Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
আত্মরক্ষা, নিয়মানুবর্তিতা, সংযম, ধৈর্যবৃদ্ধি... একজন মানুষকে সব দিক থেকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে ক্যারাটে
Karate

সুনাগরিক গড়ে তোলার পাঠ

ক্যারাটে কথাটির অর্থ চাইনিজ় হ্যান্ড। চিন থেকে তা বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়।

এই মার্শাল আর্টসের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতির মিল রয়েছে।

এই মার্শাল আর্টসের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতির মিল রয়েছে।

পারমিতা সাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:০৩
Share: Save:

বাঙালি পরিবারের ছোট সদস্যদের চিরকালই আঁকা, গান, নাচ, আবৃত্তির মধ্যে কোনওটি শেখানো রেওয়াজ। নব্য টেকনোলজির যুগেও সে ধারার ব্যত্যয় ঘটেনি। তাতে যোগ হয়েছে আরও পালক। তার মধ্যে একটি ক্যারাটে। বাবা-মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিস্থিতির কারণে ইদানীং এই মার্শাল আর্টসের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মূলত শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আত্মরক্ষার কৌশল শেখার জন্যই ক্যারাটে স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করেন অনেক অভিভাবক। ক্যারাটে কথাটির অর্থ চাইনিজ় হ্যান্ড। চিন থেকে তা বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়।

এই মার্শাল আর্টসের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতির মিল রয়েছে। গুরুগৃহে থেকে ক্যারাটে শিখতে হত। সুপ্রাচীন ভারতের ব্রহ্মচর্যের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। ক্যারাটের পুরো পদ্ধতিই চরিত্র গঠনে সহায়ক। যেমন, গুরুর এক নির্দেশে কাজ করতে হবে, ক্লাসে ঢুকে দোজো পরিষ্কার করা (যেখানে দাঁড়াচ্ছি, সে জায়গা পরিষ্কার করে দাঁড়ানো), শিক্ষককে ওশ করা (উপস্থিত হয়ে জানানো), ক্লাসে কথা না বলা, শিক্ষক ও সিনিয়ররা এলে উঠে দাঁড়ানো ইত্যাদি। এই ভাবধারাগত সাদৃশ্যের কারণেও ক্যারাটে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন নিয়মানুবর্তিতা আসে, তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে, এই উদ্দেশ্য নিয়ে গোড়ার দিকে ক্যারাটের পাঠ শুরু হয়।

নিয়মানুবর্তিতা, সংযম ও ধৈর্য

ক্যারাটে প্রশিক্ষণ শুরু হয় ওয়ার্ম আপ দিয়ে। তার পর এক্সারসাইজ়— স্কোয়াট, লাঞ্জেস, অ্যানিমাল মুভমেন্টস, পুশআপ। মেডিটেশন করানো হয় যাতে লক্ষ্য ঠিক থাকে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ে। আত্মরক্ষার জন্য শেখানো হয় নানা কৌশল। ক্যারাটে প্রশিক্ষক শিবায়ন গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে মা-বাবা বলেন, ঘর পরিষ্কার করতে। যারা ছোট থেকে দোজো করেছে, সেটা তারা নিজে থেকেই করবে। ব্ল্যাকবেল্ট পরীক্ষায় তখনই একজন শিক্ষার্থী বসতে পারবে, যখন সে তার মা-বাবার কাছ থেকে সম্পূর্ণ অনুমতি পাবে। ব্ল্যাক বেল্ট মানে তো শারীরিক ভাবে ক্ষমতাধর। ‘আমি দশটা লোককে পিটিয়ে দিতে পারি’, এই শক্তির অহঙ্কার প্রশমনের শিক্ষাও আসে ক্যারাটে থেকেই। দু’জন যখন লড়াই করছে, তখন যে জিতছে এবং যে হারছে, পরস্পরকে ওশ করে হ্যান্ডশেক করতে হবে। ষড়রিপু দমন করা, নিজের মধ্যে ডিসিপ্লিন আনা, সংযম, ধৈর্য বাড়ানো... একজন মানুষকে সব দিক থেকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে ক্যারাটে। ডিপ্রেশন, মুড সুয়িংয়েরও সমাধান হয় এর মাধ্যমে।’’

শারীরিক ফিটনেস

ফিটনেসের অনেক উপাদান আছে, যেমন স্টেবিলিটি, ব্যালান্স, ফ্লেক্সিবিলিটি, কার্ডিয়ো ভাস্কুলার এনডিয়োরেন্স, মাসকুলার এনডিয়োরেন্স, মাসকুলার স্ট্রেংথ... এই সমস্ত দিকগুলোরই উন্নতি এবং পেশির নমনীয়তা বাড়ানো যায় ক্যারাটের মাধ্যমে। বেশি বয়সে সহজেই চোট-আঘাত লাগার প্রবণতা থাকে। কিন্তু ফ্লেক্সিবিলিটি বেশি থাকলে সে ভয় অনেক কম। শিবায়নের মতে, ‘‘পেশির নমনীয়তা যত বেশি হবে, জয়েন্ট তত সাপল থাকবে এবং চোট আঘাতে কাবু হওয়ার ভয় কমবে। ক্যারাটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে কিছু আসন। পায়ের ব্যায়ামের ফলে নীচের ও উপরের পেশির এনডিয়োরেন্সের মাত্রা বাড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রীরা যত কিক, পাঞ্চ, প্যাড প্র্যাকটিস করবে একে অপরের উপরে, তাতে শরীরের কন্ডিশনিং হবে তত বেশি। কেউ হয়তো জিম করে সিক্স প্যাক অ্যাব বানিয়েছেন। অন্য দিকে আর একজন দীর্ঘ দিন ধরে ক্যারাটে করলেও তাঁর সিক্স প্যাক নেই। এ বার যিনি ক্যারাটে করেছেন, তাঁর পেটে ঘুষি, লাথি মারা হলে বা হকি স্টিক দিয়ে মারা হলেও, তাঁর কিন্তু লাগবে না। কারণ ক্যারাটেতে কন্ডিশনিংয়ের পদ্ধতি রয়েছে।’’

কেমন সেই পদ্ধতি? ষোলো সতেরো বছর বয়সের পরে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে পেট, থাই, কাফ-এ হালকা করে মারতে মারতে, মার নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানো হয়। ‘‘বিপদে পড়লে আপনাকে মার খেতেই হবে। সেখান থেকে কী ভাবে বেরিয়ে আসতে পারবেন, সেটাই ক্যারাটে শেখায়। শুধু মার নেওয়া নয়, আপনি মারলেও যেন এফেক্টটা সাংঘাতিক হয়। পায়ে আঘাত করে উইকেট ভাঙা হয়তো অনেকেই দেখেছেন। এটা শো অফের জন্য নয়। আপনার একটা মারে যাতে সাংঘাতিক এফেক্ট হয়, তার জন্য। এটা হার্ডকোর ফুল কনট্যাক্ট ক্যারাটে ছাড়া সম্ভব নয়,’’ বললেন শিবায়ন।

এখন অবশ্য বিষয়টাকে সহজ করার জন্য নন-কনট্যাক্ট ফর্মেও ক্যারাটে প্র্যাকটিস করানো হচ্ছে। এতে একে অপরকে স্পর্শ করা হয় না। শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হলে তবেই ফাইট করতে দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি স্ট্যামিনাও বাড়ে।

বেল্ট বিষয়ে...

এই মার্শাল আর্টসের অন্যতম আকর্ষণ বেল্ট সিস্টেম। ছ’টি বেল্ট রয়েছে। শুরু হোয়াইট বেল্ট দিয়ে, শেষ ব্ল্যাক বেল্টে। মাঝে ব্লু, ইয়ালো, গ্রিন, ব্রাউন। প্রত্যেকটি ধাপের আপার গ্রেড রয়েছে, যেমন আপার ব্লু, আপার ইয়ালো ইত্যাদি। ব্ল্যাক বেল্টের আবার দশটা ডিগ্রি হয়। সেটা সময় এবং অভিজ্ঞতা হলে, তবেই দিতে দেওয়া হয়।

সন্তানকে নাচ-গান বা পিয়ানো শিখতে ভর্তি করানোর সময়ে অভিভাবকেরা যেমন যথেষ্ট খোঁজ নিয়ে তবেই করেন, তেমনই ক্যারাটের ক্ষেত্রেও খোঁজখবর নেওয়া জরুরি। ক্যারাটে শিখতে গিয়ে ভুল অনুশীলনের কারণে শরীরে আঘাত লাগলে পরে তা থেকে সমস্যা হতে পারে। পরিশেষে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, ভর্তি হলেই ছেলে বা মেয়ে যে ক্যারাটেতে পারদর্শী হয়ে উঠবে, তা কিন্তু নয়। যে কোনও পারফর্মিং আর্টসের মতো এ ক্ষেত্রেও দক্ষতা অর্জন নির্ভর করে প্র্যাকটিসের উপরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health fitness Karate Martial Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE