Advertisement
১৮ মে ২০২৪

পেট বড় বালাই

শীত মানেই রকমারি আনাজ, ফল, কেক, পিঠেপুলির সময়। কিন্তু এর ঠেলায় বাড়তে পারে পেটের সমস্যা। এই সময়ে পেট ভাল রাখবেন কী ভাবে। পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক মহম্মদ আসিফ আলি আহমেদ। সাক্ষাৎকার অর্পিতা মজুমদার।শীত মানেই রকমারি আনাজ, ফল, কেক, পিঠেপুলির সময়। কিন্তু এর ঠেলায় বাড়তে পারে পেটের সমস্যা। এই সময়ে পেট ভাল রাখবেন কী ভাবে। পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক মহম্মদ আসিফ আলি আহমেদ। সাক্ষাৎকার অর্পিতা মজুমদার

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৭ ০১:১০
Share: Save:

প্রশ্ন: শীত এসেছে। এই সময়ে পেটের কী কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পেটের সমস্যা শুরু হয়। বর্ষাকালের শুরুতে জল ও বিভিন্ন খাবার থেকে ডায়েরিয়া হতে পারে। মূলত ব্যাকটেরিয়ার জন্য এই সমস্যা হয়। কিন্তু শীতের শুরুতে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাল— দু’ভাবেই ডায়েরিয়া হতে পারে। ভাইরাল ডায়েরিয়া কাবু করে মূলত বাচ্চাদের। অন্য দিকে, বাইরের খাবার, ফ্রিজে রাখা খাবার, প্রসেসড ফুড, ফাস্ট ফুড থেকে হজম সংক্রান্ত নানা সমস্যা, খাদ্যে বিষক্রিয়া প্রভৃতি কারণে বড়দের ডায়েরিয়া হয়।

প্রশ্ন: কী কী লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে পেটের সমস্যা হয়েছে?

উত্তর: পেট ব্যথা, ঢেঁকুর ওঠা, পেট ফাঁপা, খেতে অনীহা, পেট ভার হয়ে থাকা, খিদে না পাওয়া এমন হলে বুঝতে হবে পেটে সমস্যা হচ্ছে। এমন হতে পারে সকালে খেলেন বিকেল পর্যন্ত আর খেতেই ইচ্ছে করছে না। কারও কারও অবশ্য আগে থেকেই গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিন্যাল (জিআই) সমস্যা থাকে। হয়তো নিয়মিত মল সাফ হয় না। দু’দিন হল তো, এক দিন হল না। অন্য দিকে, আর এক দল আছেন, বার বার যাঁদের শৌচাগারে যেতে হয়। দিনে একাধিকবার। রাস্তায় বেরোলেই আতঙ্ক, কখন বেগ আসে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়ছে কি না নজরে রাখতে হবে।

প্রশ্ন: কী কী কারণে পেটের সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: প্রধানত খাবার ঠিকমতো হজম না হওয়ার কারণে একাধিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বছরভরের রুটিন বদলে অন্য কিছু খেলে বদহজমের সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে শীতের আগে পুজো ও উৎসবের মরসুমে মশলাদার খাবার, মাংস, মিষ্টি, ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এই খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের জন্য বদহজম, অ্যাসিডিটি, পাকস্থলীর প্রদাহ, গা-বমি, শরীর আনচান করার মতো সমস্যা দেখা দেয়।

প্রশ্ন: বছরের কোন কোন সময় পেটের সমস্যা বাড়ে?

উত্তর: শীতের শুরুর দিকে, যেমন সেপ্টেম্বরে বাড়তে পারে। নভেম্বর, ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে ভাল করে ঠান্ডা পড়লে তা কমে যায়। আসলে এই সময় খাদ্যাভাসের বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। এর পরে আবার তীব্র গরমে সমস্যা শুরু হয়। জুন-জুলাই থেকে শুরু করে অগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দেখা গিয়েছে, সাধারণত রোগীরা বছরে ৩-৪ মাস খুব ভোগেন। বছরের বাকি সময় মোটামুটি ভাল থাকেন। তবে গলব্লাডার বা বাইলডাক্ট রিলেটেড সমস্যা সারা বছর ধরে হতে থাকে।

প্রশ্ন: সাধারণত শীতে অ্যালকোহল গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনও সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: শুধু শীতে নয়, পুজোর মরসুমেও অনেকে মদ্যপান করেন। অ্যালকোহলের প্রভাবে উৎসব মরসুমের শেষ দিকে ও শীতের শুরুতে তাঁদের মধ্যে অনেকের প্যানক্রিয়াটাইটিস জনিত সমস্যা বাড়ে। তবে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় মদ্যপানের প্রবণতা আর পাঁচটা জায়গার থেকে বেশি। তাই বছরভরই প্যানক্রিয়াটাইটিস জনিত সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসেন।

প্রশ্ন: শুধু কি খাদ্যাভাসের পরিবর্তন বা বদহজমের কারণেই পেটের সমস্যা বাড়ে?

উত্তর: বিভিন্ন ভাইরাল রোগের ক্ষেত্রে, যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগ হলে রেসপিরেটরি ট্রাক্ট সংক্রমিত হয়। তখন জিআই সমস্যাও দেখা দেয়। যেমন, ডেঙ্গি ভাইরাস। সাধারণত জ্বর, মাথা ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, প্লেটলেট কমে যাওয়া এ সব হয়। কিন্তু অনেক সময় লিভারও আক্রান্ত হতে পারে। হয় তো প্লেটলেট তেমন কমছে না। ডেঙ্গিতে লিভার, কিডনি, হার্ট ফেল করতে পারে। হেপাটাইটিস-এ বা হেপাটাইটিস-বি হলে অ্যাকিউট লিভার ফেলিওরও হতে পারে। সেক্ষেত্রে মত্যুর আশঙ্কা ৮০ শতাংশ। পশ্চিমের দেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও আমাদের দেশে ডোনার না পাওয়া, পরিকাঠামোর অভাব প্রভৃতি কারণে যকৃৎ প্রতিস্থাপন এখনও প্রায় অসম্ভব। অথচ এ ক্ষেত্রে বাঁচার একমাত্র উপায় যকৃৎ বদলানো।

প্রশ্ন: সাধারণত কী কী খাওয়া যেতে পারে?

উত্তর: যাদের ডিসপেপসিয়া বা ফাংশনাল বাইল ডিজিজ আছে তাঁদের দুধ বা তেলেভাজার মতো খাবার খেলে হবে না। দুধ বা দুগ্ধজাত সামগ্রী বাদ দিতেই হবে। দুধ-চা বন্ধ করে গ্রিন-টি বা লেবু চা খেতে হবে। বিশেষ করে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে চা খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। তা হলে পেট ফাঁপা, ঢেঁকুর ওঠার সমস্যা অনেকখানি কমে যাবে। রাস্তার ধারে তেলেভাজার দোকানে একই পুরনো তেল বার বার ব্যবহার করা হয়। তাই সমস্যা বাড়ে। বাড়িতে তেলেভাজা বানিয়ে খেলে ততটা সমস্যা হয় না।

প্রশ্ন: চিকিৎসকের কাছে কি কোনও নির্দিষ্ট ডায়েট চার্ট নেওয়া উচিত?

উত্তর: কারও ফুলকপি খেলে সমস্যা হতে পারে। কারও বিশেষ কোনও শাক খেলে সমস্যা হতে পারে। ডায়েট চার্ট সাধারণত ঘরের টেবিলে পড়ে থাকে। আমাদের যা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তাতে তা মেনে চলা কার্যত অসম্ভব। তাই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেখে নিতে হবে, কোন খাবার খেলে বেশি সমস্যা হচ্ছে। তা বাদ দিতে হবে। এ ভাবেই নিজের চার্ট নিজে বানিয়ে ফেলতে হবে।

প্রশ্ন: বেশি করে জল খাওয়া বা ভোরে উঠে বেশি জল খেয়ে বমি করে পেট পরিষ্কার করা, এমন কিছু অভ্যাসে কি গ্যাস-অম্বলের সমস্যা কমে?

উত্তর: গড়ে দিনে তিন লিটারের কাছাকাছি জল খেতে হবে। তার বেশি খেলে অসুবিধা নেই। শরীর অভ্যস্ত হয়ে যায়। জল বেশি খেলে হজমের সমস্যা হয় না। আসলে শিল্পাঞ্চলে জলের গুণমান মোটেও যথাযথ নয়। তাই এখানে বেশি দিন থাকলেই পেটের সমস্যা দেখা দেয়।সকালে জল খেয়ে বমি করে পেট পরিষ্কার করার পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক। একমাত্র রোগ হলেই বমি হয়। বদহজম, পেটের সমস্যায় বমি হলে শরীর ভাল হয়। জোর করে বমি করা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ।

প্রশ্ন: শীতে বেশি করে শাক, আনাজ ও ফল খেলে কি পেটের সমস্যা কমবে?

উত্তর: শাক, আনাজ খাওয়া ভাল। কিন্তু এতে অনেকের সমস্যা হয়। কারণ, এখন আনাজে বেশি মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। সাইট্রাস জাতীয় ফল, যেমন মুসুম্বি, কমলালেবু খাওয়া ভাল। এতে পটাসিয়াম এবং বিভিন্ন ভিটামিন থাকে। এ ছাড়া পেয়ারা, কলা, পেঁপে খুব ভাল। এগুলি খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয়। তাই সংক্রমণের ভয় কম থাকে। ডায়াবিটিসের জন্য আপেল ভাল। কারণ, আপেল লো-ক্যালোরি ফল।

প্রশ্ন: সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য কী কী করা দরকার?

উত্তর: সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ওষুধ খেতে হবে। নিজে নিজে চিকিৎসা করা, রোগ নির্ণয় করে ফেলার বদভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাধারণ রোগীদের মধ্যে সচেতনতার বড় অভাব রয়েছে। দেরি করে চিকিৎসকদের কাছে গেলে সমস্যা জটিল হয়ে পড়ে। নিয়মিত চেক আপ বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে বয়স ৪০ বা ৫০ পেরোলেই রুটিন চেক আপ করা উচিত। সাধারণত দু’-তিন বছর আগে থেকেই রোগের লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। পরিবারে ক্যানসারের প্রবণতা যদি থাকে, যেমন কোলন ক্যানসার, জিআই ক্যানসার বা হেপাটিইটিস-বি তা হলে বেশি সচেতন হওয়া উচিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Winter শীত
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE