।

গোস্ট হান্টারদের তত্ত্বতালাশ নিতে বসলে প্রথমেই মনে আসবে পশ্চিমী দুনিয়ার কথা। মধ্যযুগ থেকে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকার পাথুরে দুর্গ অথবা গথিক রীতিতে বানানো আলো-আঁধারির টানা বারান্দায় ছায়াময়দের আনাগোনার সম্ভাবনা যেন বাংলার এই মাঠ-পুকুর-জলা-ডোবায় ভরা চৌহদ্দির চাইতে খানিক বেশিই। কিন্তু এই বঙ্গেও যে ‘ভূত খুঁজিয়ে’রা রয়েছেন এবং বেশ জবরদস্ত ভাবেই তেনাদের খুঁজে চলেছেন, সে খবর খুব বেশি মানুষ রাখেন বলে মনে হয় না। এঁদের ‘গোস্ট হান্টার’ বললে বিষয়টাকে খানিক লঘু করে দেখা হবে। এঁরা নিজেদের ‘প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর’ হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। ‘প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেশন’ বিষয়টির সঙ্গে আবার বিংশ শতকের প্রথমার্ধের ইউরোপ ও আমেরিকার যোগটাই প্রবল। কিন্তু লক্ষ করার বিষয় এটাই যে, ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে বিংশ শতকের গোড়ায় এই বাংলাতেও প্যারানর্মাল বিষয়াদি চর্চার বিশেষ ঢল নেমেছিল। বাবু প্যারিচাঁদ মিত্র থেকে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্ব জড়িয়ে পড়েছিলেন ‘সিরিয়াস’ প্যারানর্মাল তত্ত্বতালাশে। বাংলার ‘আলোকপ্রাপ্ত’ শহুরে সমাজে প্ল্যানচেট বা সিয়াঁস বেশ শৌখিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনেকের কাছে অবশ্যই বিষয়টা নেহাত ‘শখ’ ছিল না। প্রয়াত প্রিয়জনের সঙ্গে সংযোগ তৈরির উদ্দেশ্যেও অনেকে সেই সব প্রেতচক্রের আসরে ভিড়ে যেতেন। পরলোকতত্ত্ব নিয়ে গুরুগম্ভীর বইপত্রও লেখা হত। এমনকি, বিভূতিভূষণ থেকে প্রমথনাথ বিশী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র থেকে শরদিন্দু পর্যন্ত তাঁদের গল্পগ্রন্থে আর পাঁচটা সামাজিক গল্পের পাশেই ঠাঁই দিতেন অতিপ্রাকৃত সংক্রান্ত গল্পকে। ফলে ভূতচর্চা বিষয়টি যে খনিক ‘হঠ্‌কে’ ব্যাপার ছিল, তা বলা যায় না।

তবে উপরোক্ত গুণীজনের মধ্যে কেউই সে অর্থে ‘প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর’ বা ‘ভূত খুঁজিয়ে’ ছিলেন না। তাঁরা হয়তো প্যারানর্মাল বা স্পিরিচুয়াল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু ভূতের খোঁজে ঘর থেকে বাইরে পা রেখেছিলেন বলে মনে হয় না। কিন্তু পশ্চিমে ছবিটা অন্য রকম ছিল। ১৮৬২ সালেই লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য গোস্ট ক্লাব’-এর মতো অতিপ্রাকৃত বিষয়ে অনুসন্ধানকারী সমিতি। সেই সময়কার বিলেতের বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট হ্যারি প্রাইস তার সদস্য ছিলেন। আবার আমেরিকার ওয়ারেন দম্পতি এড ও লোরেনের কর্মকাণ্ড সমসময়েই বিপুল প্রচার পায়। বিশেষ করে শেষোক্তদের নিয়ে আজও হলিউড দেদার ফিলিম বানিয়ে বেশ দু’পয়সা কামিয়ে চলেছে। কিন্তু বাংলায় প্যারানর্ম্যাল সোসাইটি বলে যদি কিছু থেকেও থাকে, তাদের কাজ ছিল প্রেততত্ত্বের উপরে সারগর্ভ আলোচনা ও গ্রন্থপ্রকাশ অথবা বড়জোর প্ল্যানচেটের আসর বসানো। যন্ত্রপাতি হাতে নিয়ে রাত-বিরেতে ‘ভূতের ডেরা’য় তাঁরা হানা দিয়েছেন বলে সবিশেষ জানা যায় না।

মানব অস্তিত্বের বাইরে ছায়াময়দের জগৎটি ঠিক কেমন, জানতে চান অনেকেই।

মানব অস্তিত্বের বাইরে ছায়াময়দের জগৎটি ঠিক কেমন, জানতে চান অনেকেই। ছবি:সংগৃহীত

২০০৯ সালে গৌরব তিওয়ারি ‘ইন্ডিয়ান প্যারানর্মাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থার দাবি, এটিই ভারতের প্রথম অতিপ্রাকৃত বিষয়ক অনুন্ধান সমিতি। তবে গৌরবের সমিতি কেবলমাত্র ভৌতিক ঘটনা নিয়েই আগ্রহী ছিল না। ইউএফও বা ভিন্‌গ্রহীদের পৃথিবীতে আনাগোনা বিষয়েও তারা কাজ করে। গৌরবের অকালমৃত্যু ঘটে ২০১৬-য়। কিন্তু সোসাইটির কাজকর্ম আজও বজায় রয়েছে বলেই জানাচ্ছে তাঁদের ওয়েবসাইট। বাংলার দিকে যদি তাকানো যায়, তবে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে অভিজিৎ সরকার ‘ইন্ডিয়ান স্পেক্টার প্যারানর্মাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের কার্যালয় প্রথমে ছিল বারুইপুরে। পরে তা উত্তর চব্বিশ পরগনার হাবড়ার কাছে অশোকনগরে চলে আসে।

অভিজিৎদের সংস্থার বর্তমান সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ছয়। নেহাত শখ করে ভৌতিক অভিযানে তাঁরা যান না। কোনও বাড়িতে বা কোনও জায়গায় সাধারণ যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যার অতীত কোনও কর্মকাণ্ড যদি কেউ রিপোর্ট করেন এবং সেই সব ‘অঘটন’ থেকে নিস্তার পেতে চান, তবেই তাঁরা সেখানে যান বলে জানালেন অভিজিৎ। নিছক মুখের কথায় তাঁরা তাঁদের ‘তদন্ত’ শুরু করেন না বলেও জানালেন তিনি। বাড়ি বা সংশ্লিষ্ট স্থানের মালিকের তরফে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হলে তবেই তাঁরা কাজ শুরু করেন। যে জায়গাটিতে তথাকথিত অপ্রাকৃত ঘটনা ঘটছে বলে তাঁদের কাছে খবর আসে, সেখানে তাঁরা রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টে পর্যন্ত কাজ করেন। চার দিনের মধ্যেই প্রাথমিক তদন্তের কাজ গোছানো সম্ভব হয় বলে জানালেন অভিজিৎ।

প্রশ্ন এখানেই যে, সেই ‘কাজ’টি ঠিক কী? অভিজিৎ জানালেন, কারও রহস্যজনক মৃত্যু থেকে কোথাও ব্যাখ্যাতীত গোলমাল, উদ্ভট শব্দের দাপাদাপি ইত্যাদি নিয়েই তাঁদের কাছে তদন্তের বরাত আসে। পুলিশি তদন্ত চলছে, এমন মৃত্যুর ক্ষেত্রে তাঁরা কাজ করেন না। পুলিশি তদন্তের পরে যদি মৃত ব্যক্তির কোনও পরিজন সেই মৃত্যু বিষয়ে সন্দিহান থাকেন এবং তার পিছনে অতিপ্রাকৃত কিছু রয়েছে বলে সন্দেহ করেন, তা হলেই অভিজিৎ ও তাঁদের সংস্থা কাজ শুরু করেন। অনেকে নতুন সম্পত্তি কিনে সেখানে কোনও আধিভৌতিক সমস্যা রয়েছে কি না, সে বিষয়েও তাঁদের সংস্থাকে তদন্তভার দেন। সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন বলে জানালেন অভিজিৎ। নৈহাটি অঞ্চলে এক জন একটি বাড়ি কেনেন। কেনার পর থেকে বাড়িতে রাতবিরেতে ভয়ঙ্কর সব আওয়াজ হতে শুরু করে। শুধু সেই বাড়ির বাসিন্দারা নন, আশপাশের বাড়ির লোকজনও নাকি সাক্ষ্য দিয়েছেন এই দাপাদাপির ব্যাপারে। সেই বিষয়েই এখন তদন্ত করছেন তাঁরা। এমন অনেক ‘কেস’ই আসে, যেখানে তদন্তের শেষে দেখা যায়, ‘ভৌতিক’ কর্মকাণ্ডের পিছনে মানুষেরই হাত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা নিয়োগকর্তাকে আইনের আশ্রয় নিতে বলেন। কিন্তু যদি তা না হয়? তখন শুরু হয় তাঁদের কাজ।

প্রিয়জনের অপমৃত্যুর কারণ জানতে আগ্রহী অনেকেই।

প্রিয়জনের অপমৃত্যুর কারণ জানতে আগ্রহী অনেকেই। ছবি:সংগৃহীত

প্যারানর্মাল তদন্তে বেশ কিছু যন্ত্রের সাহায্য তাঁরা নেন বলে জানালেন অভিজিৎ। যার মধ্যে ইএমএম বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ডিটেক্টর, শ্যাডো ডিটেক্টর, ইলেক্ট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা রেকর্ডার অন্যতম। প্রথম যন্ত্রের আলো দপদপ করতে শুরু করলে তাঁরা বোঝেন, সেই জায়গায় অতিপ্রাকৃত কোনও সত্তা অবস্থান করছে। এই যন্ত্র দু’ফুট ব্যাসের মধ্যে কাজ করে। অনুসন্ধানকারীরা তিন ফুট দূরত্বে থাকেন এবং প্রশ্ন করেন সেই সত্তা বা বলা ভাল, প্রেতের চরিত্র সম্পর্কে। শ্যাডো ডিটেক্টর কোনও অপ্রাকৃত ছায়াকে চিহ্নিত করতে পারে। আর ইলেক্ট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা রেকর্ডার এমন সব শব্দকে রেকর্ড করতে পারে, যা সাধারণত কানে শোনা যায় না। যদি প্রেতের অস্তিত্ব জানা যায়, তা হলে ম্যাগনেশিয়াম নাইট ভিশন ক্যামেরায় ক্রমাগত ছবি তুলে যাওয়া হয়। কায়াহীনের ছবি ওঠা সম্ভব নয়। তবু কখনও কখনও ধোঁয়ার মতো কোনও আদল তৈরি হয়। গোস্ট বক্স নামের আর একটি যন্ত্র দিয়ে বেতার তরঙ্গের সন্ধান করা হয়। অজানা-অচেনা কোনও তরঙ্গ পাওয়া গেলেও প্রেতের অস্তিত্ব বোঝা যায় বলে জানালেন অভিজিৎ।

কেন এই ‘প্রেতাত্মা’রা গোলযোগ করেন? উত্তরে অভিজিৎ জানালেন, প্রেতেদের তরফে কিছু বলার থাকে। তাঁর মতে, প্রেতেদের আচরণ মানুষেরই মতো। কেবল প্রেতলোক মানুষের অজানা বলেই তার প্রতি ভয়ের জন্ম হয়। এক হিসেবে দেখলে, এঁরা সকলেই ‘অতৃপ্ত আত্মা’। কোনও না কোনও কারণে মরবিশ্বের বাঁধন ছেড়ে বেরোতে পারছেন না। সেই কারণটি জানলেই নাকি অনেক সময়ে কাজ হয়। যদি তার পরেও আত্মা না যেতে চায়, তখন ব্যবস্থা অন্য। লোবান বা ধূপের ধোঁয়া দিয়ে প্রাথমিক ভাবে দেখা হয়। এই কাজটিকে তাঁরা ‘ক্লিনজ়িং’ বলেন। ক্লিনজ়িংয়ের সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বাড়ি বা পরিবারের মানুষদের কোনও সুগন্ধি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়। কারণ, সুগন্ধে নাকি প্রেতেরা আকৃষ্ট হয়।

তবে সর্বদাই যে অতিপ্রাকৃত ঘটনার পিছনে প্রেতেদের হাত থাকে, তা নয়। ভিন্নতর লোকের বাসিন্দা, যারা ইহলোকে ‘পিশাচ’ হিসেবে পরিচিত, তাদেরও ভূমিকা থাকে অনেক ক্ষেত্রে। তেমন ক্ষেত্রে ‘শিল্ডিং’ বিশেষ ভাবে প্রয়োজন বলে জানালেন অভিজিৎ। কী এই শিল্ডিং? তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পে তন্ত্রোক্ত গাত্রবন্ধনের কথা বার বার লিখেছেন তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তেমনই কি কিছু? অভিজিৎ বললেন, “পিশাচ বা ডেমন সংক্রান্ত কেস এক বারই পেয়েছি। সে ক্ষেত্রে ইসলামে বর্ণিত আয়াতুল কুরসি পাঠ করেই বন্ধন বা শিল্ডিংয়ের কাজ করা হয়েছিল।”

ছায়ালোকের বাসিন্দাদের সঙ্গে কি সত্যিই যোগাযোগ করা যায়?

ছায়ালোকের বাসিন্দাদের সঙ্গে কি সত্যিই যোগাযোগ করা যায়? ছবি:সংগৃহীত

প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত যন্ত্রগুলির ভূমিকা যথেষ্ট। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলে কাশীপুর রাজবাড়ির পরিবারের একটি ঘটনার কথা শোনালেন ‘ডিটেক্টিভস অফ সুপারন্যাচারাল’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা দেবরাজ সান্যাল। পুরনো রাজবাড়ি থেকে বেশ কিছু সামগ্রী নিয়ে এসে নতুন বাড়িতে ব্যবহার করছিলেন পরিবারের সদস্যেরা। কিন্তু তার পর থেকেই নাকি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে। বিশেষ করে একটি মেয়ের ছায়া প্রায়শই দেখা যেতে থাকে। তাঁদের সমিতিকে খবর দেওয়ার পরে আলট্রাভায়োলেট স্পেক্ট্রাম লাইট জ্বালিয়ে ডিজিটাল ক্যামেরায় ক্রমাগত শাটার টিপে চলা হয়। তাতেই ধরা পড়ে ধোঁয়ায় গড়া সেই ছায়াশরীর, জানালেন দেবরাজ।

অভিজিতের মতো দেবরাজেরও মত, রাগ-দুঃখ-বেদনার মত কিছু ঐহিক চাহিদার কারণেই প্রেতপক্ষীয়েরা যোগাযোগ করতে চান। বিশেষ করে অপঘাতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে যে অনুভূতিটি মৃত্যুর মুহূর্তে সক্রিয় ছিল, প্রেতেদের মধ্যে তার প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। দেবরাজদের সংস্থার সদস্য সংখ্যা চার। ইতিমধ্যে তাঁরা কলকাতা পুলিশের সঙ্গে কাজ করেছেন। জোড়াবাগান ট্র্যাফিক গার্ডের বাড়িটিতে ‘ভৌতিক’ ঘটনার বিষয়ে তাঁরা অনুসন্ধান চালান। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দৃষ্টি বা চিত্তবিভ্রমের ঘটনাই উঠে আসে বলে জানালেন দেবরাজ। একই ভাবে কলকাতা হাইকোর্টের ১১ নম্বর এজলাসকে ঘিরে প্রচলিত ভৌতিক কিংবদন্তির তদন্তও তাঁরা করেছেন। উল্লেখ্য, এই কক্ষটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামী সহ অনেকেরই ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তথাকথিত উপদ্রবের সূত্র নাকি সেখান থেকেই। দেবরাজের কথায়, “আমরা শুধু প্রেতাত্মা খুঁজি না— আমরা খুঁজি চেতনার রহস্য, আত্মার গন্তব্য, এবং জীবনের গভীরতর অর্থ।” মৃত্যুর পরে সত্যিই কী ঘটে, তা ডিটেকটিভস অফ সুপারন্যাচারাল মানুষকে জানাতে চায়। মৃত্যুকে ভয় না করে প্রশ্ন করাই সঙ্গত, মত দেবরাজের।

ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের উপরেই দফতর সোল অ্যাকসেস নামের সংস্থার। তাঁদেরও কাজ পরলোকগত আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের, জানালেন সংস্থার কর্ণধার আশা অবধানি। তবে তাঁরা জোর দেন মিডিয়ামশিপের উপরে। মূল কাজটি তিনি নিজেই করেন বলে জানালেন আশা। আট-দশ বছর বয়স থেকেই অতিপ্রাকৃতের অস্তিত্ব তিনি অনুভব করতেন, দাবি আশার। পরে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে জীবিকার্জন শুরু করলেও বিগত ১২ বছর এই সংস্থাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। সোল অ্যাকসেস-ও বাড়ি, জমি সংক্রান্ত ‘অপ্রাকৃত’ সমস্যার বিষয়ে অনুসন্ধান করে। প্রেতের সন্ধান পেলে ক্লিনজিং এবং শিল্ডিংয়ের কাজ তাঁরা করে থাকেন। দুষ্ট আত্মা বিতাড়নের ব্যাপারে তাঁরা কোনও এঞ্জেল বা দেবদূতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে তাকে সরানোর ব্যবস্থা করেন বলে জানালেন আশা। তাঁর কথায় যেন আভাস পাওয়া গেল পশ্চিমের অতি প্রাচীন পিশাচতত্ত্ববিদ্যার বা ডেমোনোলজির। টেক্সাসের এক সংস্থা থেকে তিনি এই বিদ্যা শিখেছেন, জানালেন আশা। তবে তাঁর মত, কোনও কোনও ক্লিনজিংয়ে দীর্ঘ সময়ও লেগে যায়। এ সব ক্ষেত্রে ধৈর্য একটা বড় ব্যাপার। প্রেতসন্ধান যখন পেশা, তখন কেমন মক্কেল আসেন তাঁদের কাছে? উত্তরে আশা জানালেন, মক্কেলের সংখ্যা খুব কম থাকে না কখনওই। দিনে কম করে দুই থেক তিন জন তাঁদের কাছে আসেন সাহায্যের আবেদন নিয়ে।

শহর কলকাতার বুকেই রয়েছে প্রেতসন্ধানী বেশ কিছু সংস্থা।

শহর কলকাতার বুকেই রয়েছে প্রেতসন্ধানী বেশ কিছু সংস্থা। ছবি:সংগৃহীত

কতখানি সত্যি এই সব দাবি? খোঁজ নিতে দ্বারস্থ হতে হল বরাহনগরের এক বিজ্ঞানচক্রের সদস্য শুভায়ু সেনের। শুভায়ুর মতে, এ সব দাবির পিছনে ‘সত্য’ বলে কিছু না থাকাই স্বাভাবিক। কারণ, মৃত্যুকে তিনি ও তাঁর সহগামীরা ‘অন্ত’ হিসেবেই মনে করেন। প্রেতের উপদ্রব বা ওই জাতীয় কিছুর পিছনে মানুষের কর্মকাণ্ডই থাকে বলে তাঁর ধারণা। অবশ্যই এই ধারণাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না, জানিয়েছেন অভিজিৎ ও দেবরাজ। কিন্তু তার পরেও যে একটা ‘কিন্তু’ থেকে যায়! সেই ‘কিন্তু’টি কি নিছক লোকবিশ্বাস? কুসংস্কার? শুভায়ু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। দীর্ঘকাল প্রেততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করেছেন প্রাক্তন আইএএস দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়। তাঁর আত্মজীবনী ‘এক অখ্যাত আমলার আত্মদর্শন’-এ তিনি লিখছেন তাঁর অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার কথা। সিয়াঁস থেকে সাইকিকদের সঙ্গ তাঁকে বার বার কৌতূহলী করে তুলেছে ‘প্রাণের ও পারে’ বাসরতদের প্রতি। এমনকি, দক্ষিণ কলকাতায় তাঁদের পৈত্রিক বাড়িটির কথাও তিনি লিখেছেন, যেটি নিজেই ছিল একটি ‘এনটিটি’। সোজাসাপটা মানে করলে দাঁড়ায়, সেটি ভূতুড়ে বাড়ি ছিল না, বরং বাড়িটিই যেন ছিল একটি প্রেত।

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝবরাবর একটা সরু রাস্তা রয়েছে। আর কে না জানে, ভয়ই হল মানুষের আদিমতম অনুভূতি! এই ভয়কেই হয়তো সর্বদা ইউনিভারসাল সায়েন্টিফিক রিজনিং বা যুক্তিবাদ সর্বদা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আর তাই জন্ম হয় তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পের মতো, শরদিন্দুর বরদা-কাহিনিমালার মতো আখ্যানের। মার্গারেট অ্যাটউডের মতো দিকপাল সাহিত্যিকও লেখেন অতিপ্রাকৃত আখ্যান। গল্প-উপন্যাসের গণ্ডি ডিঙিয়ে যদি বাস্তবের মাটিতেও দাঁড়ানো যায়, তা হলে প্রেতসন্ধানকে একটা ‘আধুনিক’ পেশা বলতে হবেই। আজকের প্রেত-সন্ধানীরা বিবিধ যন্ত্রকে সামনে রেখে প্রেতচর্চার কাজকে রীতিমতো ‘সিরিয়াস’ এক কর্মকাণ্ড বলেই দেখাতে চান। লক্ষ করার বিষয়, এই প্রযুক্তির প্রয়োগের পিছনেও কাজ করছে ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’র এক আবছায়া জগৎ। প্রেত-সন্ধানীদের প্রায় প্রত্যেকেরই বক্তব্য, ‘বিজ্ঞান’ এই প্রহেলিকাময়তারও উত্তর দিতে পারে। কিন্তু আজ এই ভূতচতুর্দশী তিথিতে দাঁড়িয়ে সে সব কূটের মধ্যে যাওয়া কি সঙ্গত? বাংলার চিরায়ত চৌদ্দ প্রদীপ যখন জ্বলে ওঠে ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের আত্মার উদ্দেশে, যখন নিশুত রাতে হেমন্ত তার শিশির ঢেলে দেয় অন্ধকার ঝোপঝাড়, ঘাসজমির উপর, যখন খোলা ছাদে দাঁড়ালে উড়ন্ত রাতপাখিদের ডানার শব্দে প্রতিভাত হতে থাকে ‘ও কে ও কে ও কে ও কে গো’, তখন সেই সরু রাস্তাটি আবছা হয়ে আসে। মাথার ভিতরে ঘুর্ণিপাক খায় পাগল মেহের আলির ‘সব ঝুট হ্যায়’। কিন্তু সবই কি ‘ঝুট’? মহাবিশ্বচরাচরে সত্য আর মিথ্যার রহস্য বড় গোলমেলে। প্রেতসন্ধান সম্ভবত সেই সত্য-মিথ্যার দোলাচলের মধ্যেই দোদুল্যমান এক পেন্ডুলাম। যার দোলন চলে আসছে সভ্যতারও উন্মেষের আগে থেকে, বয়ে চলেছে অনন্তের দিকে।

Paranormal Investigation Paranormal Investigating Societies ghost Spirits
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy