‘জামাইষষ্ঠী’ নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে আবেগ, প্রাচীন রীতিনীতি। বাংলার তেরো পার্বণের মধ্যে এটিও একটি। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠীদেবীর পুজো করে জামাইষষ্ঠী ব্রত পালন করা হয়। বিবাহিত মেয়ে এবং জামাইকে আপ্যায়ন করা এই ব্রতের রীতি।
নিয়মরীতি যেমনই হোক না কেন, এই অনু্ষ্ঠানের চর্চায় থাকে জামাইয়ের ভূরিভোজ। ফলার দিয়ে শুরু হয়। তার পর জামাইয়ের জন্য পছন্দমতো পদ রেঁধে খাওয়ান শাশুড়িমায়েরা। ভাত, পোলাও, কোর্মা, কালিয়া— কী না থাকে তাতে! মিষ্টি দই, সেরা মিষ্টি, ফল সবই জামাইয়ের পাতে তুলে না দিলে কী হয়!
এমন দিনের জন্য মুখিয়ে থাকেন ভোজনরসিক জামাইয়েরা। শাশুড়িমায়েরা প্রতি বছর তাঁদের জন্য ভেবে নতুন নতুন পদ বানান। জামাই যদি খেয়ে তৃপ্তি পান, তাতেই তাঁদের সুখ।
কিন্তু এ তো গেল ভোজনরসিক জামাইয়ের কথা। তবে এমন জামাইও তো আছেন, যিনি শরীর সচেতন। জিমে গিয়ে কসরত করেন। অনেকে আবার শারীরিক অসুস্থতার কারণেই নিয়মের বাইরে বেরোতে চান না। তেল-মশলা, চিনি দিয়ে তৈরি পদে যাঁদের আপত্তি, তাঁদের জন্য জামাইষষ্ঠীর মেনু কী ভাবে সাজাবেন শাশুড়িমায়েরা কিছু হদিশ রইল এখানে।
শরবতে রকমারি
চিনি বাদ! জামাইয়ের জন্য কী দিয়ে শরবত বানাবেন? ছবি: আনন্দবাজার ডট কম
গরমের দিনে ঘেমে-নেয়ে আসবেন জামাই। তেষ্টা মেটাতে কী দেবেন? ছাস থেকে ডাব কিংবা তরমুজের শরবত। চিনি যদি একেবারেই খেতে আপত্তি হয়, তা হলে ছাসই ভাল।
ছাস: বাঙালির দইয়ের ঘোলের মতো হলেও, ছাস হয় নোনতা, চিনির ব্যবহার থাকে না। টক দই, স্বাদমতো সৈন্ধব লবণ, জিরেগুঁড়ো, গোটা জিরে, পুদিনা দিয়ে মিক্সারে ঘুরিয়ে নিন। ছাস পরিবেশন করুন বরফকুচি যোগ করে।
ডাবের শরবত: গরমের দিনে ডাবের জলের বিকল্প হয় না। জামাইকে ডাবের শরবতও বানিয়ে দিতে পারেন। শাঁসযুক্ত ডাবের জল মিষ্টি হয়। ডাবের জল ঢেলে নিয়ে, শাঁস বার করে বেটে নিন। এ বার ডাবের জলে শাঁস মিশিয়ে স্বাদমতো সৈন্ধব নুন যোগ করুন। দিয়ে দিন সামান্য একটু লেবুর রস। বরফকুচি দিয়ে পরিবেশন করলেই এক চুমুকে শরীর এবং মন তরতাজা হয়ে উঠবে।
তরমুজের মকটেল: গরমের ফল তরমুজ দিয়ে মকটেল বানিয়ে ফেলতে পারেন। স্বাস্থ্যসচেতন জামাই এতে মোটেই না করতে পারবেন না। তরমুজের শাঁস বার করে মিক্সারে দিন। যোগ করতে হবে সামান্য পুদিনা, স্বাদমতো নুন, পাতিলেবুর রস। তরমুজে স্বাভাবিক মিষ্টত্ব থাকে, তাই চিনিতে আপত্তি থাকলে সেটি বাদ দিন। মিক্সারে ঘুরিয়ে নিন সমস্ত উপকরণ। তার পর ছাঁকনিতে ছেঁকে নিন। তবে পরিবেশন করতে হবে কায়দা করে। স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে টুকরো করা তরমুজ দিন। দিয়ে দিন গোল চাকা করে করে কাটা লেবু। সামান্য পুদিনা হামানদিস্তায় হালকা থেঁতো করে গ্লাসে দিন। তার পর বরফকুচি দিয়ে ঢেলে দিন তরমুজের মকটেল।
ভাতের পাতে কী থাকবে?
বাঙালির জামাইষষ্ঠী, পাতে ভাত থাকবে না তা কি হয়? তবে জামাই যে স্বাস্থ্য সচেতন! তাই পাঁঠার মাংসের লাল ঝোল বা চিংড়ির মালাইকারি বাদ হতে পারে। কিন্তু তা বলে এমন দিনে জামাই মাছ-ভাত খাবেন না, তা কী করে হয়! বাঙালির চিরপরিচিত খাবার কিন্তু মোটেই অস্বাস্থ্যকর নয়। তবে রন্ধনপদ্ধতিতে খানিক বদল আনতে হবে এই যা।
শাকভাজা
ভাতের পাতে শাক থাকে। শাক পুষ্টিকরও। তবে বেশি তেলে শাক ভাজলে আপত্তি হতে পারে জামাইয়ের। লাল শাক হোক বা কলমি নুন, হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে নিন আগেই। ননস্টিক কড়াইয়ে সামান্য তেলে প্রয়োজন মতো ফোড়ন দিনে হালকা জল থাকা অবস্থায় সেদ্ধ শাক নাড়াচাড়া করে ভেজে নিন। নামমাত্র তেলেই কিন্তু সুন্দর শাকভাজা হয়ে যাবে। পুষ্টিগুণ এবং স্বাদ বৃদ্ধিতে এতে বাদাম যোগ করতে পারেন।
মোচা দিয়ে মুগ ডাল
ডালে থাকে প্রোটিন। মোচাও পুষ্টিগুণে ভরপুর। স্বাদ বদলে পাতে রাখতে পারেন মোচা দিয়ে মুগ ডাল। মুগ ডাল শুকনো কড়ায় নাড়িয়ে নিন। তার পর ধুয়ে নুন, হলুদ এবং কাঁচালঙ্কা দিয়ে সেদ্ধ করে নিন। নুন হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে নিন মোচা। এ বার সামান্য সর্ষের তেলে শুকনো লঙ্কা জিরে ফোড়ন দিন। আদা, কাঁচালঙ্কা বাটা তার মধ্যে দিয়ে দিন। স্বাদ মতো নুন, হলুদ যোগ করুন, সেদ্ধ করা মোচা খুব ভাল করে রান্না করে নিন। তার পর ডালে ঢেলে দিলেই হবে। মুগ ডালে সামান্য চিনি দিলে খেতে ভাল হয়। প্রাকৃতিক চিনি যুক্ত স্টিভিয়া বা নারকেলের চিনি প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন।
পত্রানি মচ্ছি
ভেটকি মাছ বা বাসা মাছ দিয়ে বানিয়ে ফেলতে পারেন পত্রানি মচ্ছি। ছবি:সংগৃহীত।
ভেটকির পাতুরির বদলে স্বাদ বদলে তেল ছাড়া একটু ভিন্ন স্বাদের পত্রানি মচ্ছি রাখতে পারেন পাতে। গরম ভাতে এটিও কিন্তু বেশ লাগবে। রান্নাটি মূলত পারসিদের। রাঁধাও সহজ। বাসা মাছ বা ভেটকির ফিলে যে কোনও একটি বেছে নিতে পারেন এ জন্য। ফিলে ধুয়ে নিন। মিক্সারে নারকেল, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, রসুন বাটা, কাঁচা লঙ্কা স্বাদমতো নুন দিয়ে ঘুরিয়ে নিন। দিয়ে দিন পাতিলেবুর রস। মাছে মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে দিন। এ বার একটি পাত্রে জল ফুটতে দিন। উপরে ছিদ্রযুক্ত থালা বসিয়ে কলাপাতায় মোড়া মাছ সাজিয়ে দিন। উপর থেকে ঢাকা দিয়ে দিন। জল ফুটলে বাষ্পেই মাছ সেদ্ধ হয়ে যাবে।
তন্দুরি পমফ্রেট
জামাইয়ের পাতে দিতে পারেন তন্দুরি পমফ্রেটও। ছবি: সংগৃহীত।
ভাত ডালের সঙ্গে ভাজা মাছের যুগলবন্দিও দারুণ লাগে। জামাইষষ্ঠীতে বরং জামাইয়ের পাতে দিন তন্দুরি পমফ্রেট। গোটা পমফ্রেট ধুয়ে নুন হলুদ এবং লেবুর রস মাখিয়ে নিন। ছুরি দিয়ে পেট চিরে দিন যাতে মশলা ঢোকে। আদা-রসুন বাটা, ঝল ঝরানো টক দই, সামান্য শুকনো কড়াইয়ে নেড়ে নেওয়া বেসন, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, তন্দুরি মশলা এবং সামান্য তেল দিয়ে মিশ্রণ বানিয়ে মাছে মাখিয়ে ফ্রিজে ভরে রাখুন অন্তত ১ ঘণ্টা। তার পর মাইক্রোওয়েভ অভেন বা এয়ার ফ্রায়ারে তন্দুর করে নিন। ননস্টিক কড়ায় অল্প তেল দিয়ে উল্টে-পাল্টে ভেজে নিলেও হবে।
নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি ভাপা
অতিরিক্ত তেল দিয়ে মাছের পদ না বানিয়ে খাওয়াতে পারেন চিংড়ি ভাপা। ছবি: সংগৃহীত।
সর্ষে দিয়ে চিংড় ভাপার স্বাদ ভাতের পাতে দারুণ। কিন্তু সর্ষের তেল দিয়ে তা রান্না করা যাবে না জামাইয়ের কথা ভেবে। তাই সাদা, কালো সর্ষে, পোস্ত, কাঁচালঙ্কা, সামান্য হলুদ দিয়ে বেটে নিন। মিশিয়ে নিন স্বাদ মতো নুন। টাটকা নারকেলের দুধ বার করে নিন। টিফিন কৌটোয় ধুয়ে রাখা চিংড়ির মধ্যে সমস্ত উপকরণ মিশিয়ে নিন। তেলের অভাব পূরণ করবে নারকেলে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড। নারকেলের দুধের গুণও স্বাদও বাড়াবে অনেকটাই। এ বার কড়াইয়ে জল দিয়ে টিফিন কৌটো বসিয়ে মিনিট পনেরো ভাপিয়ে নিন।
কড়াইশুঁটির পোলাও
প্রেসার কুকারে সামান্য সাদা তেল দিয়ে কড়াইশুঁটি নাড়িয়ে চাড়িয়ে নিন। ধুয়ে ভিজিয়ে রাখা বাসমতী চাল যোগ করুন। হালকা নাড়িয়ে চাড়িয়ে নিন। স্বাদমতো নুন দিন। যতটা চাল দিয়েছেন তার দ্বিগুণ জল দিয়ে প্রেসার কুকারে হতে দিন। কিছু ক্ষণেই তৈরি হবে ঝরধরে পোলাও।
মুরগির রসল্লা
কম তেল মশলায় বানিয়ে ফেলুন মুরগির রসল্লা। ছবি: সংগৃহীত।
ঠাকুরবাড়ির কায়দায় স্বল্প উপকরণে রেঁধে ফেলতে পারেন চিকেন রসল্লা। এই রান্নায় শুধু একটু ঘি দরকার হয়। আর ঘি কিন্তু মোটেই অস্বাস্থ্যকর নয়। মুরগির মাংস ধুয়ে নিন। কড়াইয়ে ঘি, পেঁয়াজ, টক দই, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা দিয়ে মুরগির মাংস মাখিয়ে নিন। যোগ করুন স্বাদ মতো নুন। এই রান্নায় গরম মশলা, আদার ব্যবহার হয় না। সমস্ত উপকরণ কড়াইয়ে দিয়ে প্রথমে ২-৩ মিনিট বেশি আঁচে রান্না করুন, তার পর আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখুন। ভাপেই পুরো মাংস রান্না হবে। জল দেওয়ার দরকার হবে না।
স্যালাড
ভাতের পাতে স্যালাডও রাখুন। টম্যাটো, শসা, কাঁচা পেয়াজের সঙ্গে যোগ করুন লেটুস, সুইট কর্নও। লেবুর রস, নুন, গোলমরিচ ছড়িয়ে বানিয়ে নিন স্যালাড।
রায়তা
মিষ্টি দইয়ে অনেক ক্যালোরি। তাই জামাইষষ্ঠীর পাতে থা্কুক রায়তা। টক দই ভাজা জিরে গুঁড়ো, সৈন্ধব নুন, গোলমরিচ দিয়ে ফেটিয়ে নিন। যোগ করুন শুকনো বোঁদে। বোঁদের রায়তাও কিন্তু খেতে বেশ ভাল। দোকানেই শুকনো বোঁদে কিনতে পাওয়া যায়।
স্যাঁকা পাঁপড়
পছন্দের পাঁপড় মাইক্রোওয়েভ অভেন বা কড়াইয়ে সেঁকে নিন।
চাটনি:
শেষ পাতে চাটনি ছাড়া বাঙালির ভূরিভোজ জমে না। কিন্তু চিনি দেওয়া যে বারণ। তা হলে? শেষপাতের জন্য খেজুর, আমসত্ত্ব, টম্যটোর চাটনি। তবে এই চাটনিতে খেজুর পরিমাণ বেশি হবে। চিনির বদলে সামান্য গুড় যোগ করতে পারেন। খেজুরের স্বাভাবিক মিষ্টত্বেই চাটনি হবে স্বাদু।
শেষপাতের মিষ্টিমুখেও থাক স্বাস্থ্যকর কিছু
শেষপাতের মিষ্টিমুখেও থাক স্বাস্থ্যের খেয়াল। ছবি: আনন্দবাজার ডট কম
রাঙা আলুর রাবড়ি: হালকা সেদ্ধ করা রাঙা আলু এবং কাজুবাদাম মিক্সারে ঘুরিয়ে নিন। কড়াইয়ে মিশ্রণটি দিয়ে আঁচ কমিয়ে নাড়তে থাকুন। যোগ করুন সুগার ফ্রি বা গুড়, স্বাদমতো নুন, কেশর। মিশ্রণটি ঘন হয়ে এলে ঘরের তাপমাত্রায় ঠান্ডা হতে দিন। তার পর মাটির খুড়ি বা ছোট্ট হাঁড়িতে ভরে ফ্রিজে ঠান্ডা হতে দিন। উপর দিয়ে পেস্তা কুচি ছড়়িয়ে পরিবেশন করুন।
ম্যাঙ্গো মুজ়: আমের শাঁস, জল ঝরানো ছানা মিক্সারে ঘুরিয়ে নিন। মিশ্রণটি কাচের ছোট পাত্রে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন। উপর থেকে কাজু-পেস্তা বাদাম কুচি ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
আখরোটের বরফি: মিষ্টি খেলেই ক্যালোরি বাড়ার ভয়। কিন্তু জামাই মিষ্টিমুখ করবেন না, তা কী করে হয়? আখরোট, খেজুর দিয়ে বানিয়ে ফেলনু বরফি। কড়াইয়ে সামান্য ঘি দিয়ে আখরোট কুচি নাড়াচাড়া করে নিন। খেজুররে বীজ বার করে সামান্য ঘি দিয়ে নাড়াচাড়া করে নরম করে নিন। এতে যোগ করুন একটু খোয়া ক্ষীর। এর সঙ্গে আখরোট যোগ করুন। সমস্ত উপকরণ মিশে গেলে একটি পাত্রে বাটার পেপার দিয়ে মিশ্রণটি পাতলা করে চারিয়ে দিন। ঠান্ডা হলে বরফির মতো কেটে নিন।