Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ডিম্বাশয়ের নাছোড় সমস্যা

মোটা হয়ে যাচ্ছেন? চুল উঠছে? ঋতুচক্র অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন? গলায় বা বগলে মোটা কালো দাগ রয়েছে? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয় তা হলে আপনি সম্ভবত ‘পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম’-এ আক্রান্ত। লিখছেন জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৌগত বর্মন।মোটা হয়ে যাচ্ছেন? চুল উঠছে? ঋতুচক্র অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন?

ছবি প্রতীকী। তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য

ছবি প্রতীকী। তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৩০
Share: Save:

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম মহিলাদের মধ্যে অ্যান্ড্রোজেন বা পুরুষ হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাবার জন্য হয়। পিসিওএস এর লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে আছে ঋতুচক্র অনিয়মিত হওয়া বা না হওয়া, মাসিক ঋতুচক্রের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, মুখে এবং শরীরে অবাঞ্ছিত লোম, ব্রণ, পেটে ব্যথা, গর্ভধারণে ব্যর্থতা, চামড়ায় পুরু, গাঢ় কালচে-বেগুনি দাগ। এ ছাড়া বহুমূত্র রোগ, অতিস্থূলতা, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, হৃদরোগ, মেজাজ পরিবর্তন, এবং এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার এর ফলে হতে পারে।

জিনগত এবং পরিবেশগত কারণের মিলিত প্রভাবে পিসিওএস হতে দেখা যায়। অতিস্থূলতা, যথেষ্ট ব্যায়াম না করা, পারিবারিক বা জিনগত ভাবে বংশে এই রোগের উপস্থিতির কারণে এই সমস্যায় মহিলারা আক্রান্ত হতে পারেন। ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু ঠিকমতো তৈরি না-হওয়া, উচ্চ মাত্রার অ্যান্ড্রোজেন থাকা, ওভারিয়ান সিস্ট, হাইপোথাইরয়েডিজম, রক্তে উচ্চ ​​মাত্রায় প্রোল্যাক্টিনের উপস্থিতি প্রভৃতি থাকলে সেই রোগীর শরীরে পলিসিস্টিক ওভারি থাকার আশঙ্কা।

এই রোগ পুরোপুরি সারে না। জীবনধারায় পরিবর্তন করে, ওজন কমিয়ে, খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে, যোগব্যায়াম করে একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করলে রজঃস্রাব স্বাভাবিক হয়, অবাঞ্ছিত লোম এবং ব্রণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মেটফরমিন এবং অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন ব্যবহার করলেও কাজ হতে পারে। বিশেষ ধরনের চিকিৎসা করেও ব্রণ এবং অবাঞ্ছিত লোম অপসারণ করা যেতে পারে। ওজন কমানোর সঙ্গে ক্লমিফেন, বা মেটফরমিন ব্যবহার করা যেতে পারে। এই রোগীদের গর্ভধারণ করতে সাধারণত সমস্যা হয়। তাই এঁদের জন্য ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। ১৮ থেকে ৪৪ বছরের মহিলাদের মধ্যে এন্ডোক্রিন গ্রন্থির রোগ পিসিওএস প্রচুর দেখা যায়। এই বয়সের প্রায় ২-২০ শতাংশ মহিলা এই অসুখে আক্রান্ত। মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের এটি অন্যতম প্রধান কারণ। এখন যাকে পিসিওএস বলা হয় সেই রোগের প্রাচীনতম বর্ণনা পাওয়া যায় ১৭২১ সালে ইতালিতে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে ৬-১০ শতাংশ মহিলা এই রোগে আক্রান্ত। এই রোগের প্রধান কারণ হিসাবে জিন এবং পরিবেশ—এই দু’টিকেই চিহ্নিত করা যায়। আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ভুল খাবার, তামাক সেবন, শরীরচর্চায় অনাগ্রহ, মেদ বহুলতা এবং অত্যাধিক চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ এই রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পিসিওএস-এ শারীরবৃত্তীয় যে পরিবর্তন গুলি দেখা যায় তা হল প্রতিটি ডিম্বাশয় ১২ বা তার বেশি সিস্ট বা জল ভর্তি থলির মত অংশ হয়। তার মাপ ২-৯ মিমি আয়তনের। ডিম্বাশয়ের আয়তন হয় ১০ এমএলের বেশি। এই রোগ নির্ণয় করা হয় মূলত আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও রক্তে বিশেষ কিছু হরমোনের মাত্রা দেখে। বর্তমানে উন্নত দেশের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশে যেমন ভারতেও এই সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

১৯৩৫ সালে আমেরিকার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আরভিন এবং স্টেইন সিনিয়র এবং মিচেল এল লেভেন থাল সর্বপ্রথম বিশ্বের মানুষের কাছে এই রোগের পরিচয় ঘটান। এই রোগটিকে কেন্দ্র করে কিছু বিতর্ক রয়েছে চিকিৎসক মহলে। পূর্বে এই রোগটিকে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ বা পিসিওডি বলা হত। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করতেন, এটি মূলত ডিম্বাশয়ঘটিত রোগ। পরে জানা যায়, এটি মাল্টি ফ্যাক্টিরিয়াল বা সমষ্টিগত কারণের ফলে সৃষ্টি হওয়া একটি রোগ। ডিম্বাশয় ছাড়াও এই রোগে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন, অগ্ন্যাশয়, হাইপোথ্যালামাস, আড্রিনাল গ্রন্থি, ত্বক, চুলও নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই রোগের মূলত তিনটি লক্ষণ দেখা যায়। ১। পলিসিস্টিক ডিম্বাশয়, ডিম্বাণু প্রস্ফুটনে অক্ষমতা ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু মেটাবলিক লক্ষণ রয়েছে যেমন মেদবৃদ্ধি, স্থূলতা, ইনসুলিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা, টাইপ-২ ডায়াবিটিসের সেলিটাস, হৃদযন্ত্র ও রক্ত সঞ্চালন জনিত রোগ, অতিরিক্ত মানসিক চাঞ্চল্য, অবসাদ, স্তন ও জরায়ুর ক্যানসারের প্রাবল্য বাড়া। এই রোগে ৮% আফ্রিকান, ৪.৮% আমেরিকান আক্রান্ত। ককেশিয়ান প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে ৬.৮% এবং গ্রিকদের ৬.৫% এর মধ্যে এই রোগ দেখা যায়। এই রোগ ১৫-৪৫ বছরের মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। তরুণ প্রজন্মই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগ নির্ণয় করতে গেলে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তা হল ‘রটারডাম ক্রাইটেরিয়া’। দুই বা তার বেশি ‘ক্রাইটেরিয়া’ বা লক্ষণ মিলে গেলে এই রোগকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন, ডিম্বাণু নিঃসরণ কম বা না হওয়া। পুরুষের মতো টাক পরে যাওয়া, গোঁফ, দাড়ি গজানো, পুরুষ হরমোন টেস্টাটেরনের ক্ষরণ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি। আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে ডিম্বাশয়ে ১২ বা তার বেশি সিস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। এ ক্ষত্রে আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে মালা বা নেকলেসের মত সিস্ট ওভারির প্রান্তিয় প্রদেশে পরিলক্ষিত হয়। এই রোগে মূলত এলএইচ হরমোনের আধিক্য দেখা যায়। বর্তমানে বিদেশে বেশ কিছু বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন যে, এই রোগের সঙ্গে জিনের যোগাযোগ নিবিড়।

এই রোগে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, অতিরিক্ত চর্বি এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য বর্জন করা উচিত। ফাস্টফুড এবং জাঙ্ক ফুড জাতীয় খাবার একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। সবুজ আনাজ, লো ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। নিয়মিত শরীরচর্চা করা, প্রতিদিন সকালে অন্তত এক কিলোমিটার হাঁটা, আধ ঘন্টা শরীরচর্চা, ঘাম ঝরানো অবাঞ্ছিত ক্যালোরি থেকে আমাদের মুক্তি দেয়। এর চিকিৎসা হিসাবে ইনসুলিন সেনসিটাইজার বা সেটফরমিন ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন-সমন্বিত ওষুধ যা রজচক্র নিয়ন্ত্রণ করে। ডিম্বাশয় সিস্টের সংখ্যা কমায়।

ওভারিয়ান ড্রিলিং করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। ল্যাপ্রোস্কোপির মাধ্যমে ডিম্বাশয়ের সিস্টে ড্রিল বা ফুটো করার পর বিদুৎ চালনা করা হয় যাতে সিস্টগুলি নষ্ট হয়ে যায়। যদিও বর্তমানে এর ব্যবহার কম হয়। কারণ, অনেকেই মনে করেন, এতে ডিম্বাশয়ের দেওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই রোগের জন্য যাঁদের সন্তান ধারণে অসুবিধা হয় তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রে আইইউআই, আইভি এফ, টেস্ট টিউব বেবি, সারোগেসি ডিম্বাণু দাতা ইত্যাদির সাহায্য নেওয়া হয়। আইইউআইয়ের মাধ্যমে ১৫% থেকে ৩০% ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া যায়। আইভিএফের ক্ষেত্রে ৪০-৫০% সাফল্য পাওয়া বা এফইটি বা ফ্রোজেন এমব্রায়ো প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ৬০% পর্যন্ত সাফল্য লক্ষ্য করা যায়। ইদানিং এই রোগের চিকিৎসা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে।

অনুলিখন: মনিরুল শেখ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Polycystic ovary Ovary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE