জাপানি এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলেও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে অধিকাংশ বয়স্ক বাসিন্দাদেরই প্রতিষেধক টিকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেটাই আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তরবঙ্গে জেই প্রতিরোধের কাজে। চিকিৎসকদের অনেকেই তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জেই এবং অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রম ফের হানা দেওয়ায় স্বাস্থ্যাকর্তাদের একাংশ বুঝতে পারছেন প্রতিষেধক টিকাকরণের কাজ ব্যাপক হারে না-হওয়ায় বিপদের আশঙ্কা রয়েই গিয়েছে। বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ তাই জেলার সমস্ত ব্লকগুলিতে প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার আর্জি স্বাস্থ্য দফতরে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘‘দেশের মধ্যে প্রথমবার এ ধরনের টিকা দেওয়া হচ্ছে। ১-১৫ বছরের কচিকাঁচাদের টিকা করণ আগেই হয়েছে। কোচবিহার জেলা বাদ ছিল। সেখানেও এ বছর করা হয়েছে। তবে বয়স্ক বাসিন্দাদের টিকা পর্যাপ্ত মিলছে না। বাইরে থেকে কেন্দ্রে সরবরাহ করছে। স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কথা বলছি। আরও বেশি টিকা সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ দার্জিলিং জেলার বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াও মনে করেন কেন্দ্রের বিষয় হোক আর রাজ্যের, মানুষকে বাঁচাতে যে টিকা দরকার তা সরবরাহের জন্য উভয় তরফেই ব্যবস্থা করতে হবে।
গত তিন বছর ধরেই অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রম তথা এইএস এবং জেই-তে শতাধিক রোগীর মৃত্যু ঘটেছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে। গত বছরও ১৬০ জন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে মারা যান। তার মধ্যে ৩৬ জন জেই-তে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আক্রান্ত হয়েছিলেন মোট পাঁচ শতাধিক বাসিন্দা। এ বছরও জানুয়ারি থেকে ২১ জন মারা গিয়েছেন। তার মধ্যে ৭ জন জেই। শনিবার রাতে জলপাইগুড়ির নাগরাকাটার বাসিন্দা মঙ্গরু নায়েক (৫০)এইএস-এ মারা যান। বয়স্করাই বেশি করে আক্রান্ত হচ্ছে দেখে টিকাকরণের ব্যবস্থার দাবি ওঠে। কচিকাঁচাদের জেই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তখনও বয়স্ক বাসিন্দাদের টিকাকরণের ব্যবস্থা ছিল না। সে বছরই অসমে বয়স্ক বাসিন্দাদের পরীক্ষামূলক ভাবে জেই টিকা দেওয়ার কাজ হচ্ছিল। এর পরেই রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে এ বছর উত্তরবঙ্গে বয়স্ক বাসিন্দাদের টিকাকরণের ব্যবস্থা করেন। মাস দেড়েক আগে বয়স্ক বাসিন্দাদের টিকাকরণ কর্মসূচির আগে শিলিগুড়িতে এসে স্বাস্থ্য অধিকর্তাও জানিয়েছিলেন, দেশের মধ্যে প্রথম বয়স্ক বাসিন্দাদের জেই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিষেধক বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সে কারণে যে পরিমাণ মিলছে সেটাই ৮ টি ব্লকের বাসিন্দাদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য দফতর এবং উত্তরবঙ্গ মে়ডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেরই একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ অনুসারে কোনও জেলায় ২ জন জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের রোগী পাওয়া গেলেই গোটা জেলার বাসিন্দাদেরই প্রতিষেক দেওয়া উচিত। সেই অনুসারে উত্তরবঙ্গের ৭ টি জেলার সমস্ত বয়স্ক বাসিন্দাকেই প্রতিষেক দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিষেধক সরবরাহের সমস্যায় তা সম্ভব নয় বলে বুঝতে পারেন স্বাস্থ্য কর্তারা। সে কারণে এপিডেমিওলজিস্টদের পরামর্শে ঠিক হয় সবার আগে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং আলিপুরদুয়ার জেলার সমস্ত বাসিন্দাদের প্রতিষেধক দেওয়া হোক। কিন্তু সেই প্রতিষেধকও কেন্দ্রের তরফে মেলেনি বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত ১০ লক্ষ প্রতিষেধক মেলার আশ্বাস পেয়ে আলিপুদুয়ারের ৪ টি ব্লক, জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিঙের ২টি করে ব্লকে প্রতিষেধক দেওয়া সম্ভব হয়। অথচ জলপাইগুড়িতে ৭টি, আলিপুরদুয়ারে ৬টি এবং দার্জিলিং জেলায় ১২টি ব্লক রয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের একটি সূত্রই জানিয়েছে, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার বা দার্জিলিং ছাড়া উত্তরবঙ্গের অন্য জেলাগুলিতেও দুই বা ততোধিক জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের রোগী মিলেছে। তাই সব ক্ষেত্রেই টিকাকরণ জরুরি।
দেখা যায় দার্জিলিঙের নকশালবাড়ি এবং মাটিগাড়া দুটি ব্লকে বয়স্ক বাসিন্দাদের প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ১০ হাজারের মতো প্রতিষেধক কম পড়ছে। মাস দেড়েক আগে ওই টিকা দেওয়ার সময় স্বাস্থ্য দফতরে তা জানিয়ে জেলার মুখ্য্ স্বাস্থ্য আধিকারিকের দফতর থেকে টিকা চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে খড়িবাড়ি ব্লকেও ৬০ হাজার বাসিন্দাকে টিকাকরণের জন্য প্রতিষেধক চাওয়া হয়। স্বাস্থ্য দফতর থেকে সেই মতো আরও ৭০ হাজার প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করে পাঠানো হচ্ছে। আগামী ১৪ জুলাই থেকে ওই ব্লকে বয়স্ক বাসিন্দাদের এনসেফ্যালাইটিসের টিকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জলপাইগুড়ির ৫ টি এবং আলিপুরদুয়ারের ২টি এবং দার্জিলিঙের ৯টি ব্লকে বয়স্ক বাসিন্দাদের টিকাকরণের কোনও ব্যবস্থা এখনও করতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। দার্জিলিং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত বিশ্বাস বলেন, ‘‘দুটি ব্লকে বয়স্ক বাসিন্দাদের টিকাকরণ হলেও ১০ হাজারের মতো জেই প্রতিষেধক টিকা কম পড়েছিল। তা চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে খড়িবাড়ি ব্লকেও বাসিন্দাদের জন্য টিকা চাওয়া হয়। স্বাস্থ্য দফতর তা সরবরাহ করছে।’’ পরবর্তীতে ফাঁসিদেওয়া ব্লকেও টিকাকরণের ব্যবস্থা করার জন্য তাঁরা ভাবনা চিন্তা করছেন বলে জানান। জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্রই জানিয়েছে, তারাও সমস্ত ব্লকগুলিতে টিকাকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বাস্থ্য দফতরে জানিয়েছেন। জলপাইগুড়ির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রকাশ মির্ধা বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতরকে জানানো হয়েছে। কিছু বলার থাকলে তারাই বিষয়টি জানাবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy